দিল্লি, 17 মার্চ : সারা পৃথিবী যখন প্যানডেমিক COVID 19-এর মোকাবিলায় ব্যস্ত, তখন ভারত ও ইন্দোনেশিয়া চেষ্টা করছে গত কয়েক সপ্তাহে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তৈরি হওয়া মতানৈক্য দূর করতে ৷ এক পক্ষকাল আগে জাকার্তায় ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রদীপকুমার রাওয়াতকে ডেকে পাঠানো হয় ইন্দোনেশিয়ার বিদেশ মন্ত্রক থেকে ৷ সেখানে তাঁর কাছে ইন্দোনেশিয়ার তরফে দিল্লি হিংসা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় ৷ যে হিংসায় অন্তত 50 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ আর মৃতদের মধ্যে অধিকাংশ মুসলিম ৷ গত দুই সপ্তাহে জাকার্তা এবং মেদানে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের সামনে বড়সড় বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে ৷ FPI, GNPF এবং PA212-এর মতো কট্টর ইসলামিক সংগঠনগুলি ওই বিক্ষোভ সংগঠিত করেছিল ৷ এর আগে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একটি যৌথ বিবৃতিতে ওই তিন সংগঠনের তরফে বলা হয়, "ভারত সরকারের কাছে নাগরিকত্ব আইন প্রত্যাহারের আর্জি জানানো হচ্ছে ৷ কারণ, ওই আইনকে হাতিয়ার করে হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলি ভারতীয় মুসলিমদের উপর দমন পীড়ন চালাচ্ছে ৷"
যদিও ইন্দোনেশিয়ার সূত্র থেকে দাবি করা হয়েছে যে, ভারতের রাষ্ট্রদূতকে শুধুমাত্র তাদের উদ্বেগের বিষয়টি জানানোর জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছিল এবং জাকার্তা মনে করে ভারত তার অন্তর্দেশীয় সমস্যাকে দূর করতে সমর্থ হবে ৷ একজন ইন্দোনেশীয় আধিকারিক বলেন, "কিছু সামাজিক সংগঠন এবং অন্যান্য কয়েকটি সংগঠন বার্তা দিতে চেয়েছিল এবং সেই বার্তাই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে (ভারত সরকারের কাছে) ৷ মানুষ চিন্তিত, কিন্তু যেহেতু আমাদের দুই দেশই গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী দেশ, তাই ইন্দোনেশিয়া আশাবাদী যে আমরা এই সমস্যা ঠিক কাটিয়ে উঠব ৷"
এটা জানা গিয়েছে যে, CAA এবং NRC বিরোধী প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি ভারতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল ৷ কিন্তু দিল্লির হিংসায় প্রাণহানি এবং দাড়ি রাখা ও টুপি পরার অভিযোগে মহম্মদ জুবের নামে এক মুসলিম ব্যক্তিকে দক্ষিণপন্থীদের মারধরের ঘটনা ইন্দোনেশিয়াকে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে অনুঘটকের কাজ করে ৷
কিন্তু কয়েকটি সূত্র আশাবাদী যে, পরের শুক্রবার জাকার্তায় সেভাবে আর বিক্ষোভ হবে না ৷ প্যালেস্টাইন নিয়ে মার্কিন দূতাবাসে বিক্ষোভের ঘটনার পর থেকে যেকোনও দূতাবাসে নিরাপত্তার ব্যবস্থা আঁটোসাঁটো করা হয় ৷ তারপরও অভূতপূর্বভাবে গত শুক্রবার ভারতীয় দূতাবাসের বাইরে 1100 পুলিশ আধিকারিক নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হয় এবং ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা ঘিরে সমস্ত গাড়িকে অন্যপথে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় ৷
MUI (ইন্দোনেশিয়া উলেমা কাউন্সিল)-এর মতো যে ইসলামিক সংগঠনগুলি এখনও পথে নামেনি, তাদের সঙ্গে দিল্লি কথা বলবে বলে আশা করা হচ্ছে ৷ যাতে ভারতীয় মুসলিমদের নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি সম্পর্কে ওই সংগঠনগুলি আলোচনা করতে পারে ৷ আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ম মেনে ভারতীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার জন্য সম্প্রতি রাষ্ট্রসংঘকে চিঠি লিখেছিল MUI ৷ ওই চিঠিতে আসল সত্যি জানার জন্য ভারতে অনুসন্ধানকারী দল পাঠানোর আর্জিও জানিয়েছিল তারা ৷ এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছিল যে, CAA বৈষম্যমূলক এবং জম্মু ও কাশ্মীর বিষয়ে ভারত সরকারের উচিত গণভোট-সহ UNSC-এর রেজ়োলিউশন মেনে নেওয়া ৷ ওই বিবৃতিতে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল যে, ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমরা ভারতের সব প্রোডাক্ট বয়কট করবে এবং ওই বিবৃতিতে সরকারের কাছেও দিল্লির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার দাবি জানানো হয় ৷
গত কয়েক বছরে কাশ্মীর নিয়ে OIC (ইসলামিক দেশগুলির সংগঠন)-তে ভারতের প্রতি সবসময় সংবেদনশীল এবং সমবেদনামূলক আচরণ করেছে ইন্দোনেশিয়া ৷ UNSC-এর তরফে জঙ্গি মাসুদ আজ়হারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সমর্থন করে ইন্দোনেশিয়া ৷ তারাই প্রথম দেশ, যারা পুলওয়ামা হামলার প্রতিবাদ করেছিল ৷ ভারতে প্রতিবাদ ও উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে জাকার্তার আধিকারিকদের প্রতিক্রিয়া খুবই সুক্ষ বলে সূত্রের দাবি ৷ জাকার্তায় ভারতের রাষ্টদূত এই সপ্তাহে ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে পারেন, যিনি MUI-এর সদস্য ৷ এর থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে ৷ 2018 সালের অক্টোবরে ভারত ও ইন্দোনেশিয়া একটা ইন্টার-ফেইথ ডায়ালগ শুরু করেছিল ৷ যেটা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ৷ কিন্তু হয়নি ৷ সূত্র বলছে যে, এই বছর ওই ডায়ালগের পরবর্তী পর্যায় ভারতে আয়োজিত হতে পারে ৷ সেখানে ধর্মীয় গোলমাল নিয়ে তৈরি হয় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এই উত্তেজনা কিছুটা হলেও প্রশমিত হতে পারে ৷
কোরোনা ভাইরাস যেভাবে গোটা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করেছে, এই পরিস্থিতিতে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে সবরকম দ্বিপাক্ষিক কর্মসূচিকে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷ এর মধ্যেই ছিল বিদেশমন্ত্রক সংক্রান্ত আলোচনা ৷ নিরাপত্তা সংক্রান্ত দ্বিতীয় বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, যেখানে NSA অজিত ডোভাল এবং ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতি, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার সমন্বয় মন্ত্রীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল ৷ এখন দূতাবাসের প্রাথমিক লক্ষ্য হল বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করা ৷
সরকারি একটি সূত্রের বক্তব্য, "ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন আরও দৃঢ় করাই ইন্দোনেশিয়ার বিদেশনীতির অন্যতম লক্ষ্য ৷"
আন্তর্জাতিক সূত্র থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে ভারতীয় মিডিয়া দাবি করেছিল যে, দিল্লি হিংসায় টাকা দিয়ে মদত দিয়েছে ইন্দোনেশিয়ার একটি NGO ACT (Aksi Cepat Tanggap) ৷ কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার ওই সূত্র এই দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছে ৷ এদিকে ACT-এর তরফেও এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে ৷ সূত্রের দাবি, সরকারিভাবেও এই অভিযোগ তোলা হয়নি বা কোনও প্রমাণও দেওয়া হয়নি ৷
স্মিতা শর্মা