চলতি অর্থনৈতিক সংকট এবং ভয়ংকর প্যানডেমিকের মোকাবিলা করে আত্মনির্ভর ভারত হওয়ার লক্ষ্যে দেশ যদি হাঁটতে চায়, তাহলে একাধিক দিকে উদে্যাগ নিতে হবে। এর মধে্য দু’টি হল শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান। তাৎপর্যপূর্ণভাবে দু’টি ঐতিহাসিক ও সামাজিক আইন সংকটের এই সময়ের সঙ্গে লড়তে সাহায্য করছে। এক, মহাত্মা গান্ধি ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট (MNREGA) 2005 এবং রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট 2009। কীভাবে সামাজিক ক্ষমতায়নের এই দুই হাতিয়ারকে কার্যনির্বাহী স্তরে অদক্ষ হাতে পরিচালনা করা হচ্ছে, এই প্রতিবেদনে সেটাই বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে গড়ে তোলা MNREGA-র আওতায় 100 দিনের কাজের আইনি গ্যারান্টি দেওয়া হয়। পাশাপাশি এতে রয়েছে ভাতা এবং কোনও কারণবশত আশ্বাস সত্ত্বেও কাজ দিতে না পারা বা মজুরি দিতে না পারার জন্য ক্ষতিপূরণের সংক্রান্ত বিধিবদ্ধ নিয়মনীতিও। কিন্তু, এই নিয়মনীতিগুলিকে আক্ষরিকভাবে এবং উদ্দেশ্যমুখীতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করা হয়নি। বদলে সেগুলিকে রক্ষণশীল এবং কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করে কার্যকর করা হয়েছে। এই আইনের তৃতীয় (ক) ধারা অনুযায়ী সরকার সেই প্রতিটি বাড়ির জন্য কাজের বন্দোবস্ত করতে বাধ্য, যার প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্যরা কোনও অর্থবর্ষের অন্তত 100 দিন অদক্ষ শ্রমদানে সক্ষম। এই "অন্তত 100 দিন" শব্দবন্ধ প্রয়োগের মাধ্যমেই স্পষ্ট, সংসদের তরফে ন্যূনতম 100 দিনের কাজের ব্যবস্থা করতেই হবে। বছরের বাকি সময়ের জন্য এদের ব্যবস্থা সরকার করবে, আর্থিক সম্পদ অনুযায়ী। কিন্তু, এই "ন্যূনতম" গ্যারান্টির বিষয়টিকে সরকার এবং প্রশাসন উভয়েই একক এবং সমবেতভাবে "সর্বোচ্চ" বলে ধরে নিয়েছে। প্রতি বাড়ি পিছু বছরে কর্মসংস্থান প্রদানের হার 2016-17 সাল থেকেই আটকে রয়েছে 45-50 দিনের কোঠায়৷ যখন থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়া শুরু হয়েছে। এমন কখনওই নয় যে চাহিদা ছিল না। উলটে এর কারণ, আইনটির তাৎপর্যকে আমলাতান্ত্রিক পরিকাঠামো যথোচিত সম্মান দিতে চায়নি। ফলে চাহিদা অপূর্ণ থেকে গিয়েছে৷ এমনকী আইন অনুযায়ী, 15 দিনের মধে্য চাহিদা না পূরণ করায় মজুরিও সঠিকভাবে বণ্টিত হয়নি। এই আইনকে যথাযথভাবে পালন করাই হয়নি।
তবে এমন কখনওই নয় যে, একশো দিন কাজের প্রকল্পে দিন সংখ্যা কখনও বৃদ্ধি করা হয়নি। তা করা হয়েছে ঠিকই, তবে ব্যতিক্রমী ঘটনাপ্রবাহের ক্ষেত্রেই। যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়। 2020 সালের জানুয়ারি মাসে কেরলে ভয়াবহ বন্যার সময় এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। এখানে আমাদের নজRTE Act
র দিতে হবে আইনের তৃতীয়(ঘ) ধারার দিকে৷ যেখানে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার, নিজ নিজ আর্থিক ক্ষমতা এবং উন্নয়নমুখী লক্ষ্যের পরিধি অনুযায়ী প্রতিটি বাড়ি তথা পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদসে্যর জন্য কোনও প্রকল্পের আওতায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজের ব্যবস্থা করবে৷ সেই সময়ের মেয়াদ বাড়লে (ক) ধারার উপশ্রেণি অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 100 দিনের বেশি মেয়াদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার বিষয়টি নির্ভর করছে আর্থিক ক্ষমতা এবং উন্নয়নমুখী লক্ষে্যর পরিধির উপর৷ অর্থাৎ দেশ যত আর্থিক বিকাশ ও উন্নয়নের দিকে এগোবে তত এর মেয়াদ বাড়বে। কারণ তা না হলে আর্থিক বিকাশ ও উন্নয়নের মধে্য অসাম্য তৈরি হবে৷ যার ফলে ছড়াবে দুর্দশা। 2006 সালে যখন এই প্রকল্প চালু হয়েছিল তখন দেশের আর্থিক পরিস্থিতি যা ছিল এখন তা নেই। তাই সঠিক সিদ্ধান্ত সেটাই হবে যখন লভ্যাংশ আর্থিক অস্বচ্ছল শ্রেণির মানুষের মধে্য সমানভাবে বণ্টিত হবে। MNREGA-র আওতায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির সময়ে এই দিকে খেয়াল রাখা উচিত৷ যা এতদিনে শুধু ঘাটতিই দেখেছে। 2020-21 বাজেটেও এর 13 শতাংশ ঘাটতি হয়েছিল। যদিও আত্মনির্ভর ভারত অভিযান প্যাকেজে MNREGA-র অতিরিক্ত 40,000 কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে৷ তবুও 100 দিনের কাজের ন্যূনতম গ্যারান্টি হিসাবে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট, 2009 -এর ক্ষেত্রেও একই পরিণতি হয়েছে। এটি কার্যকর করার আগে 1992 সালে "মোহিনী জৈন বনাম স্টেট অফ কর্ণাটক" মামলায় সুপ্রিম কোর্ট একে মৌলিক অধিকার বলে চিহ্নিত করেছিল। 1993 সালে "উন্নিকৃষ্ণণ, J P বনাম স্টেট অফ অন্ধ্র প্রদেশ"-এর মামলায় 14 বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষাকে সকলের মৌলিক অধিকার হিসাবে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছিল আদালতের তরফে । আদালত এও বলেছিল যে 45 নং আর্টিকেল মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে। পরবর্তীকালে এর প্রায় দশ বছর পর সংসদে যখন 86-তম সংবিধান সংশোধনী আইন কার্যকর হয়, যেখানে 21 (ক) আর্টিকলের অর্ন্তভুক্তি হয়৷ যার মাধ্যমে রাজ্যগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়, সমাজের সব স্তরে 6 থেকে 14 বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের বিনামূলে্য এবং বাধ্যতামূলকভাবে পড়াশোনার বন্দোবস্ত করতে। এর পর সংসদের আরও আট বছর লেগে যায়, নতুন একটি আইন রূপায়ণ করতে৷ যার নাম রাইট অফ চিলড্রেন টু ফ্রি অ্যান্ড কমপালসরি এডুকেশন অ্যাক্ট, 2009 (RTE Act)। এবার যদি আমরা এই আইনের 12 নং ধারার বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে–"ক্লাসের ক্ষমতার নিরিখে অন্তত 25 শতাংশের হিসাবে সমাজের দুর্বল তথা বঞ্চিত শ্রেণির শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।"
এখানে সরল ভাষায় "অন্তত 25 শতাংশ"-এর উল্লেখই প্রমাণ করে দেয় যে, আইনগতভাবে এই 25 শতাংশই হল সর্বনিম্ন। অথচ এটাকেই "সর্বোচ্চ" ধরে নিয়েছে শিক্ষা বিভাগ এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি। ভারতের রাজ্যগুলি RTE কোটার আওতায় রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়া মেনে এগোয় আর প্রতিটি বেসরকারি স্কুলগুলিতে যত সিট রয়েছে, তার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আর যদি কোনও পড়ুয়া তার পছন্দের স্কুলে লটারিতে সিট না পায় তাহলে তার শিক্ষার অধিকার সেখানেই সামগ্রিকভাবে খারিজ হয়ে যায়। উত্তরপ্রদেশে "বেসিক এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট" অ্যাডমিশনের জন্য চালু করা তাদের ওয়েবসাইটে আইনের 12 (1ক) ধারায় দেখিয়েছিল যে তাদের কাছে 2,72,070টি সিট রয়েছে৷ যা আদপে বেসরকারি স্কুলগুলির মোট সিটের 25 শতাংশ। গুরুত্বহীনভাবে পেশ করা এই সংখ্যাই প্রমাণ করে যে, স্কুলগুলি তাদের প্রকৃত সিটসংখ্যা প্রকাশে্য আনে না। কিন্তু এই বছরে শুধুমাত্র 59,656 পড়ুয়ার জন্য এই সিটের বন্দোবস্ত করা হয়েছে৷ যা আদপে চালু সিটের মাত্র 22 শতাংশ। যদিও তৃতীয় দফার ভরতি প্রক্রিয়া এখনও বাকি আছে৷ তবুও যত সিট হতে পারে তার কাছাকাছিই যে চূড়ান্ত বণ্টন হবে তা নিয়ে জল্পনা রয়েছে। শুধুমাত্র লখনউয়েই 4,877 জন পড়ুয়ার সিট খারিজ করা হয়েছিল৷ কারণ তাদের "সিট শেষ" হয়ে গিয়েছে। প্রকৃত ভরতির সংখ্যা আরও কম হতে পারে৷ অনেকটা লখনউয়ের সিটি মন্টেসরি স্কুলের মতো৷ যারা এই ভরতি প্রক্রিয়া মেনেই চলে না। সংবিধানে যেমন বর্ণিত আছে তা মেনে শিশু পড়ুয়াদের মৌলিক অধিকার রক্ষার বিষয়টিকে এই ভরতি প্রক্রিয়ায় কার্যত প্রহসনে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
এটা শুধু RTE Act-এরই স্পষ্ট লঙ্ঘন নয়, পাশাপাশি 21 (ক) ধারারও লঙ্ঘন, বিশেষ করে তখন, যখন রাজ্যগুলিকে যেখানে শিশু পড়ুয়াদের বিনামূলে্য এবং বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষাদানের অধিকার প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। RTE Act-এর আওতায় লটারিতে যে পড়ুয়ারা ভরতি হতে পারে না, তাদের অন্য কোনও সরকারি বা বেসরকারি স্কুলে ভরতির বন্দোবস্ত করে দেওয়া রাজ্য সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। লটারির মাধ্যমে কী কখনও কোনও শিশু পড়ুয়ার মৌলিক অধিকার নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে? 21 (ক) ধারাই একমাত্র পারে শিক্ষার অধিকারের মাপকাঠি এবং বিষয় নির্ধারণ করতে৷ আর রাজে্যরও এখানে বড় ভূমিকা পালন করার আছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, সংবিধানের ধারা পালন করার ক্ষেত্রে আক্ষরিকভাবে এবং উদ্দেশ্যমুখীতার সঙ্গে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে রাজ্যগুলিকে। না হলে "বিচার: সামাজিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক", "ক্ষমতা এবং সুযোগের ভারসাম্য রক্ষা" এবং "এককের সম্ভ্রম রক্ষা"র মতো সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল বিষয়গুলি কেবল কাগুজে অক্ষর হয়েই থেকে যাবে।
অনুরাগ সিং লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের LLB পড়ুয়া ৷ সন্দীপ পাণ্ডে সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা কর্মী।