ETV Bharat / bharat

প্রবাসে ভারতীয়রা, মৈত্রী ও উন্নয়নের সেতু - indians in foreign countries

বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়রা দেশগুলির মধ্যে মৈত্রী ও উন্নয়নের অন্যতম যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে । এই মুহূর্তে বিদেশে 18 মিলিয়নেরও বেশি ভারতীয় বাস করে । বিদেশে বসবাসকারী এই ভারতীয়দেরই সুবাদে আরও বেশি বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি ভারতে আসছে । বিশেষ করে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি এবং আর্থিক ক্ষেত্রের বিনিয়োগমুখী উন্নয়নে এই ভারতীয়দেরই বড় ভূমিকা রয়েছে । প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাষ্ট্রদূত অনিল ত্রিগুণায়ত । জর্জন, লিবিয়া এবং মালটারের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ছিলেন তিনি ।

ছবি
ছবি
author img

By

Published : Feb 29, 2020, 12:20 PM IST

দিল্লি, 29 ফেব্রুয়ারি : বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের সংখ্যা বর্তমানে 18 মিলিয়নের বেশি । পাশাপাশি বিদেশে বসবাসকারী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বৃহত্তম হওয়ার স্বীকৃতি এখনও ধরে রেখেছে ভারতীয়রা । এই তালিকায় রয়েছেন বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিক এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক । ভারতের বাইরে যে সব দেশের বাসিন্দা তাঁরা, সেই সব দেশের উন্নয়নে তাঁদের ভূমিকা সর্বব্যাপী সমাদৃত । নিজেদের পরিশ্রম, নিয়মানুবর্তিতা ও নিষ্ঠাকে হাতিয়ার করে বিগত কয়েক বছরে তাঁরা সেই সব দেশের যোগ্যতম মানবসম্পদ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন । উত্তর অ্যামেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে ছড়িয়ে থাকা এই ভারতীয়দের কাজের তালিকায় রয়েছে ‘হোয়াইট কলার’ থেকে শুরু করে ‘ব্লু কলার জব’-ও ।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিদেশে বসবাসকারী সবচেয়ে বেশি ভারতীয়রা রয়েছেন যথাক্রমে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি (3.4 মিলিয়ন), অ্যামেরিকা (2.6 মিলিয়ন) এবং সৌদি আরবে (2.4 মিলিয়ন) । সাম্প্রতিক ভারত সফরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অ্যামেরিকার উন্নয়নে সে দেশে বসবাসকারী চার মিলিয়ন প্রভাবশালী ভারতীয়দের ভূমিকার কথা তুলে ধরেছিলেন । উপসাগরীয় দেশগুলিতে মানবসম্পদের নিরিখে আর সকলের তুলনায় ভারতীয়রাই সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং ভারতীয়দেরই বেশি পছন্দ করা হয় । অস্ট্রেলিয়ার ‘অ্যান ইন্ডিয়া ইকোনমিক স্ট্র্যাটেজি টু 2035’-এ অস্ট্রেলিয়া সরকার সে দেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের তাদের জাতীয় অর্থনৈতিক সম্পদ হিসাবে অভিহিত করেছে এবং জানিয়েছে, দেশের সবরকম কর্মকাণ্ডে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হচ্ছে । অস্ট্রেলিয়া সরকার আরও ঘোষণা করেছে যে, এই দ্রুত ক্রমবর্ধমান সম্প্রদায়ের উদ্যোগপতি প্রতিভা, উদ্ভাবনী শক্তি, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস এবং সর্বোপরি ভারতের বাজার সম্পর্কে এদের সম্যক জ্ঞান ভবিষ্যতে অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য ক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা আরও বৃদ্ধি করবে । ভারতের বাইরে যে দেশে ভারতীয়রা রয়েছেন, সেখানে তাঁদের ক্রমবর্ধমান আর্থিক এবং রাজনৈতিক প্রাধান্য আখেরে তাঁদের সেই দেশের অন্যতম প্রভাবশালী কণ্ঠে পরিণত করেছে । বর্তমানে এই ভারতীয়রা একাধিক MNC-র উচ্চ পদে রয়েছেন । যা তাঁদের জন্মভূমি দেশের কাছে সমীহ করার মতো বিষয় । বিদেশে বসবাসকারী এই ভারতীয়দেরই সুবাদে আরও বেশি বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি ভারতে আসছে । বিশেষ করে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি এবং আর্থিক ক্ষেত্রের বিনিয়োগমুখী উন্নয়নে এই ভারতীয়দের বড় ভূমিকা রয়েছে । সবচেয়ে বড় কথা, ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ’ হিসেবে এই ভারতীয়দের বার্ষিক প্রেরিত অর্থ যার মূল্য 60 মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, ভারতীয় অর্থনীতিকে একটি মজবুত ভিত্তি দিতেও সাহায্য করেছে ।

যদিও উপসাগরীয় দেশগুলিতে ‘ব্লু কলার’ চাকুরিজীবীদের শোষণ এবং নিষ্কাশনের কাহিনী খুবই করুণ । এর অন্যতম কারণ নিয়মনীতির অবহেলা, বিবেকহীন লোকবল যোগানকারী এজেন্ট এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসহানুভূতিশীল নিয়োগকর্তা । বেশিরভাগ সময়ই আবার এঁদের ক্ষেত্রে ‘ভিখারিদের কখনও কিছু বেছে নেওয়ার অধিকার থাকে না’—এই প্রচলিত আপ্তবাক্যটিও প্রযোজ্য হয় । স্বপ্নের মোহে বুঁদ ভারতীয় তরুণদের একটা বড় অংশ চাকরির খোঁজে পশ্চিমের দেশগুলিতে যায় । সেখানে গিয়ে তাঁদের স্বপ্নভঙ্গ হয় । পরে তাঁরা অবৈধ অভিবাসী হিসাবে দুঃস্বপ্নের জীবন কাটাতে শুরু করেন । উপসাগরীয় দেশগুলিতে কাজের পারমিটে বেশিরভাগ সময়ই দেশছাড়ার ক্ষেত্রে কড়া নিয়মনীতি থাকে আর কাজের চুক্তিপত্রগুলিও একতরফা হয় । ভারত সরকারের পাসপোর্ট আইন লঙ্ঘণ করে অনেক নিয়োগকর্তাই এদের পাসপোর্টও আটকে রাখে । কোনও সমস্যায় পড়লে পরিচয়পত্র হিসেবে থাকে শুধু আধার কার্ড এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স । মিডলম্যান তথা মধ্যস্থতাকারী এবং এজেন্টরা বেশিরভাগ সময়ই তথ্য লুকোয় এবং চাকরিপ্রার্থীকে বোঝায় বিদেশে চাকরি করা মানেই স্বপ্নপূরণ । তাই, যাতে ঠকতে না হয়, তাই চাকুরিপ্রার্থীদের উচিত আগেভাগে ভারতে রাজ্য সরকারগুলির একাধিক রিসোর্স সেন্টারে যোগাযোগ করে, তাদের পরামর্শ নেওয়া এবং বাড়িতে অন্য দেশে ভ্রমণ এবং চাকরির চুক্তিপত্রের নথির কপিও রেখে যাওয়া । এর পাশাপাশি ভারতে সংশ্লিষ্ট সংস্থার তরফে সঠিক দিশানির্দেশ চেয়ে নেওয়া এবং যাওয়ার আগে আরবি ভাষায় কিছু দরকারি শব্দ ও বাক্য শিখে যাওয়াও জরুরি । চাকরিসূত্রে বিদেশে গমনকারী ভারতীয়দের নিরাপত্তার জন্য তাঁদের পাসপোর্টে ‘অভিবাসন ছাড়পত্র প্রয়োজন’-এর সিলমোহর দেওয়া থাকে, যা বেশ কয়েক দফা পরীক্ষা করার পরই পাওয়া যায় প্রোটেক্টরেট জেনারেল অফ ইমিগ্রান্টস-এর তরফে । বর্তমানে এই বিষয়টি বিদেশ মন্ত্রকের অন্তর্গত । বিওরো অফ ইমিগ্রেশনের সহযোহিতায় ‘ই-মাইগ্রেট’ সিস্টেমের মাধ্যমে একটি সক্রিয় ডেটাবেসও প্রস্তুত করা হয়, যেখানে বিদেশি নিয়োগকর্তাদেরও নাম, ধাম নথিভুক্ত করা হয়, যাতে প্রয়োজনে যোগাযোগ করা যায় । ভারতীয় দূতাবাসগুলির তরফে একটি ভারতীয় সম্প্রদায় কল্যাণ তহবিলও পরিচালনা করা হয়, যা বিদেশে বিপদের সম্মুখীন হওয়া বা আটকে পড়া ভারতীয়দের আপদকালীন সাহায্য করতে পারে । তাঁদের নিয়োগকর্তা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে দ্রুত সমন্বয় সাধন করে । এরকম বহু ঘটনা ঘটেছে যে বিদেশে কর্মরত ভারতীয় পরিচারিকা এবং সেবিকাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে এবং তখন এই সব দূতাবাসের তরফে তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আশ্রয়ও দেওয়া হয়েছে । যাঁরা যাঁরা বিদেশে কাজের খোঁজ করছেন, তাঁদের প্রত্যেককে বিমার বন্দোবস্ত অবশ্যই করতে হবে, যা তাঁদের সে দেশ থেকে হঠাৎ চলে আসতে বা প্রয়োজনে কাজের চুক্তি ভাঙতে সাহায্য করবে ।

নারীকল্যাণের ক্ষেত্রে বিশেষ বন্দোবস্ত করা হয়েছে । যদি কারও বয়স তিরিশের নিচে হয় শুধুমাত্র তাহলেই তার নিয়োগকর্তা জামানত এবং সর্বনিম্ন প্রতিশ্রুত মজুরির যোগান দেন । বিদেশে চাকরিসূত্রে পাড়ি দেওয়ার আগে কাজের জায়গা সম্পর্কে সঠিক ও যথাযথ দিশার খোঁজ রাখা এবং দক্ষতা অর্জনের বন্দোবস্ত PPP ফরম্যাটের আওতায় করা হয় । কিন্তু এত সব সতর্কতা সত্ত্বেও কিছু অপ্রত্যাশিত এবং অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেই যায় । আর তা নিয়ন্ত্রণ করতে ভারত সরকার সেই সব দেশের সঙ্গে MOU এবং দ্বিপাক্ষিক নানা ধরনের চুক্তি সই করেছে, যাতে বিদেশে কর্মরত ভারতীয়দের সঙ্গে কোনও বৈষম্য না করা হয় । সেজন্য নিয়মিত ভিত্তিতে কনসুলার স্তরে আলোচনারও আয়োজন করা হয় । যেখানে চর্চার মুখ্য বিষয়ই হল বিদেশে কর্মরত ভারতীয়দের সঙ্গে কোনও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটলে এবং দ্রুত সাহায্যের ব্যবস্থা করা না গেলে, কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত । প্রায়ই তাদের তরফে মুক্ত আলোচনা চক্রের আয়োজন করা হয়, যেখানে যে কেউ অংশ গ্রহণ করতে পারেন এবং দ্রুত সাহায্যের ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে বক্তব্য রাখতে পারেন । এর 24x7 জরুরি যোগাযোগের ব্যবস্থাও সকলের জন্যই খোলা । প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী প্রয়াত সুষমা স্বরাজ ভারতীয় দূতাবাসগুলিকে ‘বাড়ি থেকে দূরে আর একটি বাড়ি’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন । বিদেশে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক ভারতীয়দের একজনও, কখনও কোনও বিপদে পড়লে ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করে তাঁর সমস্যা সমাধান করাকে নিজের লক্ষ্যে পরিণত করে ফেলেছিলেন । বর্তমান বিদেশমন্ত্রী সেই গুরুদায়িত্ব দ্বিগুণ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন । প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের কল্যাণে বিশেষ নজর দিয়েছেন এবং যে কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে তাঁদের সঙ্গে দেখা করা ও কথা বলা সুনিশ্চিত করেন ।

বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে এবং তাঁদের সঙ্গে আবেগ নির্ভর, আত্মিক যোগসূত্র গড়ে তুলতে প্রবাসী ভারতীয় দিবস (PBD) পালন করা হয় যেখানে প্রখ্যাত NRI/PIO-দের PBD সম্মান দেওয়া হয় । কয়েকটি রাজ্য সরকারের তরফে তাদের নিজস্ব মানবকল্যাণ সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে প্রায়ই NRI-দের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । যাতে বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়রা, ভারতে তাঁদের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত থাকেন । দেশের বাইরে যে কোনও সমস্যায় পড়লে ভারতীয় দূতাবাসই হল একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম । কখনও তাদের কাছে সাহায্য চাইতে কেউ যেন ইতস্তত না করেন ।

তবে শুধুমাত্র নিজের দেশের নাগরিকদের জন্যই নয়, পড়শি দেশ-সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের কেউও অন্যত্র বিপদে পড়লে সাহায্যের জন্য প্রথমে এগিয়ে এসেছে ভারতই । সম্প্রতি কোরোনা ভাইরাসের জন্য চিন থেকে এবং গত কয়েক বছরে ইয়েমেন, লিবিয়া, লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকের সংঘর্ষদীর্ণ অঞ্চল থেকে ভারতীয় ও অন্যান্য দেশের বাসিন্দাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে । বিদেশে ভ্রমণকারী ভারতীয়দের এটা নিশ্চিত করতেই হবে যে, যে দেশে তাঁরা যাচ্ছেন, সেখানে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের তরফে যেন কোনও নিষেধাজ্ঞা বহাল না থাকে । পাশাপাশি সেখানে যাওয়ার পর যাতে তাঁরা কোনও সমস্যায় না পড়েন, তার জন্য সেখানকার ভারতীয় দূতাবাসের দেওয়া পরামর্শ সবসময় মেনে চলতে হবে।

দিল্লি, 29 ফেব্রুয়ারি : বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের সংখ্যা বর্তমানে 18 মিলিয়নের বেশি । পাশাপাশি বিদেশে বসবাসকারী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বৃহত্তম হওয়ার স্বীকৃতি এখনও ধরে রেখেছে ভারতীয়রা । এই তালিকায় রয়েছেন বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিক এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক । ভারতের বাইরে যে সব দেশের বাসিন্দা তাঁরা, সেই সব দেশের উন্নয়নে তাঁদের ভূমিকা সর্বব্যাপী সমাদৃত । নিজেদের পরিশ্রম, নিয়মানুবর্তিতা ও নিষ্ঠাকে হাতিয়ার করে বিগত কয়েক বছরে তাঁরা সেই সব দেশের যোগ্যতম মানবসম্পদ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন । উত্তর অ্যামেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে ছড়িয়ে থাকা এই ভারতীয়দের কাজের তালিকায় রয়েছে ‘হোয়াইট কলার’ থেকে শুরু করে ‘ব্লু কলার জব’-ও ।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিদেশে বসবাসকারী সবচেয়ে বেশি ভারতীয়রা রয়েছেন যথাক্রমে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি (3.4 মিলিয়ন), অ্যামেরিকা (2.6 মিলিয়ন) এবং সৌদি আরবে (2.4 মিলিয়ন) । সাম্প্রতিক ভারত সফরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অ্যামেরিকার উন্নয়নে সে দেশে বসবাসকারী চার মিলিয়ন প্রভাবশালী ভারতীয়দের ভূমিকার কথা তুলে ধরেছিলেন । উপসাগরীয় দেশগুলিতে মানবসম্পদের নিরিখে আর সকলের তুলনায় ভারতীয়রাই সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং ভারতীয়দেরই বেশি পছন্দ করা হয় । অস্ট্রেলিয়ার ‘অ্যান ইন্ডিয়া ইকোনমিক স্ট্র্যাটেজি টু 2035’-এ অস্ট্রেলিয়া সরকার সে দেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের তাদের জাতীয় অর্থনৈতিক সম্পদ হিসাবে অভিহিত করেছে এবং জানিয়েছে, দেশের সবরকম কর্মকাণ্ডে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হচ্ছে । অস্ট্রেলিয়া সরকার আরও ঘোষণা করেছে যে, এই দ্রুত ক্রমবর্ধমান সম্প্রদায়ের উদ্যোগপতি প্রতিভা, উদ্ভাবনী শক্তি, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস এবং সর্বোপরি ভারতের বাজার সম্পর্কে এদের সম্যক জ্ঞান ভবিষ্যতে অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য ক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা আরও বৃদ্ধি করবে । ভারতের বাইরে যে দেশে ভারতীয়রা রয়েছেন, সেখানে তাঁদের ক্রমবর্ধমান আর্থিক এবং রাজনৈতিক প্রাধান্য আখেরে তাঁদের সেই দেশের অন্যতম প্রভাবশালী কণ্ঠে পরিণত করেছে । বর্তমানে এই ভারতীয়রা একাধিক MNC-র উচ্চ পদে রয়েছেন । যা তাঁদের জন্মভূমি দেশের কাছে সমীহ করার মতো বিষয় । বিদেশে বসবাসকারী এই ভারতীয়দেরই সুবাদে আরও বেশি বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি ভারতে আসছে । বিশেষ করে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি এবং আর্থিক ক্ষেত্রের বিনিয়োগমুখী উন্নয়নে এই ভারতীয়দের বড় ভূমিকা রয়েছে । সবচেয়ে বড় কথা, ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ’ হিসেবে এই ভারতীয়দের বার্ষিক প্রেরিত অর্থ যার মূল্য 60 মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, ভারতীয় অর্থনীতিকে একটি মজবুত ভিত্তি দিতেও সাহায্য করেছে ।

যদিও উপসাগরীয় দেশগুলিতে ‘ব্লু কলার’ চাকুরিজীবীদের শোষণ এবং নিষ্কাশনের কাহিনী খুবই করুণ । এর অন্যতম কারণ নিয়মনীতির অবহেলা, বিবেকহীন লোকবল যোগানকারী এজেন্ট এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসহানুভূতিশীল নিয়োগকর্তা । বেশিরভাগ সময়ই আবার এঁদের ক্ষেত্রে ‘ভিখারিদের কখনও কিছু বেছে নেওয়ার অধিকার থাকে না’—এই প্রচলিত আপ্তবাক্যটিও প্রযোজ্য হয় । স্বপ্নের মোহে বুঁদ ভারতীয় তরুণদের একটা বড় অংশ চাকরির খোঁজে পশ্চিমের দেশগুলিতে যায় । সেখানে গিয়ে তাঁদের স্বপ্নভঙ্গ হয় । পরে তাঁরা অবৈধ অভিবাসী হিসাবে দুঃস্বপ্নের জীবন কাটাতে শুরু করেন । উপসাগরীয় দেশগুলিতে কাজের পারমিটে বেশিরভাগ সময়ই দেশছাড়ার ক্ষেত্রে কড়া নিয়মনীতি থাকে আর কাজের চুক্তিপত্রগুলিও একতরফা হয় । ভারত সরকারের পাসপোর্ট আইন লঙ্ঘণ করে অনেক নিয়োগকর্তাই এদের পাসপোর্টও আটকে রাখে । কোনও সমস্যায় পড়লে পরিচয়পত্র হিসেবে থাকে শুধু আধার কার্ড এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স । মিডলম্যান তথা মধ্যস্থতাকারী এবং এজেন্টরা বেশিরভাগ সময়ই তথ্য লুকোয় এবং চাকরিপ্রার্থীকে বোঝায় বিদেশে চাকরি করা মানেই স্বপ্নপূরণ । তাই, যাতে ঠকতে না হয়, তাই চাকুরিপ্রার্থীদের উচিত আগেভাগে ভারতে রাজ্য সরকারগুলির একাধিক রিসোর্স সেন্টারে যোগাযোগ করে, তাদের পরামর্শ নেওয়া এবং বাড়িতে অন্য দেশে ভ্রমণ এবং চাকরির চুক্তিপত্রের নথির কপিও রেখে যাওয়া । এর পাশাপাশি ভারতে সংশ্লিষ্ট সংস্থার তরফে সঠিক দিশানির্দেশ চেয়ে নেওয়া এবং যাওয়ার আগে আরবি ভাষায় কিছু দরকারি শব্দ ও বাক্য শিখে যাওয়াও জরুরি । চাকরিসূত্রে বিদেশে গমনকারী ভারতীয়দের নিরাপত্তার জন্য তাঁদের পাসপোর্টে ‘অভিবাসন ছাড়পত্র প্রয়োজন’-এর সিলমোহর দেওয়া থাকে, যা বেশ কয়েক দফা পরীক্ষা করার পরই পাওয়া যায় প্রোটেক্টরেট জেনারেল অফ ইমিগ্রান্টস-এর তরফে । বর্তমানে এই বিষয়টি বিদেশ মন্ত্রকের অন্তর্গত । বিওরো অফ ইমিগ্রেশনের সহযোহিতায় ‘ই-মাইগ্রেট’ সিস্টেমের মাধ্যমে একটি সক্রিয় ডেটাবেসও প্রস্তুত করা হয়, যেখানে বিদেশি নিয়োগকর্তাদেরও নাম, ধাম নথিভুক্ত করা হয়, যাতে প্রয়োজনে যোগাযোগ করা যায় । ভারতীয় দূতাবাসগুলির তরফে একটি ভারতীয় সম্প্রদায় কল্যাণ তহবিলও পরিচালনা করা হয়, যা বিদেশে বিপদের সম্মুখীন হওয়া বা আটকে পড়া ভারতীয়দের আপদকালীন সাহায্য করতে পারে । তাঁদের নিয়োগকর্তা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে দ্রুত সমন্বয় সাধন করে । এরকম বহু ঘটনা ঘটেছে যে বিদেশে কর্মরত ভারতীয় পরিচারিকা এবং সেবিকাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে এবং তখন এই সব দূতাবাসের তরফে তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আশ্রয়ও দেওয়া হয়েছে । যাঁরা যাঁরা বিদেশে কাজের খোঁজ করছেন, তাঁদের প্রত্যেককে বিমার বন্দোবস্ত অবশ্যই করতে হবে, যা তাঁদের সে দেশ থেকে হঠাৎ চলে আসতে বা প্রয়োজনে কাজের চুক্তি ভাঙতে সাহায্য করবে ।

নারীকল্যাণের ক্ষেত্রে বিশেষ বন্দোবস্ত করা হয়েছে । যদি কারও বয়স তিরিশের নিচে হয় শুধুমাত্র তাহলেই তার নিয়োগকর্তা জামানত এবং সর্বনিম্ন প্রতিশ্রুত মজুরির যোগান দেন । বিদেশে চাকরিসূত্রে পাড়ি দেওয়ার আগে কাজের জায়গা সম্পর্কে সঠিক ও যথাযথ দিশার খোঁজ রাখা এবং দক্ষতা অর্জনের বন্দোবস্ত PPP ফরম্যাটের আওতায় করা হয় । কিন্তু এত সব সতর্কতা সত্ত্বেও কিছু অপ্রত্যাশিত এবং অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেই যায় । আর তা নিয়ন্ত্রণ করতে ভারত সরকার সেই সব দেশের সঙ্গে MOU এবং দ্বিপাক্ষিক নানা ধরনের চুক্তি সই করেছে, যাতে বিদেশে কর্মরত ভারতীয়দের সঙ্গে কোনও বৈষম্য না করা হয় । সেজন্য নিয়মিত ভিত্তিতে কনসুলার স্তরে আলোচনারও আয়োজন করা হয় । যেখানে চর্চার মুখ্য বিষয়ই হল বিদেশে কর্মরত ভারতীয়দের সঙ্গে কোনও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটলে এবং দ্রুত সাহায্যের ব্যবস্থা করা না গেলে, কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত । প্রায়ই তাদের তরফে মুক্ত আলোচনা চক্রের আয়োজন করা হয়, যেখানে যে কেউ অংশ গ্রহণ করতে পারেন এবং দ্রুত সাহায্যের ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে বক্তব্য রাখতে পারেন । এর 24x7 জরুরি যোগাযোগের ব্যবস্থাও সকলের জন্যই খোলা । প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী প্রয়াত সুষমা স্বরাজ ভারতীয় দূতাবাসগুলিকে ‘বাড়ি থেকে দূরে আর একটি বাড়ি’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন । বিদেশে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক ভারতীয়দের একজনও, কখনও কোনও বিপদে পড়লে ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করে তাঁর সমস্যা সমাধান করাকে নিজের লক্ষ্যে পরিণত করে ফেলেছিলেন । বর্তমান বিদেশমন্ত্রী সেই গুরুদায়িত্ব দ্বিগুণ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন । প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের কল্যাণে বিশেষ নজর দিয়েছেন এবং যে কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে তাঁদের সঙ্গে দেখা করা ও কথা বলা সুনিশ্চিত করেন ।

বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে এবং তাঁদের সঙ্গে আবেগ নির্ভর, আত্মিক যোগসূত্র গড়ে তুলতে প্রবাসী ভারতীয় দিবস (PBD) পালন করা হয় যেখানে প্রখ্যাত NRI/PIO-দের PBD সম্মান দেওয়া হয় । কয়েকটি রাজ্য সরকারের তরফে তাদের নিজস্ব মানবকল্যাণ সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে প্রায়ই NRI-দের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । যাতে বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়রা, ভারতে তাঁদের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত থাকেন । দেশের বাইরে যে কোনও সমস্যায় পড়লে ভারতীয় দূতাবাসই হল একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম । কখনও তাদের কাছে সাহায্য চাইতে কেউ যেন ইতস্তত না করেন ।

তবে শুধুমাত্র নিজের দেশের নাগরিকদের জন্যই নয়, পড়শি দেশ-সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের কেউও অন্যত্র বিপদে পড়লে সাহায্যের জন্য প্রথমে এগিয়ে এসেছে ভারতই । সম্প্রতি কোরোনা ভাইরাসের জন্য চিন থেকে এবং গত কয়েক বছরে ইয়েমেন, লিবিয়া, লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকের সংঘর্ষদীর্ণ অঞ্চল থেকে ভারতীয় ও অন্যান্য দেশের বাসিন্দাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে । বিদেশে ভ্রমণকারী ভারতীয়দের এটা নিশ্চিত করতেই হবে যে, যে দেশে তাঁরা যাচ্ছেন, সেখানে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের তরফে যেন কোনও নিষেধাজ্ঞা বহাল না থাকে । পাশাপাশি সেখানে যাওয়ার পর যাতে তাঁরা কোনও সমস্যায় না পড়েন, তার জন্য সেখানকার ভারতীয় দূতাবাসের দেওয়া পরামর্শ সবসময় মেনে চলতে হবে।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.