প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর চিনের সঙ্গে উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ৷ ১৭তম কর্মপা ওগিয়েন ত্রিনলে দোর্জির ভারতে ফিরে আসার ব্যবস্থা সহজ করার জন্য মোদিকে অনুরোধ জানিয়ে তিনি এই চিঠি লিখেছেন ৷ ৩৫ বছর বয়সি কর্মপা তিব্বতি বৌদ্ধদের কর্মা কাগ্যয়ু স্কুলের প্রধান ৷ তিনি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কারণ দেখিয়ে ২০১৭ সাল থেকে অ্যামেরিকায় রয়েছেন ৷ অতীতে তাঁর সন্দেহজনক উদ্দেশ্যের জন্যও তাঁকে ভারতীয় আধিকারিকদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল ৷
গালওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চিনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ও তার জেরে ২০ জন সেনা জওয়ান শহিদ হন ৷ তারপর থেকে সীমান্তে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তুতি বৃদ্ধি করেছে ভারত ৷ চিনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য হইচই শুরু হয়েছে ৷ কৌশল পরিবর্তন করে হংকংয়ের বিষয়েও ভারত সরব হতে শুরু করেছে ৷ তিব্বত ও তাইওয়ানকে আরও ছাড় দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে ৷ চিঠিটি ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছেন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী প্রেম সিং তামাং ৷ তাই চিঠি দেওয়ার সময়কালও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ৷ চিঠিতে তামাং লিখেছেন, ‘‘আপনি জানেন যে সিকিমের ভক্তরা HH ১৭ তম কর্মপা ওগিয়েন ত্রিনলে দোর্জিকে শারীরিক ভাবে দর্শন করতে চান । সিকিমবাসী তাঁর সফরের প্রত্যাশায় রয়েছেন৷’’
২০০০ সালে তিব্বত থেকে নাটকীয়ভাবে পালিয়ে আসার পর ১৭তম কর্মপাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির সময়ে ৷ বেশি কিছু সময় ধরে তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা ছিল ৷ কারণ, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি তাঁকে ‘চিনের চর’ বলেই সন্দেহ করত ৷ পরে অবশ্য সিকিম-সহ সারা দেশেই কর্মপা লামাকে স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ৷ চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী তামাং লিখেছেন, ‘‘সৌভাগ্যবশত তাঁর এই পবিত্র ঘোরাফেরার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ২০১৮ সালে তুলে নেওয়া হয় ৷ তবে জন সাধারণের যুক্তিসঙ্গত দাবি মেনে রুমটেক মনাস্ট্রিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ৷ আপনার মতো বড় নেতার নেতৃত্বে চলা বর্তমান এই সরকার ২০১৮ সালে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় আমি এবং আমার সিকিমের সহ বাসিন্দারা সকলেই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ ৷ ভক্তরা এখন তাঁদের পবিত্র আত্মিক আকাঙ্ক্ষাগুলির সঙ্গে সংগতি রেখে সিকিমে তাঁর পবিত্র সফর আরও আগে করানোর জন্য আমার সরকারের কাছে আবেদন করছেন ৷’’
দলাই লামা ও চিন, উভয়েই ওগিয়েন ত্রিনলে দোর্জিকে ১৭তম কর্মপা বলেই মেনে নিয়েছে ৷ ভারত দীর্ঘদিন ধরে তাঁর বিরোধী থায়ে ত্রিনলে দোর্জিকে মান্যতা দিত ৷ কিন্তু দলাই লামা পরবর্তী পরিস্থিতিতে কর্মপা লামার তিব্বতিদের উপর প্রভাব সবচেয়ে বেশি ৷ গত তিন বছর ধরে কর্মপা দলাই লামাকে সমর্থন করার ইঙ্গিত দিচ্ছে ৷ আর তিব্বতের জন্য মধ্য তিব্বতি প্রশাসন ও চিনা বিদ্রোহীদের সঙ্গে তিনি এক মঞ্চে থাকার ইঙ্গিতও দিয়েছেন ৷ ধর্মশালা থেকে পরিচালিত নির্বাসিত তিব্বত সরকার প্রকাশ্যে ১৭তম কর্মপা লামার উপর নিজেদের আস্থার কথা জানিয়েছে ৷ তাঁর ফেরার শর্ত নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে কর্মপা লামা ও নয়াদিল্লির মধ্যে টানাপোড়েন চলছে ৷ ধর্মশালায় তিব্বতি বৌদ্ধদের ধর্মীয় সম্মেলনে যোগদানের জন্য ওই বছর নভেম্বরে তাঁর ফেরার কথা ছিল ৷ ওই সম্মেলন পিছিয়ে দেওয়া হয় নিনগাম্পা ঐতিহ্যের সপ্তম প্রধান কথোক গেটসে রিনপোচের মৃত্যুর কারণে ৷ সেই সময় থেকেই এই নিয়ে আলোচনা চলছে ৷ ভারতীয় আধিকারিকরা বলছেন যে কর্মপা এখানে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় নথি-সহ আবেদন করেননি ৷ আর কর্মপা যাঁর কাছে এখন ডোমিনিক্যান নাগরিকত্ব রয়েছে, তিনি এই বিষয়টির বিরোধিতা করছেন ৷
অমিতাভ মাথুর, RAW-এর প্রাক্তন বিশেষ সচিব, যিনি ভারত সরকারের জন্য তিব্বত বিষয়ে পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন ৷ তিনি সম্প্রতি একটি ওয়েবিনারে বক্তব্য রাখার সময় বলেন, ‘‘চিন তাদের দলাই লামাকে প্রতিষ্ঠিত করার অপেক্ষায় রয়েছে ৷ ভারতের দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলা উচিত যে এটা একমাত্র দালাই লামার পছন্দ । যা নির্বাসনে থাকা তিব্বতিদের আশ্বস্ত করবে ৷ ভারতের উচিত অবিলম্বে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে, তিনি কী চাইছেন, সেটা জেনে নেওয়া ৷” ভারত ও চিনের মধ্যে সম্পর্কের প্রেক্ষিতে তিব্বত নিয়ে আরও আলোচনার সময় তিনি ‘কর্মপা লামাকে ফিরিয়ে আনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি এবং ভারতে স্বাধীন ভাবে থাকা ব্যবস্থা করার’ উপরে সওয়াল করেছেন ৷ কারণ, তাঁর মতে, ‘‘কর্মপা লামাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন দলাই লামা ৷ আর সমস্ত সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে তিনিই এখন সকল তিব্বতিদের কাছে সম্মানিত হচ্ছেন ৷’’
এদিকে এটা জানা গিয়েছে যে তামাংয়ের মন্ত্রিসভার সদস্য সোনাম লামা ১৭তম কর্মপা লামাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন ৷ তাঁকে সিকিমে আসার এবং ভক্তদের আশীর্বাদ করার অনুরোধ করেছেন ৷