ইন্দিরা গান্ধির সময় থেকে কংগ্রেসের কাজকর্মে তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি । দলের কাজকর্ম দীর্ঘ বছর ধরে সেই একইরকম চলছে । প্রথমে তারা যে কোনও বিষয়কে তিল থেকে তাল করে, তারপর চেঁচামেচি শুরু করে যে গান্ধি পরিবার ছাড়া কংগ্রেসের কোনও ভবিষ্যৎ নেই । এটা যেন সেরকমই একটা ব্যাপার যে মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে গান্ধি পরিবারের সদস্যদের ভগবান হিসেবে পুজো করা হয় এবং গোটা কংগ্রেস দলটা যেন সেই ভগবানের ভক্ত । ঠিক এটাই এখন কংগ্রেসের অন্দরে ঘটে চলেছে । এটা প্রমাণিত সত্য যে আর কেউ নয়, একমাত্র গান্ধি পরিবারের কোনও সদস্যই নেতা হিসেবে কংগ্রেসের কাছে গ্রহণযোগ্য । সেই নেতৃত্বে যদি সোনিয়া গান্ধিকে না পাওয়া যায়, তবে রাহুল গান্ধি গ্রহণযোগ্য, আর বর্তমানে প্রিয়াঙ্কা গান্ধিকে তো রিজ়ার্ভ ফোর্স হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে ।
একটা পুরানো প্রবাদ রয়েছে, বিশ্ব শ্রীরামকে ছাড়া চলতে পারে না ৷ আর শ্রীরাম হনুমানকে ছাড়া কোনও কাজ করতে পারেন না । এই প্রবাদটি 135 বছরের পুরানো কংগ্রেস দলের ক্ষেত্রেও সত্যি । কংগ্রেস হল সেই দল যারা স্বাধীন ভারতে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল । গান্ধি পরিবার ছাড়া কংগ্রেস তার অস্তিত্ব ভাবতেই পারে না ৷ আর গান্ধি পরিবারও ‘জো হুজুর’ মার্কা একদল লোক ছাড়া কিছু করার কথা ভাবতে পারে না । এই ‘জো হুজুর’ মার্কা লোকগুলো আসলে প্রায় হাফ ডজন বিশ্বস্ত ম্যানেজার, যাঁরা জানেন কীভাবে প্রথমে যন্ত্রণা দিতে হয়, তারপর সেই যন্ত্রণা উপশম করার জন্য কী ওষুধ দিতে হয় । এরা হল সেই সমস্ত লোক যাঁরা পিরের সমাধির গৌরবে উরস উৎসব আয়োজন করে থাকে । আর মিডিয়ার ভাষায় তাঁদেরকে বলা হয় কোটারি বা দলের মধ্যে উপদল । এই উপদলই হল কংগ্রেসের প্রকৃত হাইকমান্ড যারা দল চালানোর ক্ষেত্রে পরামর্শ দেয়, সিদ্ধান্ত নেয় এবং নেতৃত্বকে তুলে ধরতে স্লোগান সর্বস্ব লোকজন জড়ো করে ।
এই সংস্কৃতি কংগ্রেসের অন্দরে ইন্দিরা গান্ধির আমলেও ছিল । কিন্তু বর্তমান দলের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধির আমলের দলের একটা বিশেষ পার্থক্য ছিল ৷ ইন্দিরা গান্ধি দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন । তাই তিনি দলের অন্দরে সবার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি জানতেন ৷ কোন কোন নেতার নিজের নিজের রাজ্যে জোরদার জনসমর্থন রয়েছে সেই বিষয়েও খোঁজ রাখতেন । একই সঙ্গে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয়গুলিও বুঝতেন । তিনি রাজনীতির সূক্ষ্ম চালগুলি সম্পর্কে যেমন অবহিত ছিলেন, তেমনই জনগণ কী চাইছে সেটাও ভালোভাবে নিরীক্ষণ করতেন । তাই তিনি দলের অন্দরে বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির যেমন মোকাবিলা করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন, তেমনি জানতেন রাজনীতির ময়দানে কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীর মোকাবিলা করতে হয় ।
আমরা যদি ইন্দিরা গান্ধির সেই পরিপক্কতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা সোনিয়া গান্ধির কাছ থেকে আশা করি, তবে সেটা একেবারেই ভুল হবে । আর তাই সোনিয়া গান্ধির দল পরিচালনার ক্ষেত্রে কোটারি বা উপদল প্রয়োজন । দল পরিচালনায় সিদ্ধান্ত নিতে সোনিয়াকে সেই উপদলের উপরেই নির্ভর করতে হয় । আর এর ফলে সোনিয়া হয়তো তাঁর নিজের ইমেজ ঠিক রাখতে সমর্থ হচ্ছেন, কিন্তু তার জেরে শতাব্দী প্রাচীন দলটির ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে ।
ভারতের রাজনীতিতে গত দুই দশকে কংগ্রেসের এই ‘জো হুজুর’ লোকগুলি খুবই ভালো সময় কাটিয়েছে । UPA পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের দশ বছরের আমলে কংগ্রেস হাই কমান্ডকে অযৌক্তিকভাবে মহিমান্বিত করা হয়েছিল । যদিও সরকার চালানোর দায়িত্ব খাতায়-কলমে ছিল মনমোহন সিংয়ের উপর, কিন্তু বলাইবাহুল্য যে পর্দার পিছনে হাইকমান্ড ছিল যথেষ্ট সক্রিয় । কংগ্রেস দলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে যে, কংগ্রেস নামক সেই জাহাজটা এখন কেন ডুবন্ত । কেন রাজনীতির সাগরে সেই জাহাজ এখন টালমাটাল । কেন সেই জাহাজ নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর জেরে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক ঝড়ের মুখোমুখি হতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ । কেন রাহুল গান্ধি BJP-র তৈরি করা ‘পাপ্পু’-র জাল থেকে এখনও বের হতে পারলেন না । কেন কংগ্রেসের সেই ম্যানেজাররা যাঁরা দল পরিচালনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনোযোগী ও দায়িত্ববান হওয়ার ভান করেন, কিন্তু রাহুল গান্ধিকে একজন সফল নেতা হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁদের সামগ্রিক উদ্যোগ মোটেই চোখে পড়ে না ? আসলে এটা না হওয়ার কারণ হল এই যে, রাহুল গান্ধি আর সোনিয়া গান্ধির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে । জননেতা হওয়ার ক্ষমতা হয়তো রাহুল গান্ধির নেই, কিন্তু কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন রাহুল গান্ধি দলের মধ্যে উপদলের ভূমিকা, দল পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ এবং দেশের সমস্ত অংশে ছড়িয়ে থাকা দলের ইউনিটগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত সাংগঠনিক জটিলতা বুঝতে সমর্থ হয়েছিলেন । 2014 সালে লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের বিপর্যয়ের পর রাহুল গান্ধি এর কারণ বিশ্লেষণের জন্য পর্যালোচনা বৈঠক করেছিলেন । বৈঠকে বিভিন্ন রাজ্যের দলীয় কর্মীদের মতামত ও অভিযোগ শুনেছিলেন । এই সমস্ত কিছু রাহুলের সামনে দলের প্রকৃত ছবিটা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে । তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ম্যানেজারদের কবল থেকে মুক্ত হতে না পারলে দলের পুনরুজ্জীবন ঘটানো যাবে না । আর সেখান থেকেই দলের অন্দরে শুরু হয় তীব্র লড়াই ।
কংগ্রেসকে শক্তিশালী করার জন্য রাহুল গান্ধি প্রথমে দলের অন্দরে সোনিয়া গান্ধিকে ঘিরে থাকা উপদলের সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ালেন এবং দল পরিচালনার জন্য একটা নতুন টিম গঠনের কাজ শুরু করলেন । বিষয়টিকে এভাবেও বলা যায় যে, দলের অন্দরে বিশেষ ক্ষমতাবান তথা সোনিয়া গান্ধির রাজনৈতিক সচিব আহমেদ প্যাটেল ও তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে পরোক্ষ লড়াইতে অবতীর্ণ হলেন ৷ রাহুল গান্ধি কিন্তু যথেষ্ট ভেবেচিন্তেই এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কিন্তু অনভিজ্ঞতার জেরে তিনি তাঁর পদক্ষেপে একাধিক ভুল করে বসলেন । রাহুল যে টিম তৈরি করেছিলেন তাতে সেই সমস্ত তরুণ তুর্কী নেতা ছিলেন যাঁরা অক্সফোর্ড বা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন ৷ যাঁরা পাশ্চাত্যের রাজনীতির রীতিনীতি দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত ছিলেন । তাই এই তরুণ নেতারা 135 বছরের পুরানো কংগ্রেসের সনাতন রাজনৈতিক আদর্শ সম্পর্কে মোটেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না । দল পরিচালনার ক্ষেত্রে সমীক্ষা, ইন্টারভিউ ইত্যাদি প্যারামিটারকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হল । দলের যুব ও ছাত্র সংগঠনের অন্দরে মনোনয়নের সংস্কৃতি বন্ধ হল । দলের অফিসিয়াল পদগুলিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নিযুক্তির কাজ শুরু হল । কিন্তু এই সমস্ত নতুন পদক্ষেপ কংগ্রেসের একটা অংশ যারা স্থিতাবস্থায় বিশ্বাসী তারা ভালোভাবে মেনে নিতে পারল না ।
কিন্তু রাহুল গান্ধি এখানেই থামলেন না । বিভিন্ন রাজ্যে দলের প্রদেশ সভাপতির পদে রাহুল নিজের পছন্দের তরুণ নেতাদের বসাতে শুরু করলেন । রাহুলের এই পদক্ষেপের জেরে দলের বর্ষীয়ান নেতাদের একাংশ প্রমাদ গুণলেন । বিষয়টি তাঁদের পছন্দ হল না । দলের অন্দরে তাঁরা অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে শুরু করলেন । এই বিষয়ে কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা ভূপিন্দর সিং হুডার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে । তিনি 10 বছর হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন । হরিয়ানা প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে তিনি কখনওই অশোক তনোয়ারকে মেনে নিতে পারেননি । দু'জনের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয় যখন অশোক তনোয়ারের উপর হামলা হয় । শেষ পর্যন্ত অশোক তনোয়ার কংগ্রেস ছাড়েন ।
2014 এবং 2019 সালের মধ্যে রাহুল গান্ধি দলের পুনরুজ্জীবনের জন্য যা যা করা সম্ভব, তা করেছেন । ওই সময়ে তাঁর এটাও প্রমাণ করা দরকার ছিল যে তিনি একজন যোগ্য বিরোধী দলনেতা যাঁর মধ্যে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে । রাহুল গান্ধি মোটেই একজন ভালো বক্তা নন । ঠিকমতো প্রস্তুতি না নেওয়ার জন্য অনেকসময় সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে রাহুল গান্ধি অপ্রস্তুতে পড়েছেন । আর এটা হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায় যে রাহুল গান্ধি কোনওদিন তৃণমূলস্তরে রাজনীতি করেননি ৷ অভিজ্ঞতার অভাবের জন্য তাঁর মধ্যে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক বিচক্ষণতা যথেষ্ট মাত্রায় নেই । তাই তিনি যখন সংসদের অন্দরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আলিঙ্গন করেন, তখন তিনি প্রশংসিত হওয়ার বদলে বিদ্রুপের শিকার হন । একদিকে নরেন্দ্র মোদি রাজনীতির সূক্ষ্ম চালগুলো যথেষ্ট ভালো জানেন, অন্যদিকে রাহুল নিজেকে ‘পাপ্পু’ হিসেবে প্রমাণ করে চলেছেন আর তার সুযোগ নিয়েছেন কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতারা । তাঁরা মনে করেন একমাত্র তখনই রাহুলকে তাঁরা সঠিক পরামর্শ দেবেন যখন রাহুল তাঁদের নিজের পরামর্শদাতা হিসেবে মেনে নেবেন ।
কিন্তু তরুণ ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ রাহুল রাজনীতির নিষ্ঠুর জটিলতার মধ্যে না জড়িয়ে বিপাসনা ক্যাম্পে গিয়ে নিজেকে মানসিক চাপ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলেন । রাহুলের মা সোনিয়া গান্ধি পুরো বিষয়টি বুঝতে পারলেন । তাই ইতিমধ্যে তিনি নিজের বিশ্বস্ত লোকজনকে দলের স্ক্রিনিং কমিটি ও সিলেকশন কমিটিতে রেখে বিধানসভা ভোটের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ চালিয়ে গেলেন । এর জেরে সোনিয়ার বিশ্বস্ত সেই সমস্ত নেতাদের জায়গাও দলের মধ্যে মজবুত থাকল ।
2019 লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের অপমানজনক হার হল । শুধু সংবাদমাধ্যমেই নয়, দলের অন্দরেও রাহুল গান্ধি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়লেন । দলের এই অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে রাহুল গান্ধি কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলেন । এমন ঘটনা কংগ্রেসের ইতিহাসে সম্ভবত আগে কখনও ঘটেনি কিন্তু গোটা বিষয়টিতে কংগ্রেসের অন্দরে সেই বিশেষ উপদল যথেষ্ট খুশি হয়েছিল । আহমেদ প্যাটেল, পি চিদম্বরম, এ কে অ্যান্টনি, মোতিলাল ভোরাসহ আরও কয়েকজন নেতা সোনিয়া গান্ধিকে অন্তর্বর্তী সভাপতি হিসেবে দলের কাজ চালানোর জন্য রাজি করাতে সমর্থ হল । এক্ষেত্রে যেটা উল্লেখযোগ্য তা হল, যদি ওই নেতারা প্রিয়াঙ্কা গান্ধিকে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে বসাতে তথা দলের হাইকমান্ডের অংশ করতে সমর্থ না হতেন তবে দলের সভাপতি হিসেবে রাহুল নিজের পছন্দের কাউকে বেছে নিতেন । আর সেটা যদি হত তবে তা উপদলের সেই সদস্যদের কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য হত না । অন্যদিকে প্রিয়াঙ্কাও তাঁর মা সোনিয়া গান্ধিকে দলের অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতির পদে বসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন যাতে দলের নেতৃত্ব গান্ধি পরিবারের হাতেই থাকে ।
এবার দেখা যাক বর্তমানে কংগ্রেসের অন্দরে কী ঘটছে যা ইতিমধ্যে অনেককেই বিস্মিত করেছে । দলের 23 জন নেতা সোনিয়া গান্ধিকে যে চিঠি লিখেছেন, তা ইতিমধ্যে দলের অন্দরে যথেষ্ট শোরগোল ফেলেছে । যদি এটা বলা হয় যে গোটা বিষয়টাই কংগ্রেসের ‘সুপ্রিম ম্যানেজার’ আহমেদ প্যাটেলের একটি পরিকল্পিত ও হিসেব কষে ফেলা পদক্ষেপ, তাহলে হয়তো অনেকেই সেটা বিশ্বাস করবেন না । কিন্তু এটা আগেই বলা হয়েছে যে, উপদলের সদস্যরা প্রথমে যন্ত্রণা দেয়, তারপর সেই যন্ত্রণা উপশম করার জন্য ওষুধ দেয় । আহমেদ প্যাটেল কংগ্রেসের চিফ জেনেরাল ম্যানেজার যাঁকে রাহুল গান্ধি দীর্ঘদিন ধরে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন । কিন্তু প্রিয়াঙ্কা ও সোনিয়া এখনও আহমেদ প্যাটেলের পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন । একটা ভয় কাজ করছে যে, রাহুল গান্ধি কংগ্রেসের নেতৃত্ব গান্ধি পরিবারের বাইরে কারও হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী । আর রাহুলের সেই ইচ্ছা যাতে বাস্তবায়িত না হয়, সেইজন্য উপদলের সদস্যরা পরিকল্পনা করে সোনিয়া গান্ধিকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন ।
সেই ইন্দিরা গান্ধির আমল থেকে গুলাম নবি আজ়াদ কংগ্রেসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা । তিনি এমন একজন নেতা, যিনি যে কোনও পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ । তিনিই একমাত্র নেতা যিনি একটানা কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন । একজন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দলের তরফে প্রায় সমস্ত রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক । রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার মুখে । কিন্তু গুলাম নবি আজ়াদ আহমেদ প্যাটেল নন যে তিনি একটানা পাঁচবার রাজ্যসভার টিকিট পাবেন । তিনি দিগ্বিজয় সিং-ও নন যাঁর পেছনে দলের একাধিক বিধায়কের সমর্থন রয়েছে এবং দল তাঁকে সংসদের উচ্চকক্ষে না পাঠানোর ঝুঁকি নেবে । গুলাম নবি আজ়াদ মনোমোহন সিং-ও নন ।
এখন সমস্যা হল নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে রাহুল গান্ধি তাঁর ঘনিষ্ঠ কে সি ভেনুগোপাল ও রাজীব সতভকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছেন । কিন্তু দলের কিছু নেতা যেমন গুলাম নবি আজ়াদ, কপিল সিবাল ও আনন্দ শর্মা মনে করেন রাহুলের এই পদক্ষেপ ভুল ছিল । মল্লিকার্জুন খাড়গে রাহুল গান্ধিকে পছন্দ করেন । তিনি এর আগে লোকসভায় বিরোধী দলনেতা হয়েছিলেন । এখন তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠানো হয়েছে । এই সম্ভাবনাও প্রবল যে, গুলাম নবি আজ়াদের রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে মেয়াদ শেষ হলে রাহুল মল্লিকার্জুন খাড়গেকে রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতার পদটি দেবেন । এদিকে লোকসভায় রাহুল পশ্চিমবঙ্গ থেকে জিতে আসা কংগ্রেস সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরিকে বিরোধী দলের পদটি দিয়েছেন । কিন্তু মণীশ তিওয়ারি মনে করেন লোকসভায় বিরোধী দলের নেতার পদটি তাঁকে দেওয়া উচিত ছিল । কিন্তু রাহুল গান্ধি মণীশ তিওয়ারির উপর ক্ষুব্ধ কারণ 2014 সালে লোকসভা ভোটের সময় মণীশ তিওয়ারি শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ভোটে লড়তে চাননি । যদিও রাজনৈতিক মহলের দাবি, মণীশ তিওয়ারি আসলে ভোটে হেরে যাওয়ায় ভয় পেয়ে লড়তে চাননি ।
একইভাবে বিবেক তনখার একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে, তিনি একজন বড়মাপের নেতা তাই তাঁকে মধ্যপ্রদেশে দলের রাজ্য সভাপতি করা উচিত । এরা সবাই একান্তে নিজেদের অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন । এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর সুযোগ খুঁজছিলেন দলের ম্যানেজাররা । তাঁরা রাহুল গান্ধির বিরুদ্ধে এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগালেন যখন দলের অন্তর্বর্তী সভাপতি হিসেবে সোনিয়া গান্ধির মেয়াদ ফুরিয়ে আসার মুখে । তাঁদের পরিকল্পনা ছিল যদি রাহুল গান্ধি তাঁর পছন্দের কাউকে দলের সভাপতি পদে বসানোর চেষ্টা করেন, তবে নেতৃত্ব প্রদান ও দল পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে । বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে যে, সেই ম্যানেজারদের নিক্ষেপ করা তির লক্ষ্যভেদ করেছে । রাহুলের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সোনিয়া গান্ধিকে দলের পরবর্তী প্লেনারি অধিবেশন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সভাপতি রেখে দেওয়া হল । পরবর্তী প্লেনারি অধিবেশনে দলের কার্যকরী কমিটির সদস্যদেরও সভাপতি নির্বাচন করা হবে । গোটা বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত ছিল । এমন একটা তত্ত্ব খাড়া করা হল যে, গান্ধি পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তাই চাপের মুখে পড়ে সোনিয়া গান্ধিকে অন্তর্বর্তী সভাপতি হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে হল । এইভাবে দলের অন্দরে রাহুলের অনুগামীদের ও বর্ষীয়ান নেতাদের নিয়ন্ত্রণে রাখাও সম্ভব হল । এই পরিস্থিতিতে রাহুল গান্ধি যদি দলের সভাপতি পদে বসেন, তবুও সেক্ষেত্রে ভেটো প্রদানের ক্ষমতা থাকবে সোনিয়া গান্ধি ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধির উপর ।
এইভাবে কংগ্রেসের কাছে শেষ পর্যন্ত তিনটি অপশন থেকে গেল – সোনিয়া, প্রিয়াঙ্কা ও রাহুল । এটাও সত্যি যে, গান্ধি পরিবারের পক্ষে দলের উপর থেকে নিজেদের রাজকীয় নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয় । রাহুল অবশ্য এখন নিজের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে ত্যাগের কথা বলছেন । প্রিয়াঙ্কা গান্ধির উচ্চাশা হল জনমানসে নিজের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখা । 2024 পর্যন্ত কংগ্রেস এভাবে নিজেদের ঘর গোছাতে ব্যস্ত থাকবে আর তারমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রামমন্দিরে পুজো দেওয়ার পর ফের আরও একবার ভোটে জেতার জন্য উদ্যোগী হবেন । তবে এই প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ্য যে, কংগ্রেসিদের উচ্চাশার সীমা নেই । তাই রাস্তায় নেমে জনসাধারণের জন্য লড়াই করার চাইতে তাঁরা দলের অন্দরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে পছন্দ করেন । যখন মোদি বা BJP কোনও ভুল করে তখন তাঁরা বলতে ভালোবাসেন যে, তাঁরাই হলেন একমাত্র বিকল্প এবং তাঁরা ফের ক্ষমতায় ফিরবেন ।