সারা বিশ্বে কর্তৃত্ব বজায় রাখার যে লড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন একে অপরের বিরুদ্ধে করছে, তার প্রাথমিক লক্ষ্য পৃথিবী থেকে সরে গিয়ে চাঁদ ও মঙ্গলে গিয়ে পড়েছে । বাকি বিশ্বকে অনিশ্চিয়তার মধ্যে ফেলে দিয়ে দুই দেশই মহাকাশের সম্পদ খোঁজার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক বরাদ্দ বৃদ্ধি করার কথা ঘোষণা করেছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চিনের তুলনায় শিশু সদৃশ্য হলেও ভারতও মঙ্গল নিয়ে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে । গত এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কার্যনির্বাহী নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং চিনারাও মহাকাশ নিয়ে তাঁদের লক্ষ্য স্পষ্ট করে দিয়েছে । এর ফলে এটাও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে ভারতকে তাদের মহাকাশ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডকে সংগঠিত করার জন্য গতি বৃদ্ধি করতে হবে । চাঁদের সম্পদ নিয়ে তাদের দাবির বিরোধিতা যদি কোনও দেশ করে, তাহলে সেই দেশের বিরোধিতা করা হবে বলে সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । প্রথম জায়গা হিসেবে কোনও দেশ কেন মহাকাশে বাণিজ্যিক খননের বিরোধিতা করবে ? এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে 1979 সালের চাঁদ চুক্তিতে যা সাক্ষর করা হয়েছিল রাষ্ট্র সংঘের সনদ হিসেবে । ওই চুক্তিতে ১৮ টি দেশ সাক্ষর করেছিল । তার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান এবং ফ্রান্সও রয়েছে । এই চুক্তিকে অনুমোদন করেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র । ভারত যদিও সরকারি ভাবে চুক্তিতে সাক্ষর করেছিল । কিন্তু তারা এর লক্ষ্যগুলিকে অনুমোদন করেনি । কিছু সময় আগে ভারত এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কথাও বলেছিল । চাঁদ চুক্তি চাঁদে বিভিন্ন দেশের ও অন্যান্য মহাকাশ সংক্রান্ত সংস্থার কার্যকলাপের উপর নজরদারি করে । এই সংস্থাগুলি একেবারে শান্তিমূলক প্রক্রিয়ার জন্য ব্যবহার করতে হয় । এর লক্ষ্যগুলি মেনে চললে চাঁদ থেকে যে সম্পদ আনা হবে তা সমগ্র মানবতার কাজে ব্যবহার করতে হবে । যে সমস্ত দেশ এই চুক্তি মেনে নেয়নি, তাদের এটা মেনে চলার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই । সেই কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী নির্দেশে বলা হয়েছে যে মহাকাশের সম্পদ বের করে আনতে ও তার ব্যবহার ঘিরে যে অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে, সেটার নিষ্পত্তি হওয়া দরকার । এই নির্দেশ থেকে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশকে ‘পৃথিবীতে থাকা সম্পদ’ এর সঙ্গে এক করে দেখে না । 1979 সালের চুক্তিকে একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা বলে ব্যাখ্যা করেছেন ট্রাম্প । একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সন্দেহ যে এই চুক্তির অনৈতিক সুবিধা নিয়ে চিন বাধা তৈরি করতে পারে ।
মহাকাশ নিয়ে চিন তাদের নিজস্ব লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে । সম্প্রতি তারা দীর্ঘ মার্চ-৫বি উড়ানের সাহায্যে প্রথমবার ফ্লেক্সিবল ইনফ্ল্যাটবল কারগো রি এন্ট্রি ভেইকল ( RICRV ) কক্ষপথে লঞ্চ করেছে । এর আগে চিন চাঁদকে কেন্দ্র করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছিল । মহাকাশে পরিষেবা, শিল্প উৎপাদন ও বাণিজ্যিক মহাকাশ খননের মাধ্যমে তাদের অর্থনীতিতে 10 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আমদানি করার জন্যই তারা এই প্রস্তাব দিয়েছিল । মহাকাশ নিয়ে চিনের এই অতি উৎসাহী লক্ষ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পালটা আর্টেমিস প্রোগ্রাম নিয়ে আসে । যাতে চাঁদে দীর্ঘমেয়াদী উপস্থিতির জন্য একটা বড় লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল । এই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি বিশদে বিবেচনা করে দেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার । এটা উল্লেখযোগ্য যে ভারতও মঙ্গলায়ন, চন্দ্রায়ন ও গগনায়নের মতো স্পেশ মিশন সফল ভাবে সংগঠিত করতে পেরেছে । মহাকাশে চিনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য প্রয়োজন ভারতের ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যেম একটি বড়সড় স্পেস মিশন লঞ্চ করতে চলেছে । এই স্পেস লঞ্চ সিস্টেমের জন্য ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ( NASA ) বেশ কিছু শক্তিশালী রকেট তৈরি করছে । স্পেসএক্স, আমাজন, বোয়িং, লকহেড মার্টিনের মতো বেসরকারি সংস্থা রকেট ও অন্যান্য বাহন তৈরি করছে । স্পেসএক্স ইতিমধ্যেই বেশ কিছু অপারেশনাল মিশন লঞ্চ করে ফেলেছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি সংস্থাগুলি সরকারি মহাকাশ কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ, মহাকাশ স্টেশন তৈরি এবং মহাকাশচারী ও অন্যান্য সরঞ্জাম পৃথিবীতে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে । স্বাভাবিক ভাবে চিন এই কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে । যেদিন আর্টেমিস প্রোগ্রামের ঘোষণা করা হয়েছিল, সেদিনই চিন FIRCV লঞ্চ করে । 2050 সালের মধ্যে চিন চাঁদে SEZ তৈরির করার পরিকল্পনা করেছে । চিনের মহাকাশ সংক্রান্তের কাজের প্রধান ঠিকাদার হল চায়না অ্যারোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনলজি কর্পোরেশন ( CASC ) ।
মহাকাশ সম্পর্কে যে সমস্ত দেশের আগ্রহ রয়েছে, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন, চিন, ভারত, জাপান ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহী মহাকাশ সংক্রান্ত কর্মসূচি লঞ্চ করেছে । গ্রহাণু খননের জন্য জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পেসশিপও মোতায়েন করেছে । ভারতের মহাকাশ সফর শুরু হয়েছে 1999 সাল থেকে । বর্তমান সরকার চাঁদে মহাকাশচারী পাঠাতে ও সেখানকার সম্পদ খনন করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করছে । চন্দ্রায়নের পর চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামার একটি স্থান খোঁজার কাজ চালাচ্ছে ISRO । গগনায়নের এমন পরিকল্পনা করা হয়েছে যে তা মহাকাশচারীদের কক্ষপথে নিয়ে যাবে আবার সুরক্ষিত ভাবে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে । ভারত 2030 সালের মধ্যে নিজেদের স্পেস স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা করছে । যে 18 টি দেশ চাঁদ চুক্তিতে সাক্ষর করেছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র ভারত ও ফ্রান্সই স্পেস মিশন করার সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে । আর্টেমিস প্রোগ্রামে যোগদানের বিষয়ে ফ্রান্স ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এগিয়ে চলেছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই যাত্রা শুরু করতে চাইছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা । ভারতের মহাকাশ বাহন বেশ সফল হয়েছে । এর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও জাপানকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে । পরবর্তী মহাশক্তিধর হয়ে ওঠার জন্য ভারতকে অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্টেমিস প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে । পাশাপাশি স্বাধীনভাবে নিজেদের সুযোগ গুলোর উপরও কাজ করতে হবে । আবার একই সঙ্গে ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মহাকাশ যুদ্ধের বিষয়েও অবগত থাকতে হবে । চিনের বিরুদ্ধে শত্রুতার ঘোষণা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কখনওই শব্দের অভাব হয় না । সাম্প্রতিক কালে ওই দেশ একটি মহকাশ সেনাবাহিনী তৈরি করছে চিনকে তাদের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরে নিয়ে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে দাবি করা হয় যে চিন ও রাশিয়া মহাকাশে ব্যবহার করা যায় এমন অস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে । মহাকাশে লড়াই করার জন্য চিনের অস্ত্রের বিষয়টি প্রকাশ্যে আনাই ছিল ওই রিপোর্টের উদ্দেশ্য । 2019 সালের মার্চ মাসে ভারতও উপগ্রহ বিরোধী ক্ষেপনাস্ত্রের পরীক্ষা করেছিল । সার্বিক ভাবে ভারতকে স্বীকার করতে হবে যে মহাকাশ এখন গুরুত্বপূর্ণ সেনা ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে । আর সেখানে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব অর্জনের পরিকল্পনা করতে হবে ।