দিল্লি, 11 ফেব্রুয়ারি : প্রচারের সময় তাঁর স্লোগান ছিল, 'আচ্ছে বিতা পাঁচ সাল ৷' এই স্লোগানেই ভরসা রাখলেন মানুষ ৷ দিল্লি ফের কেজরিওয়ালের ৷
বুথ ফেরত সমীক্ষা আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল ৷ সমীক্ষাকে সত্যি প্রমাণিত করে তৃতীয়বারের জন্য দিল্লির মসনদে আম আদমি পার্টি ৷ নিঃসন্দেহে কিছুটা শক্তি বাড়িয়েছে BJP ৷ কংগ্রেসের ঝুলি শূন্য ৷ 70 বিধানসভা আসনে আম আদমি পার্টির খাতায় 62টি, BJP পেল 8টি আসন ৷
গতবারের তুলনায় BJP-র আসন সংখ্যা বেড়েছে ৷ স্বাভাবিকভাবেই শতকরার হিসেবেও বেশ কিছুটা এগিয়েছে তারা ৷ গতবার প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে গেরুয়া শিবিরের শতকরা হার ছিল 32.3 শতাংশ ৷ এবারে তা বেড়ে 40 শতাংশ হয়েছে ৷ কিন্তু, আসন সংখ্যা বা ভোটের হারে পরিবর্তন কার্যত স্থিমিত লাগল AAP-র ফলাফলের সামনে ৷
পাঁচ বছর আগে BJP-সহ সব বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভোটে নেমেছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল ৷ 70 আসনের বিধানসভার মধ্যে 67 দখল করেছিল তারা ৷ খড়কুটোর মতো উড়ে গেছিল বিরোধীরা ৷ ক্ষমতায় আসার পরই একাধিক অভিনব পদক্ষেপ ঘোষণা করেছিলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ৷ বিদ্যুৎ, জল এবং সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করেছিলেন ৷ নিখরচায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন ৷ জল এবং বিদ্যুতের মতো মৌলিক চাহিদাগুলিকে প্রতিটি সাধারণ মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগই কেজরিওয়ালের জয়ের অন্যতম হাতিয়ার বলে মনে করছেন অনেকে ৷ নারী নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করেছিলেন ৷ রাজ্যের প্রতিটি কোণায় CCTV লাগিয়ে সুরক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত করেছিলেন ৷ 2012 সালে নির্ভয়াকাণ্ডের পর রাজধানীতে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল, গত পাঁচ বছরে কেজরিওয়ালের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে সেই কলঙ্ক অনেকটাই মোছা সম্ভব হয়েছে ৷
পুলিশ ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনে থাকায় বরাবরই কেজরিওয়ালের সঙ্গে বিরোধ দেখা গেছে উপ-রাজ্যপালের ৷ কিন্তু, দিনের শেষে সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাজি জিতেছেন কেজরিওয়ালই ৷ আবার, গোটা দেশ যখন পরিবেশ দূষণের নিরিখে রাজধানীর দিকে আঙুল তুলছিল, তখনই জোড়-বিজোড় ফরমুলা চালু করে অভিনবত্ব এনেছিলেন ৷ স্বাভাবিকভাবেই কেজরিওয়ালের এই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত প্রশংসা কুড়িয়েছিল ৷
এত কিছুর পরে অবশ্য এবারে ভোটের আগেই শাহিনবাগ বিতর্ক নতুন মাত্রা যোগ করে ৷ প্রথম থেকেই নজর ছিল ওখলা কেন্দ্রের দিকে ৷ কারণ, এই ওখলার মধ্যেই পড়ে শাহিনবাগ ও জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ৷ শাহিনবাগের আন্দোলন কেজরিওয়ালকে বাড়তি অক্সিজেন দিচ্ছে না পক্ষান্তরে BJP-র হাত শক্ত করেছে, তা নিয়ে জল্পনা ছিল ফল ঘোষণার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ৷ কিন্তু, দিনের শেষে দেখা গেছে, ওখলাতে শেষ হাসি ফের হাসল AAP-ই ৷ নয়াদিল্লি কেন্দ্র থেকে যেভাবে অরবিন্দ কেজরিওয়াল জিতলেন, তা নিঃসন্দেহে দলকে বাড়তি প্রেরণা দেবে ৷ তবে, দলের 'সেকেন্ড ইন কমান্ড' মণীশ সিসোদিয়ার অবস্থা দলের এই সুখের দিনেও যেন কিছুটা কাঁটা হয়ে থাকল ৷ তিনি জিতেছেন । তবে মাত্র ২ হাজারের ব্যবধানে । শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে সিসোদিয়ার ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছিল ৷ নিন্দুকরা বলছেন, উপ-মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও নিজের কাজ ঠিক মতো করতে পারেননি ৷
তাই হয়ত বিজলি-পানি-সড়কের স্লোগান ভোটের আগে কিছুটা ফিকে হয়ে গেছিল ৷ আর এখানেই ড্যামেজ কন্ট্রোলের ভূমিকায় দেখা গেল প্রশান্ত কিশোরকে ৷ 2014 সালে প্রশান্ত কিশোরের সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন কেজরিওয়াল ৷ ভোট হয়েছে 2020-র 8 ফেব্রুয়ারি । আর 2019-এর 14 ডিসেম্বর টুইটারে কেজরিওয়াল জানিয়েছিলেন, 'ইন্ডিয়ানপ্যাক' অর্থাৎ পিকে'র সংস্থার সঙ্গে তাঁর দল গাঁটছড়া বেঁধেছে । এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াটা কিন্তু খুব বেশি দিন আগে শুরু হয়নি । গত লোকসভা ভোটে বাংলার মতো দিল্লিতেও গেরুয়া ঝড় চোখে পড়েছিল ৷ বাংলায় যেমন দুই থেকে 18-তে পৌঁছেছিল BJP, ঠিক তেমনই আম আদমি পার্টির বুকে হৃদকম্প ধরিয়েছিল তারা ৷ সাতটির মধ্যে সাতটি লোকসভা আসনই নিজেদের দখলে নিয়েছিল তারা ৷ BJP-র এই উত্থানের পর আলোচনা শুরু হয়েছিল এই বিধানসভা নির্বাচনকে নিয়ে ৷ অনেকেই মনে করেছিলেন, বিধানসভা নির্বাচনে 20 বছর বাদে পদ্ম ফুটতে চলেছে দিল্লির মাটিতে ৷ আলোচনা যখন মধ্যগগনে ঠিক তখনই ‘ইন্ডিয়ানপ্যাক’-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন কেজরিওয়াল ৷ তার পরই ছবিটা পরিবর্তন হতে শুরু করে ৷ ডিসেম্বরের আগেও একাধিক জনসভায় সার্জিকাল স্ট্রাইক থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা ছিল কেজরিওয়ালের ভাষণের প্রতিপাদ্য বিষয় ৷ অনেকেই তখন মনে করেছিলেন, বিরোধিতা অনেক ক্ষেত্রেই অকারণে হয়ে যাচ্ছে ৷ কিন্তু, পিকে'র সংস্পর্শে আসার পরই আস্তে আস্তে পরিস্থিতির পরিবর্তন নজরে পড়তে শুরু করে ৷ BJP-র ফাঁদে পা দিয়ে কারণে-অকারণে কেন্দ্রকে আক্রমণ করা থেকে পিছু হঠে আসেন AAP সুপ্রিমো ৷ সেই পরিস্থিতি এবং এই জয় থেকে অনেকের মনেই দাঁড়ি টানছে একটা কথাই ৷ তা হলে কি পিকে'র পরামর্শেই এবারের ভোটে বাজিমাত করলেন কেজরিওয়াল ?
ভোট শেষ হতেই বিভিন্ন বুথ ফেরত সমীক্ষা ইঙ্গিত দিয়েছিল এবারেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছে আম আদমি পার্টি ৷ তিন থেকে BJP যে বেশ কিছুটা উপরে উঠে আসবে, তাও স্পষ্ট করেছিল সমীক্ষাগুলি ৷ রিপাবলিক-জন কি-বাত, ইন্ডিয়া টুডে, ABP নিউজ় রিপোর্টার বা ইন্ডিয়া নিউজ় সবাই 55-র উপর আসন AAP পাবে বলেই আভাস দিয়েছিল ৷ সব আভাসই মিলে গেল ৷ গতবার 67টি আসনের থেকে গোটা কয়েক আসন কমেছে বটে ৷ কিন্তু, 70 বিধানসভার মধ্যে প্রায় 90 শতাংশ আসন পেয়ে AAP বুঝিয়ে দিল এখনও তারাই দিল্লির চালিকাশক্তি ৷ ভোটের আগে কেজরিওয়ালের ঘোষণা ছিল আগামীদিনে দিল্লিকে আরও নিরাপদ শহরে পরিণত করবেন ৷ তৃতীয়বারের জন্য সিংহাসনে বসে সেই বিষয়েই তিনি গুরুত্ব দেবেন তাতে সন্দেহ নেই ৷ আবার, লোকসভা ভোটে সাফল্য এলেও তৎপরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে গেরুয়া শিবিরের হাত ততটা মজবুত দেখায়নি ৷ কংগ্রেসের জমি অপেক্ষাকৃত মজবুত হয়েছে ৷ কিন্তু, শীলা দীক্ষিত পরবর্তী দিল্লির মাটি যে এখনও হাত পাকাতে প্রস্তুত নয়, আজকের ফল ফের একবার বুঝিয়ে দিল ৷ যেভাবে সুষমা স্বরাজ পরবর্তী সময়ে BJP থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে দিল্লির সাধারণ মানুষ, অনেকটা সেভাবেই কমনওয়েলথ কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানো শীলা দীক্ষিত বা কংগ্রেসের থেকেও কয়েক যোজন দূরে তারা ৷ গতবারের মতো এবারও একটি আসনও জোটেনি তাদের ।
এবারের ভোটে লড়াইটা ছিল মূলত কেজরিওয়াল বনাম মোদি ৷ মোদি ঝড়কে সামনে রেখে মাস আটেক আগেই লোকসভা ভোটের বৈতরণী পার হয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টি ৷ হাত কেন, ঝাড়ুও কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি দিল্লিতে ৷ সাতটির মধ্যে সাতটি আসনই দখল করেছিল BJP ৷ অন্যদিকে, বেশ কয়েকটি রাজ্যে নিজেদের প্রার্থী দিয়েও কার্যত মুখ লুকোতে হয়েছিল কেজরিওয়ালকে ৷ লোকসভায় সাফল্য নেই বললেই চলে ৷ ভোট প্রচারে গিয়েও বেশ কয়েকবার বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল ৷ কয়েকজন অনুগামী দল ছেড়ে বেরিয়ে কেজরিওয়ালকে নিশানা করেছিলেন ৷ এক সময়ের 'রাজনৈতিক গুরু' আন্না হাজারেও কেজরিওয়ালের সমালোচনায় মুখ খুলেছিলেন ৷ যেভাবে রাজনৈতিক দল গড়ে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্শিতে বসেছিলেন, সেই পদ্ধতিকে সমর্থন করতে পারেননি আন্না ৷ এক সময় কেজরিওয়ালের অন্যতম ঘনিষ্ঠ অলকা লাম্বা সরব হয়েছেন বারবার ৷ কিন্তু, এত কিছুর পরও মাফলার পরা, অনাড়ম্বর কাঠের চেয়ারে মুখ্যমন্ত্রিত্ব করতে বসা মানুষটির পাশে থাকতেই চাইলেন দিল্লির জনতা ৷ সমালোচকরা বলছেন, কেজরিওয়ালের আড়ম্বরহীন জীবন, সহজ সরল বাক্যালাপ, প্রায় নিরাপত্তাহীনভাবে চলাফেরা করার এই 'আম আদমি'-র ক্যারিশ্মাই শেষ পর্যন্ত দিল্লিবাসীর মন জয় করে নিল ৷ আর অবশ্যই তার সঙ্গে বিজলি-পানির প্রতিশ্রুতিই জোগাল ভরসা ৷