জাতীয় শিক্ষানীতি অর্থাৎ NEP 2020 একটি অত্যন্ত গভীর ও উচ্চাভিলাষী দলিল। এই দলিল নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল ও আশাবাদী এক ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তৈরি। শিক্ষানীতি প্রবর্তক কমিটির কয়েক জনের সঙ্গে দেখা হওয়া এবং এই বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করার সূত্রে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে, এটি একেবারেই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তৈরি। এটা একইসঙ্গে স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিতও বটে। এই কমিটির যে কয়েক জনের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে তাঁদের মধ্যে, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডক্টর কে কস্তুরিরঙ্গন এবং ডক্টর এম কে শ্রীধর মাকাম অন্যতম। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শ্রীধরের পড়াশোনা বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে এবং তিনি এখন বেঙ্গালুরুর একটি রিসার্চ এবং উচ্চশিক্ষার নীতিনির্ধারক কেন্দ্রের অধিকর্তা। কিন্তু এই কমিটির যে নামটি আমায় সবচেয়ে চমকে দিয়েছে সেই নামটি হল মঞ্জুল ভার্গভের। মঞ্জুল প্রিন্সটনের অঙ্কের অধ্যাপক এবং ফিল্ডস মেডেল জয়ী। তিনি নিজের অসাধারণ অঙ্কসত্ত্বার পিছনে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেছেন।
ভারতের মতো এক বিশালবপু জলহস্তীকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা তর্কাতিতভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও এর সাফল্য কিন্তু নির্ভর করবে যথেষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ এবং বহু মানুষের সহযোগিতার মাধ্যমেই। একটা কথা সেই আদিকাল থেকেই প্রচলিত যে, একটা নীতি তত ক্ষণই ভালো যত ক্ষণ তার প্রয়োগ সঠিকভাবে হবে।
উচ্চশিক্ষার কথা বলতে গেলে প্রথমেই বেশ কিছু আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর যায়।
দলিলের প্রথমেই উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন শাখার অনমনীয় অবস্থানের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। আমরা যারা দেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি এবং এখনও যারা পড়ে চলেছে, তারা জানি উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন শাখা যেন শাশ্বতকাল ধরে একই ধারায় বয়ে চলেছে। কলা বিভাগ, বাণিজ্য শাখা এবং বিজ্ঞান— এই তিন শাখা সেই হাইস্কুল থেকে যেন আমাদের চরিত্র গড়তে শুরু করে এবং বহুলাংশে আমাদের জীবনেই ছাপ ফেলে যায়। পরীক্ষা নির্ভর এই শিক্ষা ব্যবস্থা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দান যা আমরা এখনও বয়ে চলেছি। এই শিক্ষা ব্যবস্থা ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল বাদামি চামড়ার মানুষদের অসাধারণ কর্মীতে পরিণত করতে। এই ব্যবস্থার আজও কোনও পরিবর্তন হয়নি। এই বিশাল সময়ে বিশ্ব কিন্তু অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। বিশ্ব এখন পৌঁছে গিয়েছে একুশ শতকের সাধারণ জ্ঞানের দুনিয়ায়। যেখানে স্ট্যানফোর্ডের ল্যাবে অঙ্ক, সঙ্গীত এবং সাহিত্য হাত ধরাধরি করে চলে, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট চলে সিলিকন ভ্যালির উদ্ভাবনী সংস্কৃতিকে ভর করে। নতুন এই দলিলের অন্যতম মূল লক্ষ্য হল বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয় সাধন, যার হাত ধরে অবশেষে আমরা, অর্থাৎ ভারতীয় উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা যেন একুশ শতকের জ্ঞানের আলোয় ঘুম ভেঙে উঠছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শাখার মধ্যে রিসার্চ ও পড়াশোনার মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টা কমিটির সদস্যদের মস্তিষ্ক থেকে একেবারে স্বাভাবিক বিষয়ের মতোই এসেছে। শুধুমাত্র বিভিন্ন শাখার পড়াশোনার মধ্যে কঠিন বা অনমনীয় বিভেদই নয়, পড়াশোনা ও রিসার্চের ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর মেরুকরণ উনবিংশ শতকের ঔপনিবেশিক মডেলেরই দান। পড়াশোনার বিষয়টা হত কলেজে এবং রিসার্চের বিষয়টা হয় সুনির্দিষ্ট কিছু সংস্থায়, তা সে এশিয়াটিক সোসাইটি হোক বা বিজ্ঞানের পরীক্ষা করার জন্য নির্দিষ্ট কোনও কেন্দ্র। আলেকজান্ডার ভন হামবোল্টের জার্মান মডেল রিসার্চ এবং পড়াশোনাকে এক ছাতার তলায় আনে। এর থেকেই অণুপ্রাণিত হয় বিংশ শতকের মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। খুব অল্প সংখ্যক ব্যতিক্রম বাদ দিলে এই বিষয়টা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অনুপস্থিত। NEP 2020 ঠিক এই জায়গায় আলোকপাত করেছে। নতুন শিক্ষানীতিতে সব শাখার পড়াশোনা ও রিসার্চ এক জায়গায় আনার বহু দিনের দাবিকে মান্যতা দিয়েছে। যেমন হিউম্যানিটিজ শাখার সঙ্গে STEM শাখা, অর্থাৎ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অঙ্কর সংযুক্তি।
একই ছাদের তলায় সমমনস্ক বা সমগোত্রীয় শাখাগুলির সমন্বয় সাধন, পড়াশোনা এবং রিসার্চের জন্য ভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনও অনে পথ পেরোতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন পেশাদার মানসিকতারও। এর জন্য প্রয়োজন উচ্চ পর্যায়ের রিসার্চ, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতের শিক্ষকরা প্রশিক্ষিত হতে পারবেন। যে জাতীয় রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাকেই এই গুরুদায়িত্ব বহন করতে হবে।
এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা মনে রেখে এটা আশা করাই যায় যে, রিসার্চ ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হবে। এবং এ ক্ষেত্রে একেবারেই হতাশ করেনি NEP। আন্দ্রে বেতেইলে এক বার বলেছিলেন যে, ভারতে ডক্টরাল সংস্কৃতি আসলে প্রশিক্ষিত অক্ষমদের উৎপাদন করে। সেই কথা যেন মনে করিয়ে এবং ভারতে রিসার্চ সংস্কৃতির করুণ অবস্থার কথা মাথায় রেখে বরাদ্দের বিষয়টি খুব সুনির্দিষ্ট ভাবে নতুন শিক্ষানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিষয়টির প্রয়োজন ছিল খুবই বেশি। তবে এই বিষয়টি এমনই, যা রাতারতি বদলে ফেলা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের দায়িত্বের চেয়েও গোটা সংস্কৃতির বদলটা জরুরি। আর এই জন্যই এই বিষয়টির সাফল্য আগে থেকে গণনা করা কার্যত অসম্ভব।
উচ্চশিক্ষা নীতির নকশার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি সম্ভবত স্নাতক স্তরের পড়ুয়াদের ডিগ্রি পাঠক্রমের মধ্যে বিভিন্ন স্তরে কোর্স শেষ করার সুবিধার বিষয়টি। আমার সব সময়েই মনে হয়েছে যে, ভালো স্নাতক স্তরের পড়াশোনার জন্য কোর্সের মেয়াদ চার বছর হওয়া উচিত। নতুন শিক্ষানীতির ফলে আমার মনের সেই ইচ্ছাটাই যেন বাস্তবায়িত হল। চার বছরের প্রতি বছরের শেষে ডিপ্লোমা, অ্যাডভান্সড ডিপ্লোমা, এবং তিন ও চার বছরের B.A ডিগ্রির বিষয়টি তাই খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে ষথেষ্ট চিন্তার জায়গাও থাকছে। সবচেয়ে বেশি চিন্তার বিষয়টি হল, এক বছর কলেজে পড়াশোনা করে পড়ুয়া ঠিক কতটা শিক্ষা লাভ করবে? আমাদের সময়ও, যখন B.A./B.Sc/B.Com পাশ ও অনার্স কোর্সে পড়াশোনা হত, তখনও পাশের ছাত্রছাত্রীদের দুই বছর কলেজে কাটাতে হত এবং সে ক্ষেত্রেও অনেকেই মনে করতেন যে, শিক্ষা অপূর্ণ থাকত। আমি আশা করব যে, এই এক বছরে কলেজ থেকে সার্টিফিকেট নেওয়ার এই পদ্ধতির ভুল প্রয়োগ হবে না।
সবশেষে যেটা উল্লেখযোগ্য তা হল, নতুন নীতি অনুযায়ী বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, অর্থাৎ র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম একশোয় থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এ দেশে তাদের ক্যাম্পাস তৈরি করতে পারবে। এটা একটা বিশাল পদক্ষেপ, বিশেষ করে ভারতীয় উচ্চশিক্ষার উদারীকরণ আর তার প্রভাবের ক্ষেত্রে। তবে এই পদক্ষেপ কতটা সফল হবে, তা এখনই বলে দেওয়া এক কথায় অসম্ভব। দেশীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে এর প্রভাব যা-ই হোক না কেন, পশ্চিমের বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি, বিশেষ করে আমেরিকা ও ব্রিটেনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তের প্রভাব বিশাল। তার কারণ, বহু বিদেশি নামজাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন অর্থ ও ছাত্র সঙ্কট। এর অন্যতম কারণ সে সব দেশের সরকারি নীতি। এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের অন্যতম অংশ বিদেশি ছাত্রছাত্রী। ভারতের বিশাল বাজারে বিদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য দরজা খুলে গেলে তা বহু বিনিয়োগ আনতে পারবে তো বটেই, তা এই সব প্রতিষ্ঠানের আয়ের দরজাও খুলবে। সিঙ্গাপুরের Yale-NUS বা মধ্য এশিয়ায় নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির একাধিক ক্যাম্পাস ইতিমধ্যেই উদাহরণ স্থাপন করেছে। এ সব কারণেই টাইমস হায়ার এডুকেশন ভারতীয় উচ্চশিক্ষার উদারীকরণ নিয়ে বিশদ প্রবন্ধ ছেপেছে।
দেশীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে এর প্রভাব ঠিক কতটা? এর ফলে কি স্বতন্ত্র ও একক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়বে? এর ফলে কি অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে? এর ফলে কি ছাত্র সংখ্যায় বড় প্রভাব পড়বে? এর ফলে কি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জনমানসের চিন্তাভাবনা বদলে যাবে? সমাজের ঠিক কোন পর্যায়ে এই পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যণীয় হবে? খুব ছোট একটা সম্প্রদায়? না কি বড় অংশে? দেশের বিশাল যুব সমাজের উপর এর ঠিক কতটা প্রভাব পড়বে?
এই সব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র দিতে পারে সময়। এর ভবিষ্যত্ খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু এর জন্য যথেষ্ট মূল্যও চোকাতে হতে পারে।