সাম্প্রতিক কালে কোরোনা ভাইরাসের বাতাসে ভেসে বেড়ানোর তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে । তাই নিয়ে চর্চা চলছে । না, আমরা এটা শুধু বলার জন্য বলছি না । কারণ ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কোরোনা ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় । তাঁরা ইতিমধে্যই ঘোষণা করেছেন যে, কোনও কোরোনা রোগীর মুখ থেকে বের হওয়া মাইক্রো—ড্রপলেট বাতাসে দীর্ঘক্ষণ ভেসে বেড়ায় এবং সেখান থেকেই SARS COV2 ভাইরাস কোনও রোগহীন ব্যক্তিকে সংক্রমিত করতে পারে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই মতকে সমর্থন করে বলেছে, মানুষের আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত । এতে মানুষের মনে আরও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে । বিশেষ করে যখন প্রতিদিন দেশে সংক্রমণের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে । তাহলে বায়ুবাহিত কোরোনা সংক্রমণ আসলে কী? আর কী করে একে প্রতিহত করা যায় ?
কোরোনা ভাইরাস আকৃতিতে সামান্য বড় তাই এটি পাঁচ মাইক্রনের থেকে আকারে বড় ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায় । এখনও পর্যন্ত আমরা এটাই ভেবে এসেছি । এই তথ্যের উপর ভিত্তি করেই মানুষ একে অপরের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে ওয়াকিবহাল হয়েছে । কিন্তু সম্প্রতি জানা গেছে, আমাদের চারপাশে থাকা মানুষের নিঃশ্বাস—প্রশ্বাসের মাধ্যমে এমনকী দূরত্ববিধি বজায় রেখে কথা বললেও ভাইরাস ছড়াতে পারে । আর এই তথ্য জানার পরই সকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে । সাধারণত আমাদের লালারসের বড় ড্রপলেটগুলি এতটাই ভারী হয় যে, তারা মুখ থেকে বেরিয়ে মাধ্যাকর্ষণের টানে দ্রুত মাটিতে ঝরে পড়ে । কিন্তু লালারসের যে বিন্দুগুলি আকৃতিতে পাঁচ মাইক্রনের থেকেও ছোটো, ওজনে হালকা হওয়ায় তারা বাতাসে দীর্ঘসময় ভেসে বেড়াতে পারে । সেই ড্রপলেটের আশপাশে থাকা যে মানুষ নিঃশ্বাসের মাধ্যমে তা গ্রহণ করেন, তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হওয়ার ভয় থাকে । এই সংক্রমণ হয় বাতাসের মাধ্যমে । আর এভাবে সংক্রমিত হওয়ার তথ্য বর্তমানে সকলের মধে্য তীব্র উদ্বেগ তৈরি করছে । এর কারণ, বিজ্যানীরা সতর্ক করেছেন কোরোনা ভাইরাস ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়াতে পারে এবং এটি ছোঁয়াচে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জনবহুল জায়গায়, যদি কোরোনা আক্রান্ত কারও সঙ্গে বেশি সময় কাটানো হয়, সেক্ষেত্রে সহজেই রোগহীন কোনও মানুষের সংক্রমিত হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে । WHO—ও এই মতের সপক্ষেই সওয়াল করেছে, যা উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে । তাৎপর্যপূর্ণভাবে, মাইক্রোস্কোপিক ড্রপলেটের মাধ্যমে কোরোনার সংক্রমণ কোনও নতুন ঘটনা নয় । কারণ WHO জানিয়েছে যে, কোরোনা আক্রান্তরা যখন কোনও ‘নন—ইনভেসিভ’ চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যায় যেমন ট্র্যাকিয়া বদল করা বা বাইরে থেকে কোনও পাইপ শরীরে প্রবেশ করানো–সেক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তে এই সম্ভাবনা থাকে । প্রশ্বাসের মাধ্যমে কোরোনা রোগীর নাক থেকে বেরিয়ে যাওয়া বাতাস কিংবা ড্রপলেট থেকে এই ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে । এই ভাইরাস কেবলমাত্র হাসপাতালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় । নয়া সংযোজন হল, একইরকম বিপদ আমাদের ঘরবাড়ি, বহুতল এবং অফিসেও রয়েছে যেখানে বাতাসের প্রবাহ খুব একটা ভালো নয় বা যেখানে যথাযথভাবে বাইরের তাজা বাতাস চলাচল করতে পারে না । চিন এবং অ্যামেরিকায় এই ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, কয়েকজন কোনও কোরোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে না এসেও সংক্রমিত হয়েছে । এতে বোঝা গেছে যে, শুধুমাত্র কোনও কোরোনা রোগী হাঁচলে বা কাশলেই এই ভাইরাস আর একজনের মধ্যে ছড়াচ্ছে না । বা বড় বড় ড্রপলেট থেকেই শুধু সংক্রমণ ছড়ায় না । বাতাসে ভেসে বেড়ানো কোরোনা ড্রপলেট ছয় থেকে নয় ফুট পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে । তারা আশপাশের কোনও বস্তুতে আটকেও থাকতে পারে । যদি কেউ মাইক্রোস্কোপিক ড্রপলেট—মেশানো বায়ুতে শ্বাস নেয় তাহলে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাস তার শরীরে প্রবেশ করবে, যদি সে যে হাত দিয়ে আগে নাকে, চোখে বা মুখ স্পর্শ করেছিল, সেই একই হাত দিয়ে ফের সেই সব স্থান স্পর্শ করে । যদিও এখনও এটা অজানা যে ঠিক কতটা পরিমাণে সংক্রমণ এর থেকে হতে পারে, তবুও সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি ।
ভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে নিস্তার পেতে সাহায্য করতে পারে বাতাস । বলা হয় যে কাঁটা দিয়েই কাঁটা তোলা সম্ভব । ঠিক সেভাবেই কোরোনা ভাইরাস, যা বাতাসের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়–ঠিক এই মাধ্যম দিয়েই আবার এর থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব । এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিন নয় যদি বাতাসের মুক্ত প্রবাহ থাকে আর ঘরবাড়ি, বহুতল এবং অফিসে ভাল বাতাস চলাচলের বন্দোবস্ত থাকে । যখন বাইরে যাওয়ার দরকার পড়বে, বাড়ির বাইরে বেরোনোর সময় আমাদের মাস্ক পরতে হবে । ফিরে এসে বাড়িতে হাত বার বার ধুতে হবে । তবে শুধু এটাই যথেষ্ট নয় । এটাও সুনিশ্চিত করতে যে, বাড়িতে বাতাস যেন মুক্তভাবে প্রবাহিত হয় । বহুতলগুলিতে বাতাসের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে দরজা, জানালা খুলে রাখা উচিত । এগজ়স্ট ফ্যানের ব্যবহার বাড়াতে হবে । এতে ভাইরাস থাকলে, তা বাতাসের মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে যাবে । কোরোনার মতো ভাইরাস এমন কোনও জায়গায় বেশিক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে না যেখানে বাতাস চলাচলের সুবব্যবস্থা আছে, পর্যাপ্ত সূর্যালোক আছে এবং তাজা বাতাস অবাধে বইতে পারছে ।
এক জায়গায় যেন খুব বেশি মানুষ ভিড় না করে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে । লিফটের ব্যবহার যতটা সম্ভব কমাতে হবে । আর ব্যবহার করতে বাধ্য হলে সেখানে এগজ়স্ট ফ্যানের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে ।
পরোক্ষ নিঃশ্বাস—প্রশ্বাস এড়াতে হবে
এটা নিশ্চিত করাও খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, অন্যের প্রশ্বাস যে বাতাসে মিশছে, তাতে কেউ যেন শ্বাস না নেয় । এই কারণে মাস্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ । এই ধরনের ঘটনায় আলস্য অবশ্যই এড়ানো উচিত । কোরোনায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও অনেকের শরীরে উপসর্গ দেখা দেয় না । এই ধরনের উপসর্গবিহীন মানুষও সংক্রমণ ছড়াতে সমান বা কখনও কখনও আরও বেশি ঝুঁকি তৈরি করে । কাজেই আশপাশের প্রত্যেককে কোরোনা আক্রান্ত ধরে নিয়ে সতর্ক হওয়া খুব জরুরি । প্রত্যেককে সবসময় মাস্ক পরতে হবে । আমাদের প্রত্যেককে মাস্ক পরা অভ্যাসে পরিণত করতে হবে । শুধুমাত্র অফিসে নয়, বাড়িতেও মাস্ক পরতে হবে । মাস্ক পরার গুরুত্ব অতটা নেই তা ভাবলে চলবে না । মাস্ক যাতে সকলে সঠিকভাবে এবং নিষ্ঠা সহকারে পরে তা নিশ্চিত করাকে আমাদের দায়িত্ব ধরে নিয়ে পালন করতে হবে ।
ছোটো মাস্ক পরবেন না । এমন মাস্ক পরবেন যা আপনার নাক, মুখ এবং গলার নিচের দিকের অংশ সম্পূর্ণ ঢেকে রাখে । মাস্কের গুণমান যেন ভালো হয় । কাপড়ের মাস্ক ভালো কিন্তু আশপাশে কোরোনা আক্রান্তদের উপস্থিতিতে ঠিক যতটা নিরাপত্তা দেওয়া উচিত, ততটা এই মাস্ক দেয় না ।
হাসপাতালে যাওয়ার দরকার পড়লে বা কোনও কোরোনা রোগীকে দেখতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে সার্জিকাল মাস্ক পরাটা বাধ্যতামূলক । এই সার্জিক্যাল মাস্কগুলি ত্রিস্তরীয় হয় । বাইরের স্তর আমাদের জলীয় বাষ্প এবং ধূলিকণা থেকে রক্ষা করে । মাঝের স্তর বাতাসকে বিশুদ্ধ করে এবং ভাইরাসের প্রবেশ রুখে দেয় । সবচেয়ে ভিতরের স্তর অর্থাৎ তৃতীয় স্তর ঘাম, বাষ্প শুষে নিয়ে আমাদের স্বচ্ছন্দ রাখে ।
অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষ বেশিরভাগ সময় মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলে । এটা মোটেও ভালো লক্ষণ নয় । কোনও পরিস্থিতিতেই মাস্কের সামনের অংশটিকে স্পর্শ করা উচিত নয় । আমাদের হাতের তালুতে প্রচুর জীবাণু থাকে যেমন ভাইরাস এবং ব্যাকটিরিয়া । মাস্ক স্পর্শ করলে এগুলো মাস্কের গায়ে আটকে থাকবে । হাতের তালু দিয়ে কাউকে স্পর্শ করলে বা চোখ—নাক ঘষলে ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে । হাতে ধরা সম্ভব, এমন সব কিছুকেই ভাইরাস সংক্রমিত করতে পারে । তাই এই ধরনের কাজ করলে ভালোর থেকে বেশি খারাপই হবে ।
কাপড়ের মাস্ক প্রতিদিন সাবান দিয়ে ধোয়া উচিত । তা ছাড়া জলে ব্লিচিং পাউডার গুলে তাতে এই মাস্কগুলি ভিজিয়ে রেখে পরদিন রোদে শুকিয়ে নেওয়াও যেতে পারে ।