প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ ও নৃশংসতা নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রয়েছে । কিন্তু, আমাদের বিচার ব্যবস্থা এখনও সেই পুরোনো রীতি-নীতিগুলিতেই আটকে রয়েছে ৷ ফলে এই দেশে ন্যায়বিচার মরীচিকায় পরিণত হয়েছে ৷ 2001 সালে তহেলকা একটি স্টিং অপারেশন করেছিল ৷ যার নাম ছিল অপারেশন ওয়েস্ট এন্ড ৷ সেখানে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও গোপন প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন NDA এর অন্ধকার দিকটি তুলে ধরা হয়েছিল ৷ সেন্টার ফর সোশ্যাল জাস্টিসের সহযোগিতায় টাটা ট্রাস্টের তরফে ইন্ডিয়া জাস্টিস রিপোর্ট (2019) প্রকাশ করা হয়েছে ৷ তাতে দেখা যাচ্ছে যে রুল অফ ল ইনডেক্সে 126 টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান 68 তম স্থানে ৷ হিংসা বৃদ্ধি পাওয়ায় তার প্রভাব যা হয়েছে, তা ভারতের GDP এর 9 শতাংশের সমান ৷
প্রতিটি সাধারণ বাজেটে অর্থমন্ত্রীর তরফে প্রতিরক্ষা খাতে খরচকে সর্বোচ্চ হিসেবে ঘোষণা করা একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে । কিন্তু CAG এর রিপোর্ট একটি ভিন্ন ছবি তুলে ধরছে ৷ সেখানে সামান্য বরাদ্দ এবং ব্যাপক দুর্নীতির কথা উল্লেখ করা হয় ৷ 2001 সালে ভারতের একটি নিউজ় ম্যাগাজিন সংস্থা তহেলকা লন্ডনে একটি কাল্পনিক অস্ত্র তৈরির সংস্থা গড়েছিল ৷ যার নাম দেওয়া হয়েছিল ওয়েস্ট এন্ড ইন্টারন্যাশনাল ৷ তদন্তকারী সাংবাদিকরা হাতে নিয়ে ব্যবহার করা যায় এমন থার্মাল ক্যামেরা এবং অন্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির অজুহাতে বেশ কয়েকজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন ৷ এই অপারেশন চালাতে তহেলকা 10.8 লাখ টাকা ব্যয় করে৷ যার বেশিরভাগটাই আধিকারিক এবং রাজনীতিবিদদের ঘুষ এবং কমিশন দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যয় হয়েছিল ৷ তবে এটা ভারতের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক মানুষের লোভ এবং নৈতিক দেউলিয়া প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছিল ৷
প্রতিরক্ষা চুক্তি করার সময় দুর্নীতি অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা বলে সমালোচিত হয়েছিলেন প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব ৷ সেটাকে সত্যি প্রমাণ করে অপারেশন ওয়েস্ট এন্ড শুরু হয়েছিল একজন সিনিয়র সেকশন অফিসারকে ঘুষ দিয়ে ৷ আর তা পৌঁছেছিল BJP-র সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণ এবং তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ পর্যন্ত ৷ 2001 সালের মার্চ মাসে ওই অপারেশনের ভিডিয়ো সিডি প্রকাশ করা হয় ৷ যা রাজনৈতিক ঝড় তুলেছিল । প্রস্তাব কার্যকর করার সুপারিশ করতে লক্ষ্মণের এক লাখ টাকা গ্রহণের দৃশ্য সারা দেশকে চমকে দিয়েছিল । ঘুষ যাঁরা নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সমতা পার্টির জাতীয় সভানেত্রী জয়া জেটলি এবং কোষাধ্যক্ষ আর কে জৈন ৷ আদালত একাধিক প্রতিরক্ষা কর্মীকে দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করলেও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কোনও গুরুতর অভিযোগ আরোপ করা হয়নি । দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তদন্ত করার পর সম্প্রতি একটি CBI আদালত জয়া জেটলি এবং আরও দুই জনকে প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পর্কিত দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করেছে । যদিও জয়া জেটলির 4 বছরের কারাদণ্ড হয় ৷ কিন্তু তিনি কার্যত সঙ্গে সঙ্গে জামিনও পেয়ে যান৷ এর থেকেই ভারতে আইন ও ন্যায়বিচারের আসল ছবিটা সামনে চলে আসে৷ সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চূড়ান্ত রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে CBI কেন এত দিন সময় নিল?
তহেলকা অপারেশনের পর বিচারপতি কে ভেঙ্কটস্বামীকে এক সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়েছিল প্রতিরক্ষা চুক্তিতে দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য৷ ভেঙ্কটস্বামী 20 মাস ধরে এই হাই প্রোফাইল তদন্তের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং 181 বার সাক্ষ্যগ্রহণ করেন ৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত রাজনৈতিক চাপের কারণে পদত্যাগ করেন ৷ অথরিটি ফর অ্যাডভান্স রুলিংসে তাঁকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ৷ এটা নিয়ে হইচই হতেই তিনি তেহলকা শুনানি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ৷ 2003 সাল থেকে ফুকন কমিশন তেহলকা টেপগুলির তদন্ত করছিল ৷ তৎকালীন UPA সরকার ওই কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে অস্বীকার করে ৷ এটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে UPA সরকার জর্জ ফার্নান্ডেজ ক্লিনচিট দেওয়ার কারণে এসএন ফুকনকে তিরস্কার করেছিল। যদিও CBI রাজনীতিবিদ ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মোট 9 টি মামলা করেছে৷ বিশেষ CBI-র আদালতের পক্ষে বঙ্গারু লক্ষ্মণকে দোষী সাব্যস্ত করতে ৪ বছর সময় লেগেছে । জয়া জেটলির মামলায় আদালত 8 বছর সময় নিয়েছিল ।
বিচারব্যবস্থা ভারতে সাধারণ মানুষের জন্য একটি বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। CBI এর স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য 1997 সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে কিছু নির্দেশিকা দিয়েছিল ৷ সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল যে, ইংল্যান্ডের ডিরেক্টর অফ প্রসিকিউশনের কায়দায় একটি নিরপেক্ষ সংস্থা স্থাপন করা হোক ৷ আর সেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার হাতেই ছেড়ে দেওয়া হক CBI ও ED-কে ৷ কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলি ওই নির্দেশিকাকে এড়িয়ে তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে সরকারের একটি শাখায় রূপান্তরিত করেছে । দক্ষিণ কোরিয়াকে উদাহরণ হিসেবে দেখুন ৷ সেখানকার প্রেসিডেন্ট দুর্নীতির দায়ে 15 বছর কারাদণ্ড ভোগ করছেন ৷ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে খ্যাত ভারতের পরিস্থিতি একেবারে উলটো ৷ ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার এবং প্রামাণ্য আইন, উদ্ভাবনী বিচার পদ্ধতি এবং আইনি কার্যক্রমে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি প্রবর্তন করতে পারলে, তবেই সকলের জন্য ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত হবে ৷ এটা দশকের পর দশক ধরে চলা দুর্নীতির মামলার অবসান ঘটাবে ৷ আর ভারতীয় রাজনীতিতে অপরাধের প্রবণতা হ্রাস করবে ।