আমার সঙ্গে শ্রী পি ভি নরসিমা রাওয়ের প্রথম পরিচয় ১৯৮৮ সালে । তখন তিনি বিদেশমন্ত্রী আর আমি সাউথ কমিশনে সেক্রেটারি জেনেরাল। সেই সময় তিনি জেনিভায় গিয়েছিলেন। ওখানেই আমাদের সাক্ষাৎ। তার পর ১৯৯১ সালে যেদিন সরকার গঠন হল, শ্রী পি ভি নরসিমা রাও আমায় ফোন করলেন । বললেন, “আসুন। আমি চাই, আপনি অর্থমন্ত্রী হন ।” অনেক মুখ অবাক হয়ে দেখল, আমি রাষ্ট্রপতিভবনে অর্থমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিচ্ছি । তবে অর্থমন্ত্রীর পদে শপথ নেওয়ার আগে আমি শ্রী নরসিমা রাওকে একটা কথা বলেছিলাম। আর সেটা হল, আমি তখনই এই পদের দায়িত্বভার সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করব যদি তাঁর পূর্ণ সমর্থন পাই । উত্তরে সামান্য মজার ছলে তিনি বললেন, “আপনি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন। যদি আপনার নেওয়া কর্মসূচি সফল হয়, কৃতিত্বটা আমরা দু’জনে ভাগ করে নেব। আর যদি ব্যর্থ হয়, আপনি বিদায় নেবেন ।” শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের জন্য একটি বৈঠক ডেকেছিলেন । আমি তাঁদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সংক্ষেপে জানিয়েছিলাম । বিরোধীদের হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল, সব শুনে ওঁরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন । প্রধানমন্ত্রী আমাকে অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনের জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন ।
হঠাৎ করে একদিনে কিন্তু সমস্ত অর্থনৈতিক সংস্কার ঘটে যায়নি । কোনও দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেপথে্য না থাকলে ঐতিহাসিক সেই পরিবর্তন হওয়া সম্ভব ছিল না । প্রথম যে রাজনৈতিক নেতা এই সত্য অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, সামাজিক ন্যায়বিচারের পাশাপাশি আর্থিক অগ্রগতির হার ত্বরান্বিত করতে আর্থিক কর্মসূচিকে ঢেলে সাজাতেই হবে, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি । তাঁর নেওয়া প্রাথমিক পদক্ষেপগুলিকেই পরে শ্রী রাজীবজি (রাজীব গান্ধি) এগিয়ে নিয়ে যান। কারণ নতুন তথে্যর যুগের সূচনা যে হতে চলেছে, তার গুরুত্ব তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আর ১৯৮০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে কংগ্রেস সরকারের আমলে সেই অভিমুখেই অর্থনৈতিক সংস্কারগুলিকে চালিত করা হয়েছিল । এর পুরোধা ছিলেন শ্রী রাজীব গান্ধি ।
যে নির্ভীক মনোভাবের সঙ্গে শ্রী নরসিমা রাওজি অর্থনৈতিক সংস্কারের জাল বিস্তার করার গুরত্ব অনুধাবন করেছিলেন, তার জন্য আমাদের তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত। ১৯৯১ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরসিমা রাও—র নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার গঠন করে, আমি ছিলাম অর্থমন্ত্রীর ভূমিকায়। তখন থেকেই অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনের প্রক্রিয়া শুরু হয় । প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওজির নেতৃত্বে অর্থনীতি এবং বিদেশ নীতি নিয়ে আমরা যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে সমর্থ হয়েছিলাম। আমাদের নেওয়া তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কারগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তাদের ভারতীয় অভিজ্ঞতালব্ধ হওয়ার অভিনবত্ব। আমরা কোনও চেনাজানা ছকে হাঁটিনি । আমার মনে আছে, IMF-এর তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর মি. মাইকেল ক্যামডেসাস এবং প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওর সেই বৈঠকের কথা। নরসিমা রাওজি তাঁকে বলেছিলেন যে ভারতে যে কোনও সংস্কার ভারতীয় নাগরিকদের চিন্তা, উদ্বেগের কথা মাথায় রেখেই হওয়া উচিত। আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক। তাই দেশের খেটে খাওয়া নাগরিকদের স্বার্থ আমাদের রক্ষা করতেই হবে। আমরা IMF-কে জানিয়েছিলাম, আমাদের ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’—এর জন্য পাবলিক সেক্টরগুলিতে কর্মরত কোনও একজনও কাজ হারাক, তা আমরা মেনে নেব না। আমি মনে করি, আমরা এই মর্মে আশ্বাস দিতে পেরেছিলাম যে সংস্কার এমন হওয়া উচিত যা আমাদের নাগরিক অগ্রাধিকারকে গুরুত্ব দেয়।
প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওজি ভারতের বিদেশনীতিতে বাস্তবতার ছোঁয়া এনেছিলেন। পড়শি দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে রাওজি চিন সফর করেন, আমাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে তৈরি হওয়া কিছু তিক্ততার অবসান ঘটাতে। ভারত SAARC—ভুক্ত অন্য দেশগুলির সঙ্গে ‘সাউথ এশিয়ান প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট’ সই করে। ভারতের সঙ্গে এশিয়ার পূর্ব এবং দক্ষিণ—পূর্বের একাধিক দেশকে তিনিই এক সূত্রে গেঁথেছিলেন। আর তাঁর নেওয়া এই পদক্ষেপই পরে ভারতের ‘পূবে তাকাও নীতি’ হিসাবে বহুল পরিচিত হয়েছে।
নরসিমা রাওজির নেতৃত্বেই সরকার উচ্চাভিলাষী ‘ব্যালিস্টিক মিসাইল টেকনোলজি’ প্রোগ্র্যাম চালু করেছিল এবং বর্হি—নিরাপত্তার ভিত মজবুত করতে ১৯৯২ সালে ‘অগমেন্টেড স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল’ (ASLV) এবং ‘পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল’ (PSLV)—এর সফল পরীক্ষা করেছিল। ১৯৯৪ সালে পৃথ্বী ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম সফল পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে একে মধ্যবর্তী পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলরূপে গড়ে তোলা হয়।
ভারতের এই মহান পুত্র, যিনি নানাভাবে আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন ‘ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ডগাইড–সেই নরসিমা রাওজির স্মৃতিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। যতটা ঘনিষ্ঠভাবে আমি তাঁকে দেখেছি, আমার মনে হয়েছে, তিনি সতি্যই রাজনীতিতে এক সন্ন্যাসী ছিলেন। আধুনিকমনস্ক হয়েও তিনি আমাদের দেশের ঐতিহ্য এবং ভাবাদর্শের সঙ্গে তাল রেখে চলেছিলেন। বিরল গোত্রের পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। আর ছিলেন এমন একজন রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি শুধু আমাদের অর্থনীতি নয়, বিদেশনীতিকেও নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন। বিভিন্ন ভাষার উপর তাঁর দক্ষতা কেবলমাত্র তাঁর ভাষাতাত্ত্বিক ক্ষমতার পরিচয় দেয় না। বরং তা তাঁকে সহজাত এবং বাস্তবিকভাবেই করিমনগর, পুণে, বেনারস এবং দিল্লিতে একজন সর্বভারতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল।