দিল্লি, 16 ডিসেম্বর : ফের গণধর্ষণ । ফের উত্তরপ্রদেশ । শনিবার ( 14 ডিসেম্বর) উত্তরপ্রদেশের ফতেপুরে একটি 18 বছরের মেয়েকে গণধর্ষণের পর গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা । এই প্রতিবেদনটি যখন লিখছি, তখন নির্দোষ মেয়েটি কানপুরের এক হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে । পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন আমাদের দেশে কমবেশি 100 টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে, উত্তরপ্রদেশের ঘটনাটি এর মধ্যে একটি । আরও একটু বললে, উত্তরপ্রদেশের ঘটনাটি সাত বছর আগে এমনই এক ডিসেম্বর মাসের 16 তারিখের ঠিক দু'দিন আগের ঘটনা । 2012 সালের 16 ডিসেম্বর, সাত বছর কেটে গেল দিল্লির নির্ভয়া গণধর্ষণের ।
সেই নৃশংস ঘটনায় অভিযুক্তদের চূড়ান্ত শাস্তির অপেক্ষায় নির্যাতিতার মা । দোষীদের চূড়ান্ত শাস্তি হবে, তাদের ঝোলানো হবে ফাঁসিতে ? আশা করা যায়, আগামী বুধবারের ( 18 ডিসেম্বর) মধ্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে, জানা যাবে ফাঁসি হলে কবে হবে ? কারণ, মঙ্গলবার চার অভিযুক্তদের মধ্যে একজনের রিভিউ পিটিশনের রায় শোনাবে শীর্ষ আদালত । পাশাপাশি আজ ( 16 ডিসেম্বর ) আরও একটি ঘটনা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হতে চলেছে । আজই উন্নাও গণধর্ষণের ঘটনায় রায় ঘোষণা করতে পারে সুপ্রিম কোর্ট । যে ঘটনায় জড়িত BJP-র প্রাক্তন বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার এবং তার অনুগামীরা । 2017 সালের জুন মাসে কুলদীপ এবং তার দলবল এক নাবালিকাকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ । উন্নাওয়ের ঘটনায় মূল অভিযুক্তের একটি রাজনৈতিক পরিচয় আছে । আর সে জন্যই বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে একাধিক বিতর্ক ।
প্রথমে নির্যাতিতা মেয়েটির এবং তার পরিবারের অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে স্থানীয় পুলিশ, আদালতে সাক্ষী দিতে যাওয়ার সময় গাড়ি 'দুর্ঘটনা'-র মধ্যে পড়ে নির্যাতিতা মেয়েটি, তার আইনজীবী এবং পরিবারের সদস্যরা । পাশাপাশি, গত মাসে দেশের নানা প্রান্ত ধর্ষণ এবং পুড়িয়ে দেওয়ার একাধিক ঘটনা সামনে এসেছে । এই ঘটনাগুলিই ধর্ষণের ভয়াবহতাকেই ফের একবার প্রমাণ করছে, একই সঙ্গে দাবি করছে, ধর্ষণের মতো ঘটনাকে বন্ধ করার ক্ষেত্রে কঠোর আইন এবং শাস্তির ।
ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্টও ধর্ষণের ভয়াবহতার দিকে আঙুল তুলছে । 2017 সালে 33,885টি ধর্ষণের ঘটনা সামনে এসেছে । যার অর্থ প্রতিদিন 93 জন মহিলা ধর্ষিত হচ্ছেন, যার প্রতি তিন জনের মধ্যে একটি নাবালিকা । এছাড়াও 88 হাজার মহিলা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করেছেন, যার অর্থ প্রতিদিন 240 জন করে মহিলা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন । কেবল মাত্র গত মাসেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে একাধিক ভয়ঙ্কর ধর্ষণ-খুনের ঘটনা সামনে এসেছে । এর মধ্যেই রয়েছে হায়দরাবাদ-তেলঙ্গানার মহিলা চিকিত্সককে গণধর্ষণের পর খুনের ঘটনাও । ফের একবার প্রকাশ্যে এসেছে উন্নাও । আদালতের বিচার বিচার পর্ব চলার সময়ই এক নির্যাতিতাকে পুড়িয়ে খুন করার ঘটনা ঘটেছে । আবার পটনায় 20 বছরের এক কলেজ ছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে... নৃশংসতা, অমানবিকতা, ঘৃণার এই তালিকা ক্রমবর্ধমান ।
বিচারপর্বে সামান্য সময় লাগলে সমস্যা তৈরি হচ্ছে । দাবি উঠছে দ্রুত বিচারের । বিচার ব্যবস্থার গাফিলতি হিসেবে বিষয়টি উল্লেখ করা হচ্ছে । যদি আমরা হায়দরাবাদের মহিলা চিকিত্সকের ঘটনার দিকে নজর দিই, তাহলে দেখতে পাব 'দ্রুত বিচারের' উদাহরণ । পুলিশের সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে চার অভিযুক্তের । বিচারের এই পদ্ধতি নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ বেশ কয়েকজন সাংসদ, এঁদের মধ্যে রয়েছেন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীও । কিন্তু, আইন রক্ষকদের এহেন পদক্ষেপ কি সমর্থনযোগ্য ? এখানে আইন হাতে তুলে নেওয়ার এক ভয়ঙ্কর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে । কেবল মাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে গণপিটুনির ঘটনা যে ভাবে কর্কট রোগের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে, তার থেকে এটাকে কোনও ভাবেই পৃথক করা যাবে না । পুলিশ যদি আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে । আইন
শৃঙ্খলা রক্ষা কোনওভাবেই সম্ভব হবে না । ভেঙে পড়বে বিচার প্রক্রিয়া । বিষয়টিতে অন্যভাবে নজর দেওয়া যাক । পরিসংখ্যান বলছে, গত প্রায় 50 বছরের পরিসংখ্যানের দিক নজর দিলে দেখা যাবে, প্রায় 33 মিলিয়নের বেশি মামলা এখনও ঝুলে রয়েছে । এটা কোনও ভাবেই একটা আদর্শ গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো উদাহরণ হতে পারে না । বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের কাছে এই দৃষ্টান্ত নিসন্দেহে বড় ধাক্কা । অতি শীঘ্র, দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ করা উচিত । আইন প্রণেতারা গণতন্ত্রের একটা বড়-গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন । জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে তাঁরা আইনসভায় পা রাখেন । সংবিধানের ছাতার তলায় আইন রচনার গুরু দায়িত্ব সামলান তাঁরা । এটা বাস্তব যে, ধর্ষণের ঘটনা বিশ্বজুড়ে ভয়ঙ্কর ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে । একে কোনও ভাবেই রাজনৈতিক রং বা পৌরুষত্ব দিয়ে নয়, মানবিকতার দিক থেকে বিষয়টিকে বিচার করা দরকার ।
গোটা বিশ্বের মতো ভারতেও মি-টু সমস্যা মারাত্মক আকার নিয়েছে । ঘটনাক্রম এবং নৃশংসতা প্রমাণ করে উন্নাও-সেঙ্গার যোগসূত্র ( যে ঘটনার রায় আজ শোনাতে পারে আদালত ) তুলে ধরে এর অন্ধকারময় দিকটা । ADR (Association for Democratic Reform) নামক একটি অসরকারি সংগঠন অনুসন্ধান চালিয়েছিল বিভিন্ন রাজ্যের বিধায়ক এবং সাংসদের উপর । 2009 থেকে 2019 সাল পর্যন্ত চালানো এই পরিসংখ্যানের ফলে যে তথ্য সামনে এসেছে, তা যতটা চমকে দেওয়ার মতো, ঠিক ততটাই মারাত্মক । দেখা গেছে, বিভিন্ন দুর্নীতি-অপরাধের মামলা ঝুলছে এমন সাংসদের সংখ্যা এই সময় ( 2009-2019)-এর কয়েক হাজার বৃদ্ধি পেয়েছে । নারী নির্যাতনের অভিযোগ-মামলা রয়েছে এমন ব্যক্তিরা লোকসভাকে তাঁদের আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছেন । এটা ভারতীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে মোটেই সুখকর নয় ।
গণতন্ত্রের রক্ষকরা যখন নিজেরাই এমন ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছেন, তখন পরিস্থিতি কতটা খারাপ হতে পারে তা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট । ADR -রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, নারীঘটিত মামলা রয়েছে যে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে, তাদের মধ্যে সবার উপরে রয়েছে BJP, এর পরে রয়েছে কংগ্রেস এবং তারপর YSRCP । এই সব দলের বিধায়ক-সাংসদদের বিরুদ্ধে সব থেকে বেশি মামলা ঝুলে রয়েছে ।
ভারতের মতো দেশে ধর্ষকদের বিচার বা পরিচয়ের ক্ষেত্রে কেনও রাজনীতি রক্ষা কবচ হবে ? উন্নাও-সেঙ্গার মামলা বা দিল্লি-নির্ভয়া কাণ্ড বা যে কোনও ঘটনার রায় প্রকাশের মুহূর্তে এই প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক । একই সঙ্গে প্রশ্ন, 2020 সালের প্রবেশের পরও কি ভারতে একই ছবি দেখা যাবে, আইনে কোনও বদল কি আনা হবে ?