দিল্লি, 29 জুলাই : অভিজাত, রয়্যাল বললেই প্রথমেই একটি প্রাণীর চেহারা ভেসে ওঠে ৷ গোটা শরীর ডোরাকাটা ৷ প্রাণীটি ভারতের জাতীয় পশু ৷ বাঘ ৷ উপন্যাস বা সিনেমাতেও একাধিকবার উঠে এসেছে সে নানাভাবে৷ এসেছে ঘর সাজানোর খেলনা হিসেবেও ৷ এসেছে বাংলার বহুরূপীর চরিত্রেও (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস শ্রীকান্তে শ্রীনাথ বহুরূপী কিংবা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি বাঘ বাহাদুর) ৷
সারা বিশ্বে অন্যতম সমাদৃত পশুটির অস্তিত্ব আজ একেবারে বিপন্ন ৷ 100 বছর আগেও গোটা এশিয়ায় প্রায় এক লাখ বাঘ ছিল ৷ চোরাশিকার ও শিকার, প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংসের জেরে এখন সংখ্যাটা মাত্র 3900 ৷ ভারতে 2226টি বাঘ রয়েছে ৷ সবচেয়ে বেশি বাঘ রয়েছে কর্নাটকে ৷ 2010 সালে সারা দেশে মোট বাঘের সংখ্যা ছিল 1706টি ৷
2010 সালে 13টি দেশ (যেখানে বাঘের দেখা মেলে ) অর্থাৎ টাইগার রেঞ্জ কান্ট্রিজ় (ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, ভিয়েতনাম, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চিন, রাশিয়া, তাইল্যান্ড, লাওস)-র নেতারা সমবেত হয়েছিলেন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে টাইগার কনজ়ারভেশন ফোরামে ৷ লক্ষ্য 2022 সালের মধ্যে সারা বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হবে৷ সে সেময়ই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস হিসেবে পালিত হবে 29 জুলাই দিনটি ৷
পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, মাংসাশী, হিংস্র প্রাণীদের অন্যতম রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ৷
সত্যিই কি এতটাই হিংস্র ? সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের পিলিভিতে এক বাঘিনিকে পিটিয়ে মেরে ফেলল একদল গ্রামবাসী । সেই ঘটনা গ্রামবাসীরা মোবাইলে রেকর্ড করেন । ভিডিয়ো পোস্টও করা হয় সোশাল মিডিয়ায় ।
বাঘিনিটিকে মারার অভিযোগে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল প্রশাসন । তাঁদের মধ্যে চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন । পিলিভিত ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডিরেক্টর এইচ রাজামোহন জানিয়েছেন, বাঘিনিটির শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে । এমন কী মারের চোটে পাঁজরের চারটি হাড় পর্যন্ত ভেঙে গেছে । বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পিলিভিতের জেলাশাসক বৈভব শ্রীবাস্তব । এই জাতীয় ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে ৷
বিশ্বের বৃহত্তম ''ক্যাট স্পিসিস'' বাঘ ৷ প্রায় দু'লাখ বছর ধরে বিশ্বে রয়েছে প্রাণীটি ৷ কিন্তু ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড (WWF) বলছে, বাঘ বাঁচান । নাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও বাঁচবে না । তাই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতেই বাঁচাতে হবে প্রাণীটিকে ৷
অরণ্য সংলগ্ন এলাকায় গ্রামের বাসিন্দারা এখন জড়িয়ে যাচ্ছেন অপরাধমূলক কাজে । চোরাশিকারিরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । বন দপ্তরের কর্তাদের দাবি, চোরাশিকারিরা বহু ক্ষেত্রেই নির্ভর করে ওই সব গ্রামের বাসিন্দাদের উপরে । কারণ তথ্যের জন্য তাঁদের উপরে নির্ভর করাটাই চোরাশিকারিদের কাছে সবচেয়ে সুবিধাজনক । বিনিময়ে গ্রামবাসীদের টাকা দেয় তারা । আর ক্রমশ অপরাধের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েন নিরুপায় মানুষ ।
দৈনন্দিন প্রয়োজনেই ঘাস, গাছের ডালপালা কাটেন স্থানীয় মানুষ । চলে গৃহপালিত পশু চরানোর কাজও । এতে ক্ষতি একাধিক। প্রথমত গবাদি পশুবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার ভয় থাকে অন্য বন্য প্রাণীদের মধ্যে। তার জের মারাত্মক হতে পারে । আর একটা বড় কারণও রয়েছে । পেট ভরানোর জন্য বাঘ হরিণ খা য়। হরিণ খায় ঘাস । ঘাস কমে যাওয়ায় অনাহারে হরিণের মৃত্যুর ঘটনা বাড়ে । আর হরিণের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বাঘের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি ।
এই প্রসঙ্গে মনে করতে হবে জিম করবেটকে । জিমের নামেই এ দেশে প্রথম ন্যাশনাল পার্ক । 1957 সালে (আগে ছিল হেলির নামে) । অরণ্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে যারা চর্চা করেন তাঁদের অনেকেই আজ মনে করেন ভারতে এই সংরক্ষণের অগ্রপথিক জিম করবেটই । তবে ভুলে গেলে চলবে না যে জিমের আগে সংরক্ষিত অরণ্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন দুই ব্রিটিশ ফরেস্ট অফিসার । ই আর স্টিভেন্স এবং তারপর ই এ স্মাইথস । যথাক্রমে 1916 এবং 1917 সালে । কিন্তু তদানীন্তন ব্রিটিশ রাজপুরুষ পারসি উইন্ডহ্যাম সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন ।
এদেশের জঙ্গলে বুনো জন্তু নিকেশ করার কাজে মেতে ওঠা ব্রিটিশ পুরুষদের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝিয়েছিলেন এক শিকারিই । যিনি ভারতের গ্রামে-গঞ্জে থাকা মানুষজনকে ভালবাসতেন । স্বাধীনতারও বেশ কিছুদিন পর বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন আনার তাগিদ তৈরি হয় এদেশে ৷ জিম করবেট, যাঁকে দেহাতি মানুষগুলো কার্পেট সাহেব বলতেন, তিনি সেই আমলে শিকার করলেও সংরক্ষণের মহিমাও বুঝেছিলেন । বন এবং বন্যপ্রাণ, দুয়েরই ।
কে বেশি বিপন্ন মানুষ না পশু?