পরিশোধিত পাম তেল ও পামোলিনের আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিদেশনীতির নতুন অস্ত্র হতে চলেছে। বিদেশনীতির সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবসাকে ব্যবহার করে নয়াদিল্লির এই ধরনের ‘কিছুর বদলে কিছু’-র নীতি নেওয়া এই প্রথম।
স্বকীয় শৈলীতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মহাথির বিন মহম্মদকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতি, বিশেষ করে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ নিয়ে তাঁর মতামতকে ভাল ভাবে নেওয়া হয়নি এবং এর ফলে মালয়েশিয়াকে বড় মূল্য চোকাতে হবে। ইন্দোনেশিয়ার পরে মালয়েশিয়াই হল বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাম তেল রপ্তানিকারক দেশ।
ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে এ দেশ থেকে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করার সুযোগ বন্ধ হল মালয়েশিয়ার। তারাই এত দিন ছিল ভারতে পাম তেল রপ্তানিকারক সবচেয়ে বড় দেশ। মোদির এই সিদ্ধান্তের ফলে এখন এ দেশের শোধনাগারগুলিতে অপরিশোধিত পাম তেলের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ হবে ইন্দোনেশিয়া।
কয়েক বছর আগে পর্যন্ত এ দেশে সবচেয়ে বেশি পাম তেল রপ্তানি করত ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু বছর খানেক আগে পরিশোধিত পাম তেলে আমদানি শুল্ক কমানোর ফলে মালয়েশিয়ার বিশেষ সুবিধা হয়। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান দেশ হলেও ইন্দোনেশিয়া কিন্তু মালয়েশিয়ার মতো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায়নি। বরং তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞ ও সতর্ক মন্তব্য করেছে। মজার বিষয় হল, বাণিজ্য মন্ত্রকের জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে কোথাও মালয়েশিয়ার নাম নেই। কিন্তু নির্দেশটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। বিজ্ঞপ্তিতে পরিশোধিত পাম তেলকে ‘বিনামূল্য’ থেকে ‘সংরক্ষিত’-এর পর্যায়ে রাখা হয়েছে। এত দিন পর্যন্ত ভারতে মালয়েশিয়া থেকে কোনও লাইসেন্স ছাড়াই সুগন্ধী পাম তেল ও পামোলিন আমদানি করা যেত।
নরেন্দ্র মোদি কেন মহাথিরের উপর বিরক্ত?
যে দিন থেকে ক্ষমতায় এসেছেন, মালয়েশিয়ার ৯৪ বছরের প্রধানমন্ত্রী, সে দিন থেকে যেন বিশ্বের সব মুসলিমদের মুখপাত্র হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। গত বছর মোদি সরকার ৩৭০ ধারা বিলোপ করে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখকে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে কটাক্ষ করে মহাথির দাবি করেন, ভারত কাশ্মীর দখল করেছে। নয়া নাগরিকত্ব আইন (CAA) নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মহাথির।
নরেন্দ্র মোদি এই সব মন্তব্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করার পরই বিদেশ মন্ত্রক কড়া বিবৃতি দেয়। এর পর থেকেই মহাথিরকে নিয়ে বিরক্ত নরেন্দ্র মোদি। বিতর্কিত মুসলিম ধর্ম প্রচারক জাকির নায়েককে ভারতের হাতে তুলে দিতে রাজি না হওয়া এই বিরক্তি আরও বাড়িয়েছে।
মহাথিরের পূর্বসূরি নাজিব রাজাকের আমলে মোদির ‘পূর্বে তাকাও’ নীতিতে মালয়েশিয়া প্রচুর সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু সে দেশে সাধারণ নির্বাচনে জিতে ২০১৮ সালের মে মাসে পাকাতান হারাপান সরকার আসার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করে। নিজের অবস্থান পোক্ত করতে মালয়েশিয়ার বিদেশনীতিতে পরিবর্তন আনতে শুরু করেন ১৫ বছর পর ক্ষমতায় ফেরা মহাথির। মুসলিম বিশ্বে প্রাধান্য পেতে তাঁর পাকিস্তান প্রীতিতে অসন্তুষ্ট হয় নয়াদিল্লি।
দেশের পাম তেল প্রস্তুতকারক শিল্পপতিদের প্রবল চাপে এবং দেশের আর্থিক স্বার্থে মহাথির কি নরেন্দ্র মোদি চাপের কাছে নতিস্বীকার করবেন? এটা হওয়াটা বেশ কঠিন কারণ, মহাথির মনে করেন ভারতীয় মুসলিমদের সমর্থন করাটা মালয়েশিয়ার নৈতিক কর্তব্য। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার পরেও কি চুপ করে বসে থাকতে পারবে মালয়েশিয়া?
পাম তেলের ব্যবসা কমাতে পশ্চিমি দেশগুলোর প্রবল চাপে রয়েছে মহাথির সরকারের উপর। এর কারণ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো একাধিক ঘটনা। অন্য দিকে, মালয়েশিয়া থেকে পরিশোধিত পাম তেলের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার পর দেশে ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তায় নেই ভারত। বরং দেশীয় তৈল শোধনাগারগুলো খুশি সস্তার পরিশোধিত পাম তেলের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার পর তাদের ব্যবসা বাড়বে।