হায়দরাবাদ, 18 সেপ্টেম্বর : কৃষকরা আমাদের দেশের মেরুদণ্ড । তাই তাঁরা সংকটের সময়ে লাঙল-বলদ তুলে রাখেননি । বরং দিন-রাত কাজ করেছেন । সেই কারণে এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও দেশে খাদ্যের আকাল ঘটেনি । কোভিডে 19-এর ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলি যে ধাক্কা সহ্য করেছে, তার জন্য সাহায্য করতে কেন্দ্র আত্মনির্ভর প্যাকেজ ঘোষণা করেছে । কিন্তু যখন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎপাদক, মানে কৃষকদের সাহায্যের সময় এল, তখন তাঁদের উপকার ও বাঁচানোর বদলে ক্ষতিকারক নীতি গ্রহণ করা হল । এটা খুবই খারাপ । দুই বছর আগে দশম কৃষি সুমারি হয়েছিল । সেই সময় দেখা গিয়েছিল যে দেশের ছোট কৃষকদের মধ্যে 86.2 শতাংশের কাছে দুই হেক্টরেরও কম জমির মালিকানা রয়েছে । 12 কোটি 60 লাখ কৃষকের কাছে গড় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ 0.6 হেক্টর । অন্যদিকে গত কয়েক দশক ধরে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নামে কৃষকদের প্রতারিত করা হচ্ছে । অসহায় কৃষকদের কৃষি বাজারগুলিতে প্রতারিত করছে এক শ্রেণির দালালরা । এই অসংগঠিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কেন্দ্র সংসদে একটি বিল পেশ করেছে । তাতে কৃষকদের ফসল যে কোনও জায়গায় বিক্রির স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে । যাতে তাঁরা ভালো মূল্য পান । একই সঙ্গে আরও একটি বিল পেশ করা হয়েছে । ওই বিলের মাধ্যমে ফলনের আগে ব্যবসায়ী ও চাষির মধ্যে হওয়া চুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে । সেখানে ব্যবসায়ীর নিরাপত্তার দিকটি দেখা হয়েছে । আর কৃষকের হাত বেঁধে দেওয়া হয়েছে ।
ওই বিলের অপরিণামদর্শিতা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে একেবারে ভিন্ন । বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেলে ফসলের দাম সমান হওয়ার পথ সুগম হবে এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পাবে । ওই বিলে এমনই আশা প্রকাশ করা হয়েছে । বাস্তব পরিস্থিতিতে বীজ বপন ও ফসল ফলানোর জন্য কৃষকদের বিনিয়োগের খুব প্রয়োজন হয় । কিন্তু এক্ষেত্রে কৃষককে একেবারে মরসুমের শুরুতে ব্যবসায়ীর ফাঁদে পা দিতে হবে এবং অলাভজনক একটি শর্ত মেনে নিতে নিতে হবে । যদি ফলন ভালো হয়, তাহলেও তাঁরা অতিরিক্ত লাভ পাবেন না। কারণ, আগে চুক্তি হওয়া টাকাতেই তাঁকে ব্যবসায়ীর কাছে সমস্ত ফসল দিয়ে দিতে হবে । দেশের খাদ্য সুরক্ষার একমাত্র কৃতিত্বের অধিকারী কৃষকরা । সরকারকে তাঁদের কল্যাণের কথা ভাবা উচিত । কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সরকার তা ভাবছে না । বরং তাঁদের বাজারের চাপের দিকে আরও বেশি করে ঠেলে দিচ্ছে ।
কৃষি অর্থনীতিবিদ অশোক গুলাটির মতে, কৃষকদের সাহায্য করার জন্য সরকার প্রতি বছর ফসলের সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করে । কিন্তু এর জন্য প্রতি বছর 2.65 কোটি টাকা ক্ষতি হয় । 2000 সাল থেকে 2017 সালের মধ্যে কৃষকদের উপর থেকে পরোক্ষ কর তুলে নেওয়া হয়েছিল । যার পরিমাণ ছিল 45 লাখ কোটি টাকা । এই তথ্যটিকে কিভাবে দেখা হবে ? কেন্দ্র মুক্ত বাজার তৈরি করতে চায় । তাই কৃষি বাজার আইনে সংস্কার করতে চায় তারা । সেই কারণেই এই আইন আনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে । কিন্তু তাদের কোনও ধারণাই নেই যে নিয়ন্ত্রিত বাজারগুলিতেও কৃষকের কথা বলার কোনও অধিকার নেই । তাহলে কৃষক কিভাবে মুক্ত বাজারে নিজেদের স্বপক্ষে সরব হবে । এই তথ্যের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে সহায়ক মূল্য কৃষকদের কল্যাণের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে । কিন্তু ড.স্বামীনাথন কমিটির প্রস্তাব কেন মেনে নেওয়া হচ্ছে না ? যেখানে উন্নতির নিরিখে তা নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রয়োগ করার কথা বলা হয়েছে । কৃষকরা নিজেরা না খেয়ে দেশকে খাওয়ায় । তারা শুধু দেশকে খাদ্য স্বনির্ভরতার লক্ষ্যেই পৌঁছে দেয় না । বরং দেশের সার্বভৌমত্বকেও কোনও রকম আপোসের হাত থেকে রক্ষা করে কৃষকরাও সৈনিকের ভূমিকা পালন করে । তেলেঙ্গানায় যে ফসল-কলোনি গড়ে তোলা হয়েছে, তা দেশজুড়ে প্রয়োগ করা জরুরি হয়ে উঠেছে । আর একটা ব্যবহারিক কৃষিনীতি তৈরি করতে হবে । যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন কৃষকরা ।
দেশের ১০০ টিরও বেশি বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাটি পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে । যাতে বোঝা যায় যে কোন মাটি কোন ফসলের জন্য উপযুক্ত । তাছাড়া একটি বার্ষিক ফলনের পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে । যার মাধ্যমে দেশের চাহিদা তো মিটবে । তার সঙ্গে রপ্তানির সুযোগও বৃদ্ধি করবে । সরকারের দায়িত্ব হল কৃষি গবেষণা চালিয়ে যাওয়া । আর কম ফলন, নিম্নমান, কীটনাশকের সমস্যা, খরা ও বন্যার মতো বিপর্যয় থেকে কৃষকদের রক্ষা করা । সরকারের উচিত ফসল সংগ্রহের ব্যবস্থা করা ও কৃষককে উপযুক্ত দাম পাইয়ে দেওয়া এবং একই সঙ্গে দেশের খাদ্য সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা । যদি অসহায় কৃষকদের সমস্যার ঘূর্ণাবর্তে ফেলে দেওয়া হয় এবং মুক্ত বাজারের দয়ার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাঁদের অবস্থা জ্বলন্ত আগুনে বসার মতো হয়ে যাবে । তখন এই অবাস্তব সংস্কার ও আইন তাঁদের জন্য আশীর্বাদের বদলে সর্বনাশ ডেকে আনবে ।