ধুলোপড়া একটি ইলেক্ট্রিক মিটার, পেরেকের উপর ভর দিয়ে কোনওরকমে দেওয়ালে আটকে রয়েছে । এটা ডালহৌসির ম্যাসোনিক লজ । তৈরি হয়েছিল 1845 সালে । এটা সেই সময়ের কথা, যখন নেপালের রাজপরিবারের সদস্যরা, ভারতের প্রাক্তন শাসকদের সঙ্গে প্রায়ই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হতেন । পিতলের ফলকে খোদাই করা লেখা অনুযায়ী, 1910 সালের মার্চ মাসে মিটারটি লজকে দেওয়া হয়েছিল 'মহামান্য দেব শামশের জং বাহাদুর রানা জুনিয়র' - এর তরফে, নাহানের রাজকুমারের সঙ্গে রাজকুমারী মাদালসার বিবাহ উপলক্ষে । এই শৈলশহরের দক্ষিণতম প্রান্তে অবস্থিত ঝারিপানির ঢালে এখনও পড়ে রয়েছে প্রাসাদোপম অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ - জরাজীর্ণ প্রবেশপথ, খিলান, দেওয়ালের গায়ে কুঠুরি, দরজা আর জানলাগুলো । পাশ দিয়ে গেছে সার সার রেলিং, যার স্তম্ভগুলো তৈরি হয়েছিল চুনাপাথর আর মর্টার দিয়ে । ওগুলোই এখন ফেয়ারল’ন প্যালেসের অস্তিত্ত্বের একমাত্র সাক্ষী ।
কিন্তু আগে এমনটা ছিল না । অন্তত তখন তো নয়ই, যখন এটি H.H. Dev S.J.B. Rana-র বাসভবন ছিল । তিন মাস নেপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রানা, কিন্তু তারপর আকস্মিক অভ্যুত্থানে তাঁকে গদিচ্যুত করেন তাঁরই ভাই । নেপাল সীমান্তের গা ঘেঁষে অবস্থিত দার্জিলিংয়ে তাঁর অস্তিত্ব চায়নি ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি । আর তাই তাঁর সামনে দু’টো বিকল্প রাখা হয় । এক, দিল্লিতে জমি (যা পরে কনট প্লেস নামে পরিচিত হয়) অথবা পাহাড়ের কোনও জায়গা । এই দু’য়ের মধ্যে রানা দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছিলেন । পাহাড়-পর্বতে ঘেরা যে দেশ তাঁকে ছাড়তে হয়েছিল, সম্ভবত তাঁরই অনুরূপ বেছে নিয়েছিলেন তিনি । ভারতে আসার পর মুসৌরি যাওয়ার পুরোনো রাস্তা বরাবর চার মাইল দূরের একটি জায়গা বেছে নিয়েছিলেন তিনি । পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত সেই স্থানটির মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো ছিলই, সঙ্গে ছিল বড় বাগান আর টলটলে অফুরান জলের হ্রদ । আসার সময় সঙ্গে কী কী আনতে হবে, ভাবনা-চিন্তা করেই এনেছিলেন তিনি । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত সেই নওলাখা হার । মুক্তো দিয়ে গাঁথা সেই হারের এক নয়, ছিল অনেকগুলো ছড়া । 1857-র মহাবিদ্রোহের পর নানা সাহেব যখন নেপালে আশ্রয় নেন, তখন তাঁর কাছ থেকে সেই হার নেওয়া হয় । আমের আচারের বোতলে লুকিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল সেই হার ।
বহু বছর পর, একদাবিচ্ছিন্ন দুই ভাই, দেব ও চন্দ্রের ফের দেখা হয় কলকাতায় । আর তারপর দু’জনের মধ্যে যা কথা হয়, তা অনেকটা এইরকম । চন্দ্র অভিযোগ করেন, " মহামান্য, আপনি পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং আমার সঙ্গে চালাকি করেছেন ।" উত্তরে পালটা দেব বলেন, " মহামান্য, আপনিই চালাকি করে আমার রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিলেন । " হিমালয়ের এই দেশে রানারা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশ শাসন করলেও রাজা হিসাবে ছিলেন নামমাত্র পদাধিকারী । আর বাকি সব কিছুর মতোই, তাঁদের শাসনও একসময় শেষ হওয়ারই ছিল । সেটাই হল 1950 সালের 6 নভেম্বর । শীতের সেই সকালে সম্রাট ত্রিভুবন তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পিকনিকে বেরিয়েছিলেন । সড়কপথ ধরে এগোছিল তাঁদের মোটরগাড়ির সারি । ভারতীয় দূতাবাসের কাছাকাছি আসতেই সম্রাট ব্যস্তভাবে বামদিকে তাকান । তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন, কারণ চত্বরের ভিতর থেকে যে ইঙ্গিতের অপেক্ষা তিনি করছিলেন, তা পেয়ে গিয়েছিলেন । এরপর হঠাৎই সবক’টি গাড়ি দিক পরিবর্তন করে ঢুকে যায় আর রক্ষীদের বাইরে রেখে দূতাবাসারে দরজাও হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় । এইভাবে আশ্রয় পাওয়ার দিন কয়েক পর, সম্রাটকে দিল্লিতে উড়িয়ে আনা হয় এবং পূর্ব পরিকল্পনামাফিক নেপালি কংগ্রেস ও অন্যানরা জাতীয় স্তরে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে । এটাই ছিল রানার শাসনের সমাপ্তির সূচনা ৷ যখন 1951 সালের 18 ফেব্রুয়ারি (2007 B.S-এর ফাল্গুন মাসের সপ্তম দিন) সম্রাট ত্রিভুবন জং বাহাদুর রানার সঙ্গে হওয়া 1846 সালের চুক্তি খারিজ করেন ও ঘোষণা করেন ৷ এরপর সাংগঠনিক বিধানসভার তরফে প্রজাতান্ত্রিক একটি সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করা হয় ।
তাঁদের শাসনের বেশিরভাগ সময়ই নিজেদের পরিবারের মেয়েদের বিয়ে ভারতের নানা রাজ্যের রাজপরিবারগুলিতে দিতেন রানারা । যেমন - কাশ্মীর, বরোদা, জয়সলমির, গোয়ালিয়র ও কাথিয়াওয়াড় (কচ্ছ) । এই পর্ব চলেছিল 1947 সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত । আরও স্পষ্ট করে বললে, এই ধারা স্থায়ী হয়েছিল শেষ রানা প্রধানমন্ত্রী মোহন শামশের SJB রানার সময় পর্যন্ত ৷ যাঁর নাতনিদের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল কাশ্মীর, জয়সলমির ও জামনগরের রাজপরিবারে । কিন্তু যখন রানার সহচররা বিবাহের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন, তখন তাঁদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই ভারতের কোনও রাজপরিবারের জামাই হন ৷ পরিবর্তে, তাঁরা জীবনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছিলেন হিমাচলের পাহাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে থেকেই । ক্ষমতায় থাকাকালীন রানারা শাহের পরিবারকে বোঝাতেন, ভারতের ছোট ছোট রাজপরিবারগুলিতে মেয়েদের বিয়ে দিতে । উদাহরণস্বরূপ, ত্রিভুবন শাহের দ্বিতীয় কন্যার বিয়ে হয়েছিল ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে । আর এক মেয়ের বিয়ে হয়েছিল কাশ্মীরের পুঞ্চের রাজার ঘরে ।
নেপাল ও ভারতের রাজপরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের কথা বলতে গেলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায় দেবযানী রানার প্রসঙ্গ না তুললে । তিনি পশুপতি শামশের জং বাহাদুর রানা ও রানি ঊষা রাজে সিন্ধিয়ার ( গোয়ালিয়রের শেষ মহারাজা জিভাজি রাও সিন্ধিয়ার মেয়ে ) দ্বিতীয় কন্যাসন্তান । সহস্রাব্দের গোড়ায় চারদিকে গুজব ছড়িয়েছিল , নেপালের রাজকুমার দীপেন্দ্র তাঁর প্রেমে পড়েছেন এবং তাঁকে বিয়ে করতে চান । কিন্তু তাঁর অভিভাবকরা, বিশেষ করে দীপেন্দ্রর মা, এর কট্টর বিরোধী ছিলেন । ব্রিটেনে পড়াশোনা করতে গিয়ে দীপেন্দ্র ও দেবযানীর প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয় ৷ এই সম্পর্কের কথা জেনে অসন্তুষ্ট ছিলেন রানি ঐশ্বর্য রাজ্যলক্ষ্মী দেবী শাহ । বলা হয়, তিনি ছেলেকে হুমকি দেন, তাঁর মতের বিরুদ্ধে গেলে তিনি দীপেন্দ্রর ভাইকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করবেন ।
এ কথা বহুল প্রচারিত , অভিভাবকদের কাছ থেকে নিজের ভালবাসার মানুষকে বিয়ের অনুমতি না পাওয়ার পরিণাম শোচনীয় হয়েছিল । ঘটনাপ্রবাহ ভয়ঙ্কর আকার নেয় ৷ এমনকী হাতের বাইরে চলে যায় ঘটনা ৷ দুর্ভাগ্যজনক সেই ঘটনায় নেপালের রাজপরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল । যদিও অনেকে এও বলেন , রাজকুমার দীপেন্দ্র গুরুতর 'পার্সোনালিটি ডিজ়অর্ডার' - এ ভুগতেন, সেদিকে সময় থাকতে কেউ নজর দেয়নি ।
পরে 2007 সালে, সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে দেবযানী ( সংবাদমাধ্যম তাকে ' অভিশপ্ত রাজকুমারী ' বলে আখ্যা দিয়েছিল ) বিয়ে করেন পূর্বতন সিংগ্রাউলি রাজ্যের রাজপরিবারের কুমার ঐশ্বর্য সিংকে ৷ যিনি আবার প্রাক্তণ মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী অর্জুন সিংয়ের নাতিও বটে । আবার অর্জুন সিংও পূর্বতন রাজ্য চুরহাটের অধিবাসী ছিলেন । সুতরাং হিমালয়ের এই দেশের সঙ্গে ভারতের 'বহু-বেটি'র সম্পর্ক ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে । প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রক্তের সম্পর্কে নেপাল ও ভারতের পূর্বতন রাজ পরিবারের মধ্যে মিলে মিশে এক হয়ে গেছে ।