1977 সালে ভারত সরকার জাতীয় পুলিশ কমিশন প্রতিষ্ঠা করে পুলিশি ব্যবস্থায় জরুরি সংস্কার আনার উদ্দেশ্যে । 1979-81 সালের মধ্যে কমিশন এখনও পর্যন্ত আটটি রিপোর্ট তৈরি করেছে । এর মধ্যে অন্যতম হল মডেল পুলিশ আইন, যা ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে । কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, দেশের আইনকানুন ব্যবস্থা এবং নাগরিক সমাজের প্রতি পুলিশের দায়বন্ধ থাকা প্রয়োজন । কিন্তু এতো বছর কেটে গেলেও পুলিশবাহিনীর মধ্যে আজও এই নির্দিষ্ট উপলব্ধির অভাব পরিলক্ষিত হয় । যে পুলিশবাহিনীর উপর সমাজের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে, তারাই কি না গণতন্ত্রের গরিমা খর্ব করতে উঠে পড়ে লেগেছে । এর আগে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল যে, পুলিশবাহিনীর মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও অপরাধপ্রবণ মানসিকতার প্রতিফলন দেখে তারা হতবাক । সম্প্রতি দেশের রাজধানী শহর দিল্লিতে যে ঘটনা ঘটেছে, তা ফের প্রমাণ করে দিয়েছে যে, পুলিশবাহিনীর ক্রম অধঃপতন সম্পর্কে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যা বলেছে, তা কতখানি সত্য । গতমাসে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (CAA) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন চলাকালীন যে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছিল, তার থেকে বাঁচতে চেয়ে বহু অসহায় নাগরিক পুলিশকে ফোন করে সাহায্য চান । তাঁদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়ে অবিলম্বে পুলিশি পদক্ষেপ দাবি করেন । কিন্তু এই ধরনের অজস্র ফোন পেয়েও পুলিশ যে অবহেলামিশ্রিত নির্বিকার প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল, যে "পরিস্থিতি এখনও ঠিক আছে । উলটে যাঁরা সাহায্য চাইছেন, তাঁরা আদপে ভাগ্যবান যে সমাজবিরোধীদের হাতে পড়েও এখনও তাঁরা ঝলসে যাননি"—এ কথাই ফের প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বর্তমানে দেশের পুলিশবাহিনী দুর্নীতিতে কতখানি নিমজ্জিত । দায়িত্ব পালনের মুহূর্তে তাঁরা কতটা অবহেলামূলক মানসিকতার অধিকারী তার পরিচয় দেন । CAA-র বিরোধিতায় 2020 সালের 29 ফেব্রুয়ারি থেকে দিল্লির উত্তর-পূর্বাংশে যে হিংসা এবং অশান্তি শুরু হয়েছিল, তার জেরে টানা তিন দিন দিল্লির ওই এলাকার বাসিন্দাদের কাছে পরিস্থিতি একেবারে নরক-সম হয়ে পড়েছিল । মৌজাবাদ, জাফরাবাদ, চাঁদবাগ, যমুনা বিহারের মতো এলাকা এই হিংসায় জড়িয়ে পড়ে, যার ফলে এক জন পুলিশ কনস্টেবল, গোয়েন্দা বিউরোর এক জন অফিসার-সহ অন্তত 53 জনের মৃত্যু হয় । সঙ্গে প্রচুর সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতিও হয় ।
সমাজবিরোধীরা যে তাদের ঘরবাড়িতে আক্রমণ চালিয়েছে আর এই সংকটের মুহূর্তে কেউ যে তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসছে না—এই মর্মে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে প্রচুর ফোন পেয়েছিল পুলিশ । পরে সেই বাসিন্দারাই তাদের হতাশাজনক অভিজ্ঞতার কথা জানান যে কীভাবে পুলিশের অসহানুভূতিশীল মনোভাবের জন্য সেই হিংসায় নিজেদের প্রিয়জনদের হারিয়েছেন তাঁরা । একইসঙ্গে তাঁরা আরও অভিযোগ করেন যে, হিংসার সেই মুহূর্তে যখন ধর্মের নামে দুষ্কৃতীরা রড এবং ছুরি নিয়ে নিরীহ সাধারণ বাসিন্দাদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল তখন সেই এলাকার নজরদারি এবং সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ ছিল শুধু দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে । শুধু এইটুকু তথ্য যে ওই তিনদিনে অন্তত 500 বুলেট ছোড়া হয়েছিল । চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কীভাবে ধ্বংসাত্মক অস্ত্রশস্ত্র যেমন ছুরি, পাথর, বুলেট, অ্যাসিড, জ্বালানি প্রভৃতি আগেভাগে জোগাড় করে রেখে খুনি, উন্মত্ত দুষ্কৃতীরা সাম্প্রদায়িক হিংসা সৃষ্টির জন্য প্রথম থেকেই প্রস্তুত ছিল । এইরকম সংকটের মুহূর্তে যে পুলিশের নিরীহ সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার গুরু দায়িত্ব পালন করার কথা, তারাই সেদিন সব দায় এড়িয়ে গিয়েছিল এই যুক্তি দেখিয়ে যে, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা প্রত্যেক নাগরিকের নিজস্ব দায়িত্ব । এবার পুলিশই যদি এহেন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মনে এই প্রশ্ন জাগতে বাধ্য যে, তাহলে পুলিশের পরনে খাকি উর্দি এবং হাতে লাঠি থাকার প্রয়োজন কী? কিছু কিছু নেতারা তো এই মর্মেও বয়ান দিয়েছেন যে, সেই সময় উত্তর-পূর্ব দিল্লির যে পরিস্থিতি ছিল তা দেখে কোনও ‘হরর’ ছবির রক্তাক্ত, গা ঘিনঘিন করা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল । আর এই বয়ান ঘিরেই প্রশ্ন উঠেছে যে, তাহলে পুলিশবাহিনীকে শ্রদ্ধা-সম্মান জানানোর প্রয়োজন কী ?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতে, বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক শক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে দিল্লির এই হিংসা ছড়িয়েছে । অবশ্যই দিল্লির এই দুঃস্বপ্নসম ঘটনার নেপথ্যে যে একটি পূর্বপরিকল্পিত, দূরভিসন্ধি কাজ করেছিল তা বিশ্বাস করার একাধিক কারণ রয়েছে । কিন্তু তা বলে এই ঘটনায় সেই পুলিশবাহিনীর গাফিলতি এবং নিষ্ক্রিয়তা কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না, যাঁরা সেদিন রক্ষাকর্তার বদলে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন । হিংসা থামার পর দিল্লি রাস্তাজুড়ে পড়ে ছিল পোড়া গাড়ি, বই, ব্যাগ । হিংসার সময় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্কুলগুলিও । গোটা ঘটনায় যেভাবে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন একেবারে তছনছ হয়ে পড়েছিল, তাতে পুলিশবাহিনীর হিংসা দমনে ব্যর্থতার অকাট্য প্রমাণ মিলেছিল । ঠিক যেমন সুপ্রিম কোর্ট পুলিশবাহিনীর ভূমিকা সর্ম্পকে প্রশ্ন করেছিল যে, পুলিশ হিসেবে নিজেদের প্রাথমিক দায়িত্ব পালনের জন্যেও কি তারা কোনও বিশেষ অনুমতির অপেক্ষা করছিল ? হিংসার ঘটনায় পুলিশের একপ্রকার নির্বিকার অবস্থান তাদের স্বনিয়ন্ত্রণ এবং পেশাদারিত্বের অভাবকেই তুলে ধরে । সাধারণ মানুষের দুর্দশায় সাড়া দিয়ে, পাশে দাঁড়াতে তারা যে আদৌ ইচ্ছুক নয় সেই মনোভাব ইতিমধ্যেই স্পষ্ট ।
দিল্লির এই সাম্প্রতিক হিংসার প্রভাব শুধুমাত্র স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনেই পড়েনি । বরং তার রেশ গোটা দেশের পাশাপাশি বিদেশেও ছড়িয়েছে । সোশাল মিডিয়ায় বেশ কিছু ভিডিয়ো ও বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দেখানো হয়েছে যে এই হিংসার ঘটনা আসলে পরিকল্পিত । আর এসব দেখেই গোটা বিশ্ব ভবিষ্যতে ভারতের এই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ছবি দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে । পুলিশি নিস্ক্রিয়তার এই ছবি বর্তমানে কারও অদেখা নয় । সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, 23 বছর বয়সি এক যুবক কাঁদতে কাঁদতে জাতীয় সংগীত গাইছেন । আর তাঁকে হুমকি দিচ্ছে একদল পুলিশ । 36 ঘণ্টা পর সেই যুবক মুক্তি পেলেও পুলিশি হেপাজতে তার উপর যে থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করা হয়েছিল, তারই জেরে পরে যুবকের মৃত্যু হয় বলে দাবি করেন তাঁর মা । খাকি উর্দি পরা কিছু মানুষ দিল্লি সরকারের উদ্যোগে লাগানো CCTV ক্যামেরা ভাঙছেন, এমন ভিডিয়োও প্রকাশ্যে এসেছে । যদিও পুলিশ এখন দাবি করছে যে দিল্লি হিংসার ঘটনায় সাড়ে ছ’শোর বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে । 1820 জনকে আটক করা হয়েছে এবং অস্ত্র আইনের আওতায় চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে । তবুও এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর মেলেনি যে, কেন এই পুলিশই সেই হিংসার সময় কার্যত অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কোনও চেষ্টাই করেনি ? আইন অনুযায়ী, দেশের কোথাও যখন সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সেখানে অবিলম্বে কার্ফু জারি করা উচিত । 144 ধারা বলবৎ করা উচিত এবং সন্দেহভাজন দুষ্কৃতীদের হেপাজতে নেওয়া উচিত । যদিও 23 ফেব্রুয়ারির রাতে যেদিন হিংসা শুরু হয় এবং দ্রুত তা বড় আকার ধারণ করে, তারপরই পুলিশের সংবেদনশীল এলাকায় 144 ধারা জারি করার কথা মনে আসে । 25 ফেব্রুয়ারি রাতে উত্তর-পূর্ব দিল্লির চারটি অংশে কার্ফু জারি করা হয়েছিল । আইন অনুযায়ী, ধর্মীয় অপরাধজনিত ঘটনার তদন্ত অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে হওয়া উচিত । স্বচ্ছ ও অবাধ তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজনে বিশেষ তদন্তকারী দল (SIT) গঠন করাও যেতে পারে । দিল্লির হিংসার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার তদন্তভার দু’জন বিতর্কিত পুলিশ কমিশনার, রাজেশ দেব এবং জয় তিরকের হাতে তুলে দেওয়াই বুঝিয়ে দেয়, কীভাবে পুলিশ প্রশাসনের ভিতরেই সাম্প্রদায়িক অসাম্যের বীজ তিলে তিলে বাড়ছে ।
যে দেশের চারদিকে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা বলয় রয়েছে, সেই দেশের পুলিশবাহিনীই রাজনৈতিক মদতপুষ্ট দুষ্ট নীতিবোধের ছায়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি । এই সত্য নিতান্তই লজ্জাজনক যে যাঁদের হাতে নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষার ভার, যাঁদের উপর নাগরিকরা ভরসা করেন, তাঁরাই রাজনীতিবিদদের দুর্বিনীত ভাবধারায় ভেসে গিয়ে নিজেদের নীতিবোধ বিসর্জন দিচ্ছেন । অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থ হস্তগত করছেন । দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা এর সাম্প্রতিকতম নজির । যেখানে বঞ্চিত মানুষদের জীবন, তাঁদের সামাজিক এবং ধর্মীয় বিশ্বাস এবং বিভিন্ন জাতিধর্মের মধ্যে থাকা ধ্যানধারণাকে হাতিয়ার করে পুলিশবাহিনী রাজনীতিবিদদের দুরভিসন্ধি পূরণে সচেষ্ট হয়েছিল । যদিও এই ধরনের ঘটনায় অনেক পরে তদন্তের ডাক দেওয়া হয় কিংবা হিংসাপীড়িতদের জন্য ন্যূনতম আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়, তবু এতে কোনও গ্যারান্টি নেই যে এর ফলে যে নিরীহ মানুষদের মূল্যবান জীবন চিরতরে চলে গিয়েছে বা যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের জীবনে আনন্দ ফিরবে । দিল্লিতে যে অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে, তা যাতে দেশের আর কোথাও না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে পুলিশকে তাদের রাজনৈতিক মদতপুষ্ট হওয়ার ছায়া থেকে বেরোতে হবে । আর এর শুরুটা করতে হবে পুলিশের ভাবমূর্তি উদ্ধার করে, অর্থাৎ পুলিশবাহিনীর ভিতর থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশকর্মীদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ।
জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস বিউরো (2016) এবং পরিসংখ্যান অনুযায়ী মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অন্তত 209 জন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে । এর মধ্যে 50 জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট ফাইল করা হয়েছে । কিন্তু কেউ দোষী সাব্যস্ত হননি । যদিও বেশ কিছু কমিটি যেমন ল’কমিশন, রেবাইরো কমিটি, পদ্মনাভ্য কমিটি, জাস্টিস মালিমত কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছেন যার মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর মানোন্নয়ন সম্ভব । কিন্তু এর কোনও কিছুতেই কোনও লাভ হয়নি । কারণ পুলিশ বাহিনীর অন্দরেই এমন কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার আছেন, যাঁরা দুর্নীতিকে হাতিয়ার করেই এখনও ক্ষমতায় রয়েছেন আর তা-ও আবার বহাল তবিয়তে । তাই পরিস্থিতি অনুধাবন করে মনে হচ্ছে, যতক্ষণ না ভারতের পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক ছায়া থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং তাদের নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার দেওয়া হবে, যেমনটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেন বা আমেরিকার মতো দেশে হয়—ততক্ষণ এ দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলির নিরাপত্তারক্ষা কখনওই সম্ভব নয় ।