হায়দরাবাদ, 14 জুলাই : মে মাসের শুরুর দিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন UK সংসদে বলেছিলেন, অদূর ভবিষ্যতে "সাইকেলের জন্য নতুন স্বর্ণযুগ আসতে চলেছে৷" হিরো সাইকেলের সেই জনপ্রিয় প্রচারটি মনে করুন "রোড পে দিখেগি তভি তো চলেগি ", দুই বছর আগের ওই বিজ্ঞাপনে সাইকলকে রাস্তায় ফেরানোর লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল এবং সাইকেলের আলাদা লেনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলা হয়েছিল? এখন অবশ্যই কোরোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে 'পৃথিবী দুই চাকার উপরই' থাকবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ৷ আর কোনও প্রচার ছাড়াই এটা হবে ৷ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার এই যুগে মানুষ গণ পরিবহণ ব্যবস্থা ছেড়ে যে তাঁদের কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য বাইকের ব্যবহার করবে, এ নিয়ে কোনও বিস্ময় থাকার কথা নয় ৷ উদাহরণ হিসেবে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের কথা বলা যেতে পারে ৷ তারা কর্মীদের গণ পরিবহণ ব্যবস্থা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য মেমো দিয়েছে : "হাঁটুন অথবা বাইক ব্যবহার করুন ৷ একেবারে শেষ পন্থা হিসেবে নিজের গাড়িও ব্যবহার করতে পারেন ৷" বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও শারীরিক সংযোগ এড়ানোর জন্য সাইকেল ব্যবহারের উপর সওয়াল করেছেন ৷
নিঃসন্দেহে সাইকেল হল পরিবহণের অন্যতম টেকসই পদ্ধতি ৷ যার মধ্যে পরিবেশ সংক্রান্ত এবং অর্থনৈতিক লাভ রয়েছে৷ মারাত্মক বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আগে বাই সাইকেল ব্যবহার করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হত৷ যদিও মানুষ যে পরিমাণ সময় ভ্রমণের জন্য খরচ করে এবং একে অপরের সঙ্গে সুরক্ষিত দূরত্ব বজায় রাখে না ৷ সেই প্রেক্ষিতে এখন আংশিক ভাবে হলেও পরিবহণের ধরন বদলে যেতে পারে ৷ প্যানডেমিক পরবর্তী সময়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধি কার্যকর রাখতে দিল্লি মেট্রো তাদের পরিষেবা ছয় গুণ বৃদ্ধি করছে ৷ মুম্বই শহরতলির ট্রেনের পরিষেবা 14 থেকে 16 গুণ বৃদ্ধি করতে হবে ৷ আর বেঙ্গালুরু মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের তরফে আরও 24 হাজার বাস চালানোর প্রয়োজন ৷ গণ পরিবহণ ব্যবস্থার ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায়, বিশেষ করে বড়
শহরের রাস্তায় কিছু পছন্দসই বিকল্প তৈরির প্রয়োজন রয়েছে ৷ আর এই পরিস্থিতিতে ‘সাইকেল চালানো’ই একেবারে ‘আদর্শ’ সমাধান হতে পারে ৷ ‘আদর্শ’ কিন্তু মোটেই ‘সহজ’ নয় ৷ স্পষ্টতই, বাইক ব্যবহারের জন্য বিস্তৃত পথ, মোটর চালিত গাড়ির থেকে একেবারে আলাদা এবং সাইকেল যাতায়াতের জন্য নির্দিষ্ট বা পথচারীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে ৷ সাইকেল চালানোর জন্য নিরুপদ্রব ও সুরক্ষিত ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন ৷ ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডের মতো দেশে এক শহর থেকে আর এক শহরে যাওয়ার জন্য বাইক যাতায়াতের আলাদা পথ রয়েছে ৷ দোকান, বাড়ি, স্টেশন, স্কুল, কর্মস্থলে রোজ সাইকেল যাতায়াতের জন্য নেদারল্যান্ডে সাইকেলের রাস্তা বা ‘ফিয়েটসপ্যাড’ তৈরি করা হয় ৷ Covid-19 আক্ষরিক অর্থে সারা বিশ্বেই ‘তভি তো চলেগি’ উদ্যোগকে শুরু করিয়ে দিয়েছে ৷ নিউইয়র্কে সাইকেল চলাচলের জন্য 40 মাইলের নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে ৷ বোগোটায় সাইকেল চলাচলের জন্য 76 কিলোমিটার রাস্তা রাতারাতি তৈরি করা হয় ৷ অকল্যান্ডে 17 কিলোমিটারের অস্থায়ী বাইক লেন তৈরি করার জন্য রাস্তার পাশের গাড়ি দাঁড় করানো বন্ধ করিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷ মিলানে পথচারী ও সাইকেল ব্যবহারকারীদের জন্য 35 কিলোমিটার রাস্তার চরিত্র বদল করা হচ্ছে ৷ প্যারিসে সাইকেল চলাচলের জন্য 650 কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে ৷ ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, সাইকেল ব্যবহার ও হেঁটে যাতায়াতকারীদের সুবিধার জন্য দুই বিলিয়ন পাউন্ড খরচ করবে ৷ এই গ্রহের অনেক শহরই হয় অস্থায়ী ভাবে সাইকেলআরোহীদের জন্য রাস্তায় করে দিচ্ছে অথবা সাইকেলের জন্য বরাদ্দ রাস্তা বৃদ্ধি করা হচ্ছে ৷
ভারতেও কাজ শুরু হয়েছে ৷ মোটর চালিত নয় এবং পরিবেশ বান্ধব পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পরিকল্পনা শুরু হয়েছে বেঙ্গালুরু, তিরুঅনন্তপুরম, চেন্নাই ও নয়াদিল্লির মতো শহরে ৷ আবাসন ও নগরোন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রকের তরফে "India Cycles Change Challenge" নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ৷ Covid-19 এর প্রেক্ষিতে সাইকেল-বান্ধব প্রকল্প স্মার্ট সিটিগুলিতে রূপায়ণ করার জন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ৷ প্রথম পর্যায়ে এর মধ্যে 10 টি শহর রয়েছে ৷
সারা বিশ্ব জুড়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বড় শহরগুলিতে বাইকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই বাইক প্রস্তুতকারী সংস্থার থেকে জানা গিয়েছে ৷ আর সাইকেল প্রস্তুতকারীদের বিক্রিও বৃদ্ধি পেয়েছে ৷প্যানডেমিক শুরু হওয়ার পর থেকে কিছু কিছু সাইকেল প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘অস্বাভাবিক চাহিদা’ দেখতে পাচ্ছেন ৷ অনেক সরকার সাধারণ মানুষকে সাইকেল কেনার বিষয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন ৷ উদাহরণ হিসেবে ইতালির কথা বলা যেতে পারে ৷ লকডাউনের পর সেই দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, তার মধ্যে "বিকি বোনাস" হিসেবে ছিল 500 ইউরোর ছাড় ৷ যার মাধ্যমে বাইক কিনলে ক্রেতাদের 60 শতাংশ পর্যন্ত দামের উপর ছাড় দেওয়া হচ্ছে ৷ তবে 50 হাজারের বেশি বাসিন্দা রয়েছে এমন শহরে বসবাসকারীরাই এই সুবিধা পাচ্ছেন ৷ সাইকেল মেরামত করার জন্য ফরাসি সরকার 50 ইউরোর রসিদ দিচ্ছে ৷ বিভিন্ন স্থানীয় প্রশাসনের তরফে ইনসেনটিভ দেওয়া হচ্ছে ৷ উদাহরণ হিসেবে লায়ন মেট্রোপলিটন রিজিয়ন অফ ফ্রান্সের কথা বলা যেতে পারে ৷ তারা ইলেকট্রিক সাইকেল, ফোল্ডিং বাইক অথবা কার্গো বাইকের ক্রেতাদের 500 ইউরো করে সাবসিডি দিচ্ছে ৷ নতুন বাইসাইকেল যাঁরা কিনবেন, তাঁদের নগদে ইনসেনটিভ দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে ৷
মিশ্র জমি ব্যবহারের ধরন এবং 60 শতাংশ ট্রিপ লেন্থ হওয়ায় ভারতীয় শহর পাঁচ কিলোমিটার থেকেও ছোট ৷ তাই ভারতের শহরগুলিতেও বাইসাইকেল ব্যবহারের সম্ভাবনা উজ্জ্বল ৷ তবে প্রতিটি শহরে অবশ্য বাইসাইকেল বিপ্লব খুব সহজ নয় ৷ ভারতের যে সমস্ত শহরের জনসংখ্যা দুই মিলিয়নের চেয়ে কম, সেখানেই সাধারণত বাইসাইকেলের ব্যবহার দেখা যায় ৷ জনসংখ্যার সঙ্গেই বাইসাইকেলের ব্যবহার কমতে থাকে ৷ অন্যতম ব্যস্ত শহর কলকাতাকে যদি উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে এই শহরের মাত্র সাত শতাংশ জায়গা রাস্তার জন্য বরাদ্দ ৷ আর এখানে বাইকের জন্য আলাদা পথ তৈরি করা খুবই কঠিন ৷ আরও একটি সম্ভাব্য বিষয় যা অস্বীকার করার উপায় নেই, তা হল পৃথিবীর এই অংশের রাস্তায় সাইকেল ব্যবহারকারীরা হয় সাধারণ ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অবহিত নন অথবা তাঁরা মনে করেন যে ট্রাফিক আইন তাঁদের উপর বলবৎ হয় না ৷
সুযোগের মধ্যেও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে ৷ আমার এক ব্রিটিশ বন্ধু ৷ তিনি ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ৷ তিনি তাঁর শহরতলির বাড়ি থেকে বাইসাইকেলে কয়েক মাইল এসে স্টেশনে পৌঁছান ৷ তার ট্রেনেই ওই সাইকেল নিয়ে কভেন্ট্রি রেল স্টেশনে আসেন ৷ সেখান থেকে চার মাইল দূরে ক্যাম্পাস অবস্থিত ৷ তিনি সাইকেলেই কভেন্ট্রি স্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আসেন ৷ আমরাও কি লোকাল ট্রেনে এভাবে সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করতে পারব? তার পরও "রোড পে দিখেগি" নিয়ে তাড়াহুড়োর বিষয়টি এর আগে এত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেনি ৷