দিল্লি,18 ফেব্রুয়ারি : কুড়ি বছর আগে, যখন সরকার সর্ব শিক্ষা অভিযান চালু করেছিল, তখন দেশের প্রত্যেক পাঁচ জন শিশুর মধ্যে একজনের নামও প্রাথমিক স্কুলে নথিভুক্ত ছিল না । আর আজ আমাদের শিশুদের মধ্যে অন্তত 99 শতাংশের নামই স্কুলে নথিভুক্ত এবং তা একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রাপ্তি এবং আরও ভালো শিক্ষার দিকে নেওয়া প্রথম জরুরি পদক্ষেপ । দুর্ভাগ্যবশত, পড়ুয়াদের স্কুলে যাওয়ার এই সুযোগ বৃদ্ধিতে পঠন-পাঠনে কাঙ্খিত ফল দেখা যায়নি ।
এই সত্য দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত যে, শৈশবে যারা বুনিয়াদি পঠনপাঠনের ভিত্তি পায়নি, তারা পরবর্তীকালে সেই খামতি পূরণ করতে পারে না, ফলে তাদের মধ্যে কেউ কেউ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বাইরে চলে আসে । উৎকৃষ্ট মানের শিক্ষা, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বুনিয়াদি পঠনপাঠন, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি । জাতীয় শিক্ষা কমর্সূচি (NEP)-র খসড়া–যা গত 30 বছরে প্রথম আপডেট করা হয়েছে– তা শনাক্ত করেছে, আজ আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, সেই পঠনপাঠনজনিত সংকটের মূলে দায়ি আগেকার শৈশব শিক্ষা (ECE) এবং বুনিয়াদি শিক্ষা (FLN) । NEP জানিয়েছে , আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত এই বিষয়ে যে, ২০২৫ সালের মধ্যে যাতে প্রাথমিক স্কুলগুলিতে বিশ্বজনীন বুনিয়াদি সাক্ষরতা এবং সংখ্যাতত্ত্বের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে । যদি এই মৌলিক পঠনপাঠনের অধিকার (পড়া, লেখা এবং বুনিয়াদি স্তরের গণিত) প্রথমেই অর্জন করা সম্ভব না হয় তাহলে কর্মসূচির বাকি অংশগুলি আমাদের পড়ুয়াদের একটা বড় অংশের কাছে ভবিষ্যতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে ।
FLN নিয়ে খসড়া NEP-এ বেশি গুরুত্ব দেওয়াই হতে পারে সেই অতি-জরুরি ধাক্কা দেওয়ার মতো পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে একটি বিশদ নির্দেশাবলী আনা যেতে পারে, যা কেন্দ্র তৈরি করবে এবং রাজ্যগুলির সঙ্গে তা বণ্টন করবে, যা প্রধানত একটি কাঠামো হিসাবে ব্যবহৃত হবে এবং নিজস্ব কর্মসূচি তৈরি করবে । এমনকী, কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত এখন দ্রুত আইন পরিষদে এই খসড়া NEP পাস করা এবং এতে বর্ণিত সুপারিশ বাস্তবায়িত করা । এর জন্য প্রয়োজন, রাজ্যগুলিকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার এবং আর্থিক পুঁজি দেওয়ার পাশাপাশি সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া একটি কৌশল অবলম্বন করা, যাতে প্রতিটি রাজ্য বিশ্বজনীন বুনিয়াদি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করতে পারে ।
শুরুতেই যা দরকার, তা হল সমস্ত শিশুদের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে জানতে হবে কারণ এটা চিরন্তন শিক্ষা এবং বিকাশের ভিত্তি । ‘শিক্ষা কী ABC’, সেন্ট্রাল স্কোয়ার ফাউন্ডেশনের তরফে চালু এই কর্মসূচির তরফে অভিভাবকদের আবেদন করা হয়েছে, যাতে তাঁরা এটা নিশ্চিত করেন যে, তাঁদের সন্তানরা তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার আগেই পড়তে ও বুঝতে পারে ।
বুনিয়াদি শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে মূলত শিক্ষাবিদদের দেওয়া শিক্ষাবিজ্ঞানগত তথ্যের সঙ্গে প্রথামাফিক বদল ঘটানো এবং কর্মসূচির যে কোনও স্তরে ফলাফল বিশ্লেষণকারী স্বাধীন সংস্থার সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলা উচিত । বিশ্বাসযোগ্য, পরিমাপযোগ্য এবং তুলনা করা যায়, এমন তথ্য থাকা উচিত, যাতে নিয়মিত ভিত্তিতে সেখানে কর্মসূচি, লক্ষ্য, বাজেট এবং শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জুড়ে থাকা সমস্ত অংশীদারদের (শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, স্কুল প্রশাসক এবং অভিভাবক) ভূমিকার উপর নজরদারি চালানো যায় ।
বুনিয়াদি দক্ষতার অনুপস্থিতি সবচেয়ে বেশি আঘাত করে সুযোগহীনদের, কারণ উৎকৃষ্ট শিক্ষার অভাবে এরাই পরে ক্ষতিপূরণ করতে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ হয় । এমনকী, ভারতীয়দের মধ্যে অন্তত ৬৫ শতাংশই গ্রামে থাকে যেখানে পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে । সেখানে শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, মধ্যস্থতাকারী, এবং জেলা ও রাজ্য আধিকারিকদের জন্য নিশ্চিত লক্ষ্য স্থাপন করার দেশজোড়া অভাবও দেখা যায় এবং তা ছাড়াও তাদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করার জন্য ফলাফল চিহ্নিতকারীদেরও অনুপস্থিতি দেখা যায় । চ্যালেঞ্জ হল, উৎকৃষ্ট শিক্ষা প্রদান করার জন্য আমাদের ক্ষমতা দুর্বল এবং একই সময়ে বিভিন্ন দিকে নজর দেওয়ার জন্য জরুরি সম্পদও আমাদের নেই । আমাদের স্কুলের পাঠক্রম স্কুলপড়ুয়াদের পাঠগ্রহণের ক্ষমতার সঙ্গে খাপ খায় না । কাজেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও বেশি কৌতূহল উদ্রেককারী এবং সমস্যা সমাধানকারী হওয়ার দিকে এগোতে হবে । NEP একটি লক্ষ্য স্থির করেছে যে, তিন থেকে ছ’বছরের কোঠায় থাকা সব পড়ুয়ারা যাতে ২০২৫ সালের মধ্যে শৈশবে উচ্চমানের প্রাথমিক শিক্ষা পায় । সামগ্রিক একটি শ্রেণিকক্ষ থাকবে, যা প্রতিটি রাজ্য এবং জেলার পড়ুয়াদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবে এবং এমন একটি বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা থাকতে হবে যা শিক্ষাদানের কৌশল, শিক্ষক এবং পড়ুয়াদের শিক্ষার সামগ্রী, পরীক্ষা, প্রশিক্ষণ প্রভৃতির উপর জোর দেয় আর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সমর্থন আমাদের এই লক্ষ্যপূরণ করতে সাহায্য করবে ।
প্রাথমিক শিক্ষায় উন্নয়ন আনাটা ভারতের জন্য অত্যন্ত জরুরি যাতে, বিশ্বব্যাপী নেতা হিসাবে তার স্থান পাকা করতে পারে । এবং NEP সঠিকভাবেই এটা পর্যবেক্ষণ করেছে যে, বুনিয়াদি শিক্ষা পরবর্তীকালে উত্তম স্বাস্থ্য, নিকাশি, নিরাপত্তা এবং আরও নানা দিকে নানা রকম সুযোগ তৈরি করে দেয় । ভারতের জন্য, ভারতের শিশুদের তথা দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এটা সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ ।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সম্প্রদায়গত অংশগ্রহণ এবং গণ সক্রিয়তা একত্রিত হয়ে বুনিয়াদি শিক্ষাকে জাতীয় স্তরে গুরুত্ব দিতে পারে । নম্বর, সিলেবাস শেষ করা আর পাস নম্বরটুকু পাওয়া দিয়ে শিশুদের বন্দী করে রাখা আমাদের উচিত নয় । কারণ, আজকের প্রাথমিক স্কুল পড়ুয়ারা আগামী দশকে দেশের কর্মক্ষেত্রে যোগ দেবে আর এই জনসংখ্যাগত লাভের ফল এবং আর্থিক সুযোগসুবিধা ভোগ করার জন্য আমাদের একটা মজবুত ভিত্তিও প্রয়োজন ।
বিশ্বব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে যে, বিশ্বের নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশের শিশুদের অন্তত ৫৩ শতাংশ শিক্ষাক্ষেত্রে দারিদ্রের শিকার এবং তারা দশ বছর বয়সে পৌঁছে গেলেও সাধারণ কোনও পাঠ্য পড়তে এবং বুঝতে পারে না । এর সমাধান করার জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক এই দশকের মধ্যেই শিক্ষাক্ষেত্রে দারিদ্রের হার হ্রাস করার দিকে নজর দিচ্ছে । এটা ভারতের নিরিখে একটি উচ্চাকাঙ্খী লক্ষ্য এবং খসড়া NEP আমাদের এটি অর্জন করার জন্য সঠিক পথ নির্দেশ দিতে পারে ।