বাজেট অধিবেশন থেকে 174 দিনের দীর্ঘ ব্যবধানের পর 14 সেপ্টেম্বর থেকে হতে চলেছে সংসদের বাদল অধিবেশন । এমন একটা ঘটনা যা গত কয়েক দশকের মধ্যে এভাবে কোনও দিন হয়নি। বাদল অধিবেশ, আয়োজিত হচ্ছে সংবিধানের সেই নির্দেশকে মাথায় রেখে, যে সংসদের দুটি অধিবেশনের মধ্যে 6 মাসের বেশি ব্যবধান রাখা যাবে না। এই অধিবেশনকে এবার "কোভিড অধিবেশন" বলাই ভাল। এটা সেই সময় যখন কোভিড প্যান্ডেমিক দাপটে দেশে আক্রান্ত 41 লক্ষ ও মৃত্যু 70 হাজারেরও বেশি। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে জরুরি অবস্থা কেন্দ্র জারি করেছে, তার গভীর প্রভাব পড়েছে সংসদেও।
এই অধিবেশন, যা 14 সেপ্টেম্বর থেকে 1 অক্টোবর পর্যন্ত একটানা চলবে, তা দুটি ভাগে করা হবে – সকালে লোকসভা ও বিকেলে রাজ্যসভা। সর্বশেষ নিয়ম অনুযায়ী, যেহেতু প্রতিটি ভাগে চারঘণ্টায় নামিয়ে আনা হয়েছে, তাই কোনও প্রশ্নত্তরপর্ব থাকবে না, জ়িরো আওয়ার আধঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, এবং প্রাইভেট মেম্বার্স বিলগুলি আনার অনুমতি দেওয়া হবে না। সীমান্তে চিনের অনুপ্রবেশ, দেশে করোনায় মৃত্যু, মাইনাস 23 শতাংশে বৃদ্ধির হার, থমকে যাওয়া কর্মসংস্থান এবং অপ্রত্যাশিতভাবে শিল্পের ধীরগতি আসন্ন বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে প্রশ্ন করার, জনস্বার্থের বৃহত্তর ইস্যুগুলোর আলোচনার এবং সম্ভাব্য সমাধানে পৌঁছবার সঠিক মঞ্চ হতে পারে সংসদের প্রশ্নত্তরপর্ব। এটা বাতিল হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্র বলেছে যে তারা "আন-স্টার্ড" প্রশ্নগুলোর লিখিত উত্তর দেবে – কিন্তু তারা মৌখিক উত্তরের বিকল্প নয়। যেখানে গণতন্ত্রের সারমর্ম হল দায়বদ্ধতা, সেখানে প্রশ্নোত্তরপর্ব বাতিল করার কোনও মানে হয় না। যদিও ভারত-চিন ও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় কোয়েশ্চেন আওয়ার বাতিল করার নজির রয়েছে, কিন্তু বর্তমান সঙ্কট সেগুলোর থেকে আলাদা। সঙ্কটের সময় পরিণত প্রশ্নোত্তর পর্ব হচ্ছে সংসদের সম্মিলিত জ্ঞানের সঠিক পরশপাথর।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ স্যার উইলিয়াম আইভর জেনিংসের কথা এখানে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি যে সংসদের কাজ শাসন করা নয়, বরং বিতর্ক, আলোচনার মাধ্যমে উন্নততর সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। আদর্শ গণতন্ত্র হল সেটাই, যা শাসক সরকারকে সঠিক দিকে চালিত করতে বিরোধীদের সমালোচনার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। 1957 সালে প্রশ্নোত্তর পর্বে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারিকে করা বিহারের সাংসদ রাম সুভাগ সিংহের প্রশ্ন থেকে স্বাধীন ভারতের প্রথম কেলেঙ্কারি সামনে এসেছিল। প্রতিনিধি সভার সদস্যদের পবিত্র কর্তব্য হল জনগণের তরফে সরকারকে তীক্ষ্ম প্রশ্ন করা, যাতে সরকার আইনের প্রতি দায়বদ্ধ হয়। এর লক্ষ্যে 1961 সাল থেকে প্রতি বুধবার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর জন্য কোয়েশ্চেন আওয়ারে আধঘণ্টা সময় বরাদ্দ করা হয়েছে, যাতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সদস্যদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন। সেখানে সংসদ বছকে অন্তত 160 দিনের জন্য মিলিত হয়, এবং বিরোধীদের কাছে প্রতি অধিবেশনে অ্যাজেন্ডা নির্দিষ্ট করার জন্য 20 দিন সময় থাকে, যা গণতন্ত্রকেই উজ্জীবিত করে। যদিও লোকসভার সচিবালয় নিয়েই ঘোষণা করে যে সংসদে প্রশ্নে প্রশ্ন করা সদস্যদের অধিকার, কিন্তু লোকসভা অধিবেশনের প্রশ্নোত্তর পর্বের নির্ধারিত সময়ের মাত্র 67 শতাংশই সঠিকভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। রাজ্যসভা 2009 থেকে 2019-এর মধ্যে প্রশ্নোত্তরের সময়ের মাত্র 41 শতাংশই ব্যবহার করতে পেরেছে। যে দলগুলো কোয়েশ্চেন আওয়ার না থাকার অভিযোগ তুলছে, তারা আত্মসমীক্ষা করে দেখুক, যে অতীতে তারা কীভাবে মূল্যবান সময় নষ্ট করেছে। মোদি, যিনি গত বছর "সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস" (সবার সহযোগিতার জন্য কাজ করা, সবার উন্নতি, সবার ভরসা)-এর উল্লেখ করেছেন এক নতুন ভারতকে তুলে ধরতে, তাঁরও উচিত সংসদের অধিবেশনের মূল ভাবনাকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া।