নয়াদিল্লি: চলতি বছরের জুন মাসে লাদাখ অঞ্চলে ভারত ও চিনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী বিবাদ ঘটে ৷ এশিয়ার দুই মহা শক্তিধর দেশের মধ্যে সীমান্ত বরাবর এই সংঘাতে 45 বছর পর প্রাণহানি হয় ৷ তার পর অবশ্য উত্তেজনা প্রশমনে সেনা সরানোর কাজ শুরু হয়েছে ৷ তবে এর মধ্যেই নয়াদিল্লি বেজিংয়ের এই সম্প্রসারণবাদ নীতিকে ধুয়ে ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা করছে ৷
খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, ভারতে নতুন নামকরণ হওয়া শিক্ষামন্ত্রক ভারতের স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সহযোগিতায় চিনের যে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট চলে, কার পাঠক্রম পর্যালোচনা করে দেখতে চায় ৷
চিনের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্য দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি শিক্ষাগত অংশীদারিত্বই হল কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট ৷ অংশীদারিত্বের টাকার যোগান এবং ব্যবস্থা করার কাজ কিছুটা করে হ্যানব্যান (সরকারি ভাবে চাইনিজ ল্যাঙ্গুয়েজ কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনাল-এর কার্যালয়) ৷ যা চিনের শিক্ষা মন্ত্রকের অধীনে রয়েছে ৷
এই কর্মসূচির ঘোষিত উদ্দেশ্য হল চিনা ভাষা ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরা ৷ স্থানীয় চিনা শিক্ষাদানকে আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে আনা ৷ আর সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের বৃদ্ধি করা ৷ যে সমস্ত দেশে এই সংগঠন কাজ করে সেখানে চিনের প্রভাবের দরুণ তারা মারাত্মক সমালোচনার মুখে পড়েছে ৷
কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট কর্মসূচির সূচনা হয় 2004 সালে ৷ এটাতে সহায়তা করে হ্যানব্যান ৷ আর তদারকির দায়িত্বে রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ৷ এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বজুড়ে স্থানীয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কাজ চালায় ৷ অর্থের বিষয়টি হ্যানব্যান ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ভাগাভাগি করে নেওয়া হয় ৷
ফ্রান্সের অ্যালায়েন্স ফ্রাঞ্চাইজ়ি এবং জার্মানির গোথে ইনস্টিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠান, যারা সংশ্লিষ্ট দেশের স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার কাজ করে, বেজিং তাদের কনফুসিয়াস প্রকল্পকে তাদের সঙ্গেই যুক্ত করতে চায় ৷ যদিও অ্যালায়েন্স ফ্রাঞ্চাইজি ও গোথে ইনস্টিটিউট অন্যান্য দেশে স্বাধীন ভাবে কাজ করে ৷ কিন্তু কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট অন্য দেশের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এই কাজ করতে চায় ৷ আর এর জন্য টাকা দেয় চিনা সরকার ৷
বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, কনফুসিয়াস ইনস্টটিউট কর্মসূচি চিনের ‘তীক্ষ্ণ শক্তির’ সম্প্রসারণবাদ নীতির অংশ ৷
তীক্ষ্ণ শক্তি হল লক্ষ্যের মধ্যে থাকা কোনও একটি দেশের কূটনৈতিক নীতিকে বিভ্রান্ত করে দেওয়া এবং রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া ৷
এই কথাটি চালু করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি ৷ গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রশক্তির প্রকাশে স্বৈরাচারী সরকার দ্বারা যে আক্রমণাত্মক ও বিধ্বংসী নীতি প্রয়োগ করা হয়, তাকে ব্যাখ্যা করতেই এই কথাটির প্রচলন করা হয় ৷ এমন নীতি, যে কঠিন শক্তি বা নরম শক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় ৷
ভারতের শিক্ষা মন্ত্রক এখন যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ও চিনা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট তৈরিতে যে সমঝোতা স্মারক (MoU) সাক্ষরিত হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখার পরিকল্পনা করছে ৷
ETV ভারত-এর সঙ্গে কথা বলার সময় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর চাইনিজ অ্যান্ড সাউথ ইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের চেয়ারম্যান বি আর দীপক বলেন যে অন্যান্য দেশের উদার ব্যবস্থায় প্রবেশ করার জন্য চিনের দ্বারা কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটকে ব্যবহার করা হয় ৷
2005 সালে JNU এবং পেকিং বিশ্বিবদ্যালয়ের মধ্যে একটি এই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির অংশীদারিত্ব হয় একটি চুক্তি হওয়ার পর ৷ তবে পাঁচ বছর পর সেই চুক্তি বাতিল হয়ে যায় ৷
যদিও পেকিং বিশ্ববিদ্যালয় এই চুক্তি এগিয়ে নিয়ে যেতে খুবই আগ্রহী ছিলেন ৷ কিন্তু JNU-এর তরফে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে এটা ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশনের অধীনে কাজ করে এবং এই ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরি করার কাজে তারা এগোতে পারবে না ৷
দীপক বলেন, ‘‘JNU সরকারি ভাবে হ্যানব্যান এবং চিনা দূতাবাসের (নয়াদিল্লিতে অবস্থিত) সঙ্গে যোগাযোগ করে ৷ আর জানিয়ে দেয় যে তারা এই ধরনের কোনও প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারবে না ৷’’
মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়, ভেলোর ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, জলন্ধরের লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটি, সোনেপতের ও পি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি, কলকাতার স্কুল অফ চাইনিজ ল্যাঙ্গুয়েজ, কোয়েম্বাটুরের ভারতীয়ার বিশ্ববিদ্যালয় এবং গুরুগ্রামের কে আর মঙ্গলম বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের পর্যালোচনা শিক্ষা মন্ত্রক করবে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে ৷
চিনা প্রতিষ্ঠান তৈরিতে বেসরকারি ও কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পৃথক মাপকাঠি থাকা উচিত নয় বলেই JNU প্রথম বিষয়টি UGC-র নজরে আনে ৷
দীপক বলেন, ‘‘এখন শিক্ষা মন্ত্রক এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে ৷ এখানে একটা একই রকমের নীতি হওয়া উচিত ৷’’
সারা বিশ্বজুড়ে 500 টি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট রয়েছে ৷ শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছে 100 টি বিশ্ববিদ্যালয় ৷
যদিও এই প্রতিষ্ঠানগুলির নাম খারাপ হচ্ছে ৷ কারণ, বেজিং এর মাধ্যমে তাঁদের তীক্ষ্ণ শক্তি নীতি বৃদ্ধি করতে চাইছে ৷
দীপক বলেন, ‘‘চাকরির সুযোগ দেওয়ার জন্য এই ধরনের প্রতিষ্ঠান শ্রীলঙ্কা, নেপালের মতো ছোট দেশ, মধ্য এশিয়া এবং বালকান দেশগুলিতে তৈরি করা হয় ৷’’
তিনি বলেন, ‘‘চিন সরকারের নিয়ম অনুযায়ী যদি কারও নাম কনফিউসিয়াস ইনস্টিটিউট সুপারিশ করে, তবেই তিনি চিনের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পাবেন ৷ যদিও তারা বিভিন্ন বিষয়ে বৃত্তি দেওয়ার দাবি করে থাকে ৷ তবে তা মূলত দেওয়া হয় চিনা ভাষাতেই ৷’’
দীপক বলেন যে আফ্রিকা থেকে দশ হাজারেরও বেশি পড়ুয়া চিনের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বৃত্তির জন্য আবেদন করে ৷ কারণ, বেজিং ওই মহাদেশে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে চাইছে ৷
এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘‘এখন ভারত চিনের এই তীক্ষ্ণ শক্তির সম্প্রসারণবাদ নীতিকে ভোঁতা করে দিতে চাইছে ৷’’
প্রতিবেদনটি লিখেছেন অরুণিম ভুইয়াঁ ।