দিল্লি, 8 ডিসেম্বর : ভারতের সংবিধান বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম লিখিত সংবিধান । এটা শুধু মাত্র কাগজের উপর লিখিত একটা বই নয়, বিশ্বের এক সপ্তমাংশ মানুষকে একটি ছাতার তলায় আনার একটি মানবিক প্রচেষ্টা । ভারতীয় সংবিধান দেশের নাগরিকদের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ করে না ।
1946 সাল পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর প্রস্তাব ছিল ভারতের সংবিধান রচনার বিষয়ে । ভারতের ভবিষ্যতের কথা চিন্তার করে ভারতের গণপরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং এই দিনই সংবিধান রচনার কাজ শুরু হয় । প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল দেশের প্রতিটি মানুষের নিশ্চয়তা, সুরক্ষা, প্রতিশ্রুতিপূরণ সর্বোপরি একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে সকলকে নিয়োজিত করার পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয়েছিল সংবিধান রচনার কাজ । ১৯৪৬ সালের অগাস্ট মাসে ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশগুলির মোট ২৯৬টি আসনে নির্বাচন সমাপ্ত হয়। ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর ভারতের গণপরিষদে প্রথম সভা বসে । চারটি স্তম্ভকে সামনে রেখে শুরু হয় সংবিধান রচনার কাজ-- স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব । ভারতীয় সংবিধান একটি নীতির উপর নির্ভর করে, তা হল অনন্য এবং অনুকরণীয়, মানুষে-মানুষে বিভেদ এবং পছন্দগুলিকে একত্র করার কাজ করার জন্য সংবিধান প্রণেতাদের ধন্যবাদ দিতেই হবে । এই বছর ভারতীয় সংবিধান 70 বছর পূর্ণ করল । যে দূরদর্শী মানুষগুলি উপযুক্ত পাণ্ডুলিপি তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবিধান থেকে সেরা বিষয়গুলিতে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছিলেন ।
1) ফরাসি সংবিধান থেকে স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের নীতি ।
2) সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ।
3) দিক নির্দেশক নীতিগুলির ধারনা আয়ারল্যান্ড থেকে ।
4) জাপান থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিষ্ঠা এবং কাজ ।
26 নভেম্বর, 2015 সালে মোদি সরকার প্রস্তাব দিয়েছিল ভারতরত্ন বিআর অম্বেদকরের 125 তম জন্মবার্ষিকী সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করার জন্য । একই সঙ্গে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, 70 তম বছরটিকে পালন করার জন্য বছরভর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে । দেশের প্রতিটি স্কুলকে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল ।
সংবিধানের 50 তম বর্ষ, সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়াণন দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে আত্মবিশ্লেষণ করতে একটি প্রশ্ন করেছিলেন, সংবিধান কি কোনও ভাবে আমাদের ব্যর্থতার কারণ, বা আমরা সংবিধানের ব্যর্থতার কারণ হয়ে উঠছি ? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আজকাল সে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি আমরা হচ্ছি, তার ওষুধ ।
"কেবল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিবৃতিগুলির উপর ভিত্তি করে আমাদের কর্মক্ষমতা নির্ভর করে না, তা বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ করা উচিত ।" এটা ছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য । সংবিধানের 100টির বেশি সংশোধন করা হয়েছে । যা প্রমাণ করে নমণীয়তা । একই সঙ্গে সাত দশকের বেশি সময় ধরে দারিদ্র, ক্ষুধা এবং অসুস্থতার বিরুদ্ধেও লড়াই করার প্রেরণাও এই সংবিধান । বিশ্ব মানব উন্নয়ণ সূচকে ভারতের স্থান বিশ্বের মধ্যে 130 নম্বরে । এটা ঠিক যে রাজনৈতিক দুর্নীতি ভারতের সব দুর্নীতির উৎস, এটা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে । এটা কোনও ভাবেই দেশের খ্যাতি বৃদ্ধির পক্ষে সাহায্য করে না । আইনসভা এবং বিচার বিভাগকে অবশ্যই সংবিধানের একতিয়ার এবং কর্তব্যের সপক্ষে থাকতে হবে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থার ডাকা দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা । 1949 সালের নভেম্বরে আম্বেদকর সতর্ক করেছিলেন, প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে বার বার সংবিধানের উপর আঘাত করার নজির আছে, এটা অবশ্যই এক বিপজ্জনক পদক্ষেপ । কয়েকজন স্বার্থপর রাজনৈতিক নেতা এবং আমলারা নিজদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আইনকে ব্যবহার করেন । যখন আইনসভায় মহিলাদের এক তৃতীয়াংশ সংরক্ষণে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের বিরোধিতা বা অপরাধীদের অবাধ বিচরণ দেশের সাংবিধানিক রীতিনীতির সঙ্গে মাননসই নয় । শুরুতেই যদি না এই নৈরাজ্য বন্ধ করা যায়, তা হলে ভারতীয় সংবিধানের অবক্ষয় কোনও ভাবেই রদ করা যাবে না ।
জাতীর জনক মহাত্মা গান্ধি স্পষ্ট করেছেন, সংবিধান দেশের কাছে, দেশের মানুষের উন্নতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ । কয়েক দশকের মূর্খতা এক জাতি বৈষম্যের পর্দা তৈরি করেছে, দুর্নীতি যেন দেশটাকে আষ্টেপৃষ্ঠ বেঁধে ফেলছে, একটা কালো কাপড়ের আস্তরণ তৈরি হচ্ছে । শপথের সময়ের কথা ভুলে এখন অনেক সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়ছে । সমীক্ষা বলছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ণের গতি নিম্নমুখী । অম্বেদকর 25 নভেম্বর 1949 তাঁর শেষ ভাষণটা দিয়েছিলেন, তার প্রাসঙ্গিকতা আজকের দিনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ।
আম্বেদকর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অসহযোগিতা এবং সত্যাগ্রহ বেশি দিন স্থায়িত্ব পাবে না ৷ আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সীমাহীন ভক্তি এবং আনুগত্যই স্বৈরতন্ত্রের অন্যতম কারণ । রাজনৈতিক গণতন্ত্র ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে । একটা কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করছে ৷ এমন একটা সময় আসছে যখন নাগরিক এবং সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে । ক্ষুধা ক্রমেই লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, দেশের উন্নয়ন অনেকটাই নির্ভর করে দারিদ্র দূরীকরণের উপর । নেতাদের উপলব্ধি করতে হবে, আমরা ভারতের নাগরিক... সংবিধানের এই একটি ধারা থেকে স্পষ্ট প্রত্যেকে একই আইনের অধীনে । একমাত্র যখন দেশের সব নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়া যাবে এবং আইন সভার সদস্যারা আইন মেনে পদক্ষেপ করবেন, তখনই একমাত্র দুর্নীতি মুক্ত রাষ্ট্র গঠন সম্ভব । দেশের সামগ্রিক উন্নতি ঘটাতে পারলেই একমাত্র আমরা সংবিধানের আসল উদ্দেশ্য সফল করতে পারব ।