ETV Bharat / bharat

কোরোনা মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশ থেকে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অনেক কিছু শিখতে পারে ভারত - ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

কোরোনা প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর খুব ভালো কাজ করেছে ৷ স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারত সেসব দেশের কিছু স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করতে পারে বলে জানাচ্ছেন পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার সিনিয়র সায়েন্টিস্ট প্রিয়া বালাসুব্রমনিয়াম ৷

কোরোনা মোকাবিলা
ফাইল ছবি
author img

By

Published : Aug 20, 2020, 8:40 AM IST

COVID—১৯ প্যানেডেমিক যে দ্রুত হারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তার জেরে স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা এবং সংস্থানের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে সকলেই । বেশিরভাগ দেশেই জাতীয় স্তরে নভেল কোরোনা ভাইরাস প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণে অন্তত কিছুটা হলেও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আন্তর্জাতিক ও অন্তঃদেশীয় স্তরে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা, শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ রাখা, জনসমাগম নিষিদ্ধ করা তথা কোয়ারান্টিন চালু করা, হাত ধোওয়ার বিধির প্রচার করা, মাস্ক পরা প্রভৃতি ।

এছাড়াও প্রতিটি দেশ COVID—১৯ মোকাবিলায় সময়ভেদে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিচ্ছে । এর ফলে বদল এসেছে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে, এপিডেমিওলজিক্যাল কার্ভ এবং সামাজিক তথা অর্থনৈতিক ব্যয়ের ক্ষেত্রেও । যেহেতু বিভিন্ন দেশের রিপোর্টিংয়ের গুণমান, স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল, পরীক্ষা ব্যবস্থা এবং আক্রান্তকে শনাক্ত করার পদ্ধতি সবই আলাদা, তাই সামগ্রিকভাবে তাদের নিয়ে তুলনামূলক কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো বিভ্রান্তিকর হতে পারে ।

আরও সংক্ষিপ্ত এবং লক্ষ্যমুখী পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে সংক্রমণ প্রতিহত করা থেকে শুরু করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে প্রাণ বাঁচানোও সম্ভব হয়, তার জন্য WHO ছ’দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে । সেগুলি হল

  1. জনস্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা বাড়ানো, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও কাজে নিয়োগ করা
  2. সম্প্রদায়গতভাবে কে কে আক্রান্ত, তা খুঁজে বের করার ব্যবস্থা চালু করা
  3. পরীক্ষার হার এবং ক্ষমতা বাড়ানো
  4. রোগীদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা করে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা
  5. যোগাযোগের স্পষ্ট পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখা এবং আক্রান্তদের কোয়ারান্টিনে রাখার প্রক্রিয়া সচল রাখা
  6. মৃত্যুহার কমাতে জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু রাখা

দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এলাকার বেশিরভাগ দেশই COVID—১৯ কনটেনমেন্ট এবং নিয়ন্ত্রণে অপেক্ষাকৃত ভালো ফল করেছে ৷ তবে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করতে গেলে, এর মধ্যে কিছু কিছু দেশ নির্দিষ্টভাবে দেখে শেখার মতো কাজ করেছে । WHO—এর নির্দেশাবলী মেনে উপরোক্ত এলাকার তিনটি দেশ COVID—১৯ নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যধি মোকাবিলায় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে ভারতের রাজ্যগুলি ।

প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণ ও প্রস্তুতির নিরিখে শহরাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে সিঙ্গাপুর অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে । যে সব দেশ অনেক আগেই COVID—১৯ সংক্রমণ চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়েছিল, সেই তালিকায় অন্যতম সিঙ্গাপুর । ফেব্রুয়ারির গোড়াতেই COVID—১৯ শনাক্ত করে ফেলেছিল আর মে-জুন মাসের মধ্যেই অঞ্চল নিরিখে, সংক্রামিতের সংখ্যার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল । কিন্তু এই প্রতিবেদন লেখার সময়, এখন সেখানে সংক্রামিতর মোট সংখ্যা 55,580 থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন 51,049 জন ৷ মৃত্যু হয়েছে 27 জনের । প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণের জন্য সিঙ্গাপুরে জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল,

যেমন–

  • আরও বেশি সরকারি প্রতিক্রিয়া: অতীতে হওয়া SARS-এর প্রাদুর্ভাব থেকে শিক্ষা নিয়ে সিঙ্গাপুর কোভিড প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিয়েছিল । আর তা অনুসরণ করেই এই প্যানডেমিক প্রতিরোধে প্রস্তুতি নিতে তারা একাধিক সরকারি সংস্থার সঙ্গে মিলে পরিকল্পনা তৈরি করে, বিনিয়োগ বাড়ায়, স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ ভাগ করে দেয় এবং প্রায় নতুন করে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলে । আন্তঃসংস্থাভিত্তিক এহেন সহযোগিতার একটি উদাহরণ হল সেই চুক্তিপত্র, যা দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রক এবং সিঙ্গাপুর পুলিশের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্য বাহিনীর সঙ্গেও স্বাক্ষরিত হয় কেবলমাত্র কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব, হাত বারবার ধোওয়া এবং মাস্ক পরা সুনিশ্চিত করার জন্য ।
  • প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকে আরও সক্রিয় করে তোলা : সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রস্তুতি ক্লিনিকগুলিতে স্ক্রিনিং ‘সিলড’ করা হয় । যেহেতু প্রতিটি মানুষকে পরীক্ষা করা সম্ভব নয় আর এতে পরীক্ষাগারগুলির উপর চাপ বাড়তে পারে, তাই তা নিয়ন্ত্রণের জন্য ঠিক করা হয়, যাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে শ্রুশ্রূষা শুরু করে দেওয়া হবে । এই সব কিছুই সিঙ্গাপুর করেছিল 1000 টি জনসেবা প্রস্তুতিতে নিয়োজিত ক্লিনিকের মাধ্যমে ৷ যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী চিকিৎসকদের এই ধরনের প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল । আর এই তালিকায় ছিল সরকারি এবং বেসরকারি দু’ধরনের ক্লিনিকই ।
  • কঠোর অথচ লক্ষ্যমুখী কোয়ারান্টিন কর্মসূচি : ভারতের মতো সিঙ্গাপুরেও বিদেশি পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে অনেকে কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের কোনওভাবে আইসোলেট করা যাচ্ছিল না । পরিযায়ী শ্রমিকদের দ্রুত এবং কঠোর পরীক্ষা করানোর মাধ্যমে এবং শুধুমাত্র তাদেরই জন্য তৈরি বিশেষ আশ্রয়স্থলে তাদের কোয়ারান্টিনের ব্যবস্থা করে, যাতে সংক্রমণের চেন মাঝপথেই ভেঙে দেওয়া যায় । অনিশ্চয়তা এবং ব্যবধান ঘুচিয়ে জনগণের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর যাতে যুক্তিগতভাবে, যথেচ্ছভাবে এবং স্বচ্ছভাবে নেওয়া যায়, তার দিকে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে । এই যোগাযোগের মধ্যে একদিকে রয়েছে জনতা আর অন্যদিকে পৌর প্রশাসনের নেতারা । জাতীয় স্তরে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সাহায্যে (একতরফা মেসেজিং) সরকার নাগরিকদের প্রায়ই সংক্রমণ এড়ানোর বিশ্বস্ত তথ্য প্রদান করে চলেছে । আর শেষমেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল,
  • স্বাস্থ্যকর্মীদের সমর্থন, সংহতি এবং সক্রিয়তা : গোটা প্যানডেমিক জুড়ে এই স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে অতিরিক্ত বাহিনী, অস্বাস্থ্যক্ষেত্রের স্বেচ্ছাসেবী এবং নানা ধরনের স্বাস্থ্য তথা পৌর পরিষেবাক্ষেত্রের ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা পেশাদার কর্মীরা । সরকারি এবং বেসরকারি, দু'ক্ষেত্রেরই ফ্রন্টলাইন কর্মীরা একযোগে কাজ করেছেন ৷

তবে নভেল কোরোনা ভাইরাসের প্রতি ভিয়েতনাম যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাকে বিশ্বের অন্যতম সফল বলে ধরে নেওয়া হয় । এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে শুধুমাত্র তারাই নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন, যারা বিদেশ থেকে দেশে ফিরে কোয়ারান্টিনে ছিলেন । যদিও চলতি কিছু সপ্তাহে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণেরও খবর মিলেছে । ভিয়েতনামের স্ট্র্যাটেজি ছিল

  • গোটা সমাজকে নিয়ে চলা : এর আগে প্রধানমন্ত্রী আর্থিক উদ্বেগের তুলনায় স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এবং ভিয়েতনাম প্যানডেমিক মোকাবিলা নিয়ে একটি ‘ন্যাশনাল রেসপন্স প্ল্যান’ ও ‘ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটি’ তৈরি করেছিল । জনগণের প্রতি বার্তায় নাগরিকদের যুদ্ধের (এক্ষেত্রে কোরোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রূপক হিসাবে) বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল । সরকারি নানা স্তরের প্রাসঙ্গিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, নানাবিধ কর্মসূচিতে তাদের একজোট করে এগিয়ে নিয়ে চলা সহজ ছিল না । সংক্রমণ মোকাবিলা ও নিয়ন্ত্রণের কৌশল তৈরি করা হয়েছিল সেনা, জনস্বাস্থ্যপ্রতিনিধি, তৃণমূলস্তরের সংগঠন, সকলকে নিয়ে ৷ তা সফলভাবে বাস্তবায়িতও করা হয়েছিল ।
  • র‌্যাপিড কনটেনমেন্ট : কনটেনমেন্টের কঠোর নিয়মকানুন ধীরে ধীরে লাগু করা হয়েছিল । আর এর মধ্যে ছিল বিমানবন্দরে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত স্ক্রিনিং, সামাজিক দূরত্ববিধি বজায় রাখা, বিদেশি ভিজ়িটরদের সফরে নিষেধাজ্ঞা, বিদেশ থেকে যাঁরা দেশে ফিরবেন তাঁদের জন্য 14 দিনের কোয়ারান্টিনে রাখার নিয়ম পালন ৷ স্কুল বন্ধ রাখা এবং যাবতীয় উৎসব, অনুষ্ঠান সেখানে বাতিল করা হয় । তাছাড়াও WHO—এর সুপারিশ জারি হওয়ার আগেই প্রকাশ্যে মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল । একইসঙ্গে জরুরি ঘোষণা হয়েছিল বাড়ির বাইরে বেরোলে, কাজের জায়গায় ও আবাসনগুলিতে স্যানিটাইজার ব্যবহার । দেশজুড়ে কোনও অত্যাবশকীয় পরিষেবা বন্ধ করা হয়নি, তবে চলাফেরার উপর কড়া নজরদারি আরোপ করা হয়েছিল ।
  • প্রাথমিক স্বাস্থ্যস্তরে কড়া নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি: উন্নত অর্থনীতির দেশগুলিতে যেখানে গণহারে পরীক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই ভিয়েতনাম গুরুত্ব দিয়েছিল ঝুঁকিপূর্ণ এবং সন্দেহভাজন কোরোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার উপরে এবং দ্রুত হারে পরীক্ষার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছিল ৷ SARS-এর প্রকোপের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভিয়েতনাম সন্দেহভাজন কোরোনা হটস্পটগুলিতে গণ কোয়ারান্টিনের ব্যবস্থা করে ৷ সময়ের ভিত্তিতে এপিডেমিওলজিক্যাল প্রমাণের উপর নির্ভর করে । যার ফলে প্রতি 1000 জন পিছু নিশ্চিত কোরোনা আক্রান্তের পরীক্ষা করা সম্ভব হয়, যে হার বিশ্বে সর্বোচ্চ । যেই মাত্র কোনও কোরোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হতেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সরকার পরিচালিত কোনও স্থান যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মিটরি বা সেনা বারাকে রেখে দেওয়া হত । তাঁর সংস্পর্শে আসার সমস্ত রাস্তা ‘স্ট্যান্ড বাই’-তে রেখে দেওয়া হত, কেউ উপসর্গবিহীন হলেও । পাশাপাশি চলত ব্যাপক হারে ‘কনট্যাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন এবং কোয়ারান্টিনিং, অন্তত তিন স্তর পর্যন্ত । নিশ্চিত কোরোনা আক্রান্তের কাছাকাছি যারা থাকত, কখনও কখনও গোটা একটা রাস্তা বা গ্রামজুড়ে, তাদেরও পরীক্ষা করা হত ও আইসোলেশনে রাখা হত, যাতে গোষ্ঠী সংক্রমণ না হয় । এইভাবে অন্তত 45,000 মানুষকে কোয়ারান্টিন করে রাখা হয়েছে (হয় হাসপাতাল বা সরকার পরিচালিত স্থান বা সেলফ আইসোলেশনে)।
  • স্পষ্ট, স্থায়ী ও সৃষ্টিশীল জনস্বাস্থ্য মেসেজিং: একাধিক মানুষের কাছ থেকে গোষ্ঠীগত প্রতিক্রিয়া পেতে এই প্রক্রিয়া কাজে লেগেছে । গোড়া থেকেই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশল জানানোর বিধি ছিল স্বচ্ছ । উপসর্গ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং পরীক্ষাকেন্দ্রের নাম গণমাধ্যম, সরকারি ওয়েবসাইট, তৃণমূল স্তরের সংগঠন, হাসপাতাল, অফিস, আবাসন ও বাজারে, মোবাইল ফোনে ভয়েস মেসেজ বা টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে পাঠানোর বন্দোবস্ত গ্রহণ করা হয়েছিল । এই সুসংহত মাল্টি-মিডিয়া পদক্ষেপ এবং সবসময় খবরাখবর নেওয়ার উদ্যোগ জনতার মধ্যে সরকারি ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্বাস তৈরি করেছিল এবং সমাজকে একটি নিরাপত্তার বার্তা দিয়েছিল, যেখানে প্রতিটি নাগরিক নিজ নিজ ভূমিকা পালনে উদ্যোগী হয়েছিল । তা সে প্রকাশ্যে মাস্ক পরাই হোক বা কোয়ারান্টিনে সপ্তাহের পর সপ্তাহ থাকাই হোক ।

ঘরের কাছেই অবস্থিত শ্রীলঙ্কার দিকে তাকানো যাক । এই ছোটো দ্বীপরাষ্ট্রটিও প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণে তুলনামূলকভাবে ভালোই সফল হয়েছে । শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল যথেষ্টই উপরের দিকে কারণ এখানে দেশজুড়ে সকলে যেতে পারেন এমন হাসপাতাল রয়েছে, যোগ্য স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন আর আছে স্থানীয় প্রশাসন ৷ জন স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে জনস্বাস্থ্য ইনস্পেক্টর মোতায়েন করা হয় প্রশাসনের তরফে । যদিও এত বিপুল হারে ভাইরাস সংক্রমণ রুখতে প্রতিষ্ঠানগত সাহায্যের এখানে ঘাটতি রয়েছে, তবু সেনাবাহিনী এখানে সাহায্যের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছে । তারা দেশের কোয়ারান্টিন সেন্টারগুলির হাল খতিয়ে দেখে, কনট্যাক্ট ট্রেসিং নজরদারি করে । পুলিশ এখানে কারফিউ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নিয়মলঙ্ঘনের ঘটনায় পদক্ষেপ নেয় এবং সন্দেহভাজন নিয়ম লঙ্ঘনকারীকে গ্রেপ্তার করে । সরকার এছাড়াও আরও কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যার মধ্যে রয়েছে অন্তঃদেশীয় বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া, বাজারহাট ও গণপরিবহণ স্টেশনগুলিতে নিয়মিত জীবাণুনাশক ছড়ানো । এই সব স্থানেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনা ও পুলিশের কৃতিত্ব প্রশংসার দাবি রাখে । এখান থেকে ভারতের রাজ্যগুলি দু’টি প্রধান শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে ।

  • রোগ নজরদারির প্রতিষ্ঠিত বন্দোবস্ত : অসংখ্য ছোঁয়াচে ও অ-ছোঁয়াচে রোগের প্রকোপের অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রীলঙ্কা জনস্বাস্থ্য নজরদারিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে । সেটাই কোরোনা ভাইরাস প্যানডেমিক মোকাবিলায় তাদের কাজে এসেছে । এই দেশে ‘ওপেন সোর্স DHIS2 প্ল্যাটফর্মের উপর ভিত্তি করে 2020-র গোড়াতেই একটি নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে আর এরই মাধ্যমে তারা দেশের কোরোনা প্যানডেমিক পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে । এইভাবেই তারা জানুয়ারিতে দেশে প্রথম সন্দেহভাজন কোরোনা আক্রান্তের হদিশ পেয়েছিল । সরকার নিশ্চিত করেছে যে জনস্বাস্থ্যে কড়া নজরদারি চালু করা হয়েছে যাতে শ্বাসক্রিয়াজনিত অসুস্থতা কারও থাকলে, তাঁকে চিহ্নিত করা যেতে পারে । একবার সংক্রামিতকে চিহ্নিত করতে পারলে প্রয়োজনীয় ডায়াগনিস্টিকস পালন করা হবে । এর ফলে সন্দেহভাজন কোনও কোরোনা আক্রান্ত নজরদারির আওতার বাইরে থাকবে না ।
  • শ্রীলঙ্কার প্রাথমিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নেটওয়ার্কের উপর ক্রমাগত ভরসা করে যাওয়া : ভাইরাসের প্রকোপের সময় যেখানে বেশিরভাগ দেশে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই এই সরকার, তা করার বদলে, রোগীর বাড়িতে রুটিন চেকআপ এবং সরাসরি ওষুধপত্র পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল । কোভিড আক্রান্ত যারা নন, তারাও যাতে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরামর্শ স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকেই পেতে পারেন তার জন্য তৈরি করা হয়েছিল একটি হটলাইনও ।

একটা দারুণ তুলনামূলক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে কোনও দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে টিম স্পোর্টস যেমন ফুটবলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে । এই ধরনের খেলায়, সব খেলোয়াড় একজোট হয়ে গোল করার চেষ্টা করে ও টুর্নামেন্ট জেতার চেষ্টা করে । একইভাবে, COVID—১৯ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নজরদারি ও যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও এমনই নানা ক্ষেত্রের নানা প্রতিনিধিদের একজোট হয়ে, নানা স্তরে এই সংক্রমণ সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া উচিত । যত সুসংহত এবং ইতিবাচল দল হবে, রোগ নিয়ন্ত্রণে তত ভাল ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে এবং তত বেশি জনসংখ্যাকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হবে । এই ধরনের লক্ষ্যমুখী কর্মসূচি গ্রহণের ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর থেকে চাপ কমবে । আর এই ব্যবস্থাগুলি ভারতের রাজ্যগুলির পক্ষে কনটেনমেন্টের পরবর্তী দফার জন্য লাভজনক সাব্যস্ত হবে ।

(মতামত ব্যক্তিগত ৷ )

COVID—১৯ প্যানেডেমিক যে দ্রুত হারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তার জেরে স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা এবং সংস্থানের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে সকলেই । বেশিরভাগ দেশেই জাতীয় স্তরে নভেল কোরোনা ভাইরাস প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণে অন্তত কিছুটা হলেও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আন্তর্জাতিক ও অন্তঃদেশীয় স্তরে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করা, শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ রাখা, জনসমাগম নিষিদ্ধ করা তথা কোয়ারান্টিন চালু করা, হাত ধোওয়ার বিধির প্রচার করা, মাস্ক পরা প্রভৃতি ।

এছাড়াও প্রতিটি দেশ COVID—১৯ মোকাবিলায় সময়ভেদে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিচ্ছে । এর ফলে বদল এসেছে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে, এপিডেমিওলজিক্যাল কার্ভ এবং সামাজিক তথা অর্থনৈতিক ব্যয়ের ক্ষেত্রেও । যেহেতু বিভিন্ন দেশের রিপোর্টিংয়ের গুণমান, স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল, পরীক্ষা ব্যবস্থা এবং আক্রান্তকে শনাক্ত করার পদ্ধতি সবই আলাদা, তাই সামগ্রিকভাবে তাদের নিয়ে তুলনামূলক কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো বিভ্রান্তিকর হতে পারে ।

আরও সংক্ষিপ্ত এবং লক্ষ্যমুখী পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে সংক্রমণ প্রতিহত করা থেকে শুরু করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে প্রাণ বাঁচানোও সম্ভব হয়, তার জন্য WHO ছ’দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে । সেগুলি হল

  1. জনস্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা বাড়ানো, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও কাজে নিয়োগ করা
  2. সম্প্রদায়গতভাবে কে কে আক্রান্ত, তা খুঁজে বের করার ব্যবস্থা চালু করা
  3. পরীক্ষার হার এবং ক্ষমতা বাড়ানো
  4. রোগীদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা করে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা
  5. যোগাযোগের স্পষ্ট পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখা এবং আক্রান্তদের কোয়ারান্টিনে রাখার প্রক্রিয়া সচল রাখা
  6. মৃত্যুহার কমাতে জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু রাখা

দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এলাকার বেশিরভাগ দেশই COVID—১৯ কনটেনমেন্ট এবং নিয়ন্ত্রণে অপেক্ষাকৃত ভালো ফল করেছে ৷ তবে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করতে গেলে, এর মধ্যে কিছু কিছু দেশ নির্দিষ্টভাবে দেখে শেখার মতো কাজ করেছে । WHO—এর নির্দেশাবলী মেনে উপরোক্ত এলাকার তিনটি দেশ COVID—১৯ নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যধি মোকাবিলায় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে ভারতের রাজ্যগুলি ।

প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণ ও প্রস্তুতির নিরিখে শহরাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে সিঙ্গাপুর অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে । যে সব দেশ অনেক আগেই COVID—১৯ সংক্রমণ চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়েছিল, সেই তালিকায় অন্যতম সিঙ্গাপুর । ফেব্রুয়ারির গোড়াতেই COVID—১৯ শনাক্ত করে ফেলেছিল আর মে-জুন মাসের মধ্যেই অঞ্চল নিরিখে, সংক্রামিতের সংখ্যার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল । কিন্তু এই প্রতিবেদন লেখার সময়, এখন সেখানে সংক্রামিতর মোট সংখ্যা 55,580 থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন 51,049 জন ৷ মৃত্যু হয়েছে 27 জনের । প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণের জন্য সিঙ্গাপুরে জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল,

যেমন–

  • আরও বেশি সরকারি প্রতিক্রিয়া: অতীতে হওয়া SARS-এর প্রাদুর্ভাব থেকে শিক্ষা নিয়ে সিঙ্গাপুর কোভিড প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিয়েছিল । আর তা অনুসরণ করেই এই প্যানডেমিক প্রতিরোধে প্রস্তুতি নিতে তারা একাধিক সরকারি সংস্থার সঙ্গে মিলে পরিকল্পনা তৈরি করে, বিনিয়োগ বাড়ায়, স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ ভাগ করে দেয় এবং প্রায় নতুন করে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলে । আন্তঃসংস্থাভিত্তিক এহেন সহযোগিতার একটি উদাহরণ হল সেই চুক্তিপত্র, যা দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রক এবং সিঙ্গাপুর পুলিশের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্য বাহিনীর সঙ্গেও স্বাক্ষরিত হয় কেবলমাত্র কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব, হাত বারবার ধোওয়া এবং মাস্ক পরা সুনিশ্চিত করার জন্য ।
  • প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকে আরও সক্রিয় করে তোলা : সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রস্তুতি ক্লিনিকগুলিতে স্ক্রিনিং ‘সিলড’ করা হয় । যেহেতু প্রতিটি মানুষকে পরীক্ষা করা সম্ভব নয় আর এতে পরীক্ষাগারগুলির উপর চাপ বাড়তে পারে, তাই তা নিয়ন্ত্রণের জন্য ঠিক করা হয়, যাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে শ্রুশ্রূষা শুরু করে দেওয়া হবে । এই সব কিছুই সিঙ্গাপুর করেছিল 1000 টি জনসেবা প্রস্তুতিতে নিয়োজিত ক্লিনিকের মাধ্যমে ৷ যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী চিকিৎসকদের এই ধরনের প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল । আর এই তালিকায় ছিল সরকারি এবং বেসরকারি দু’ধরনের ক্লিনিকই ।
  • কঠোর অথচ লক্ষ্যমুখী কোয়ারান্টিন কর্মসূচি : ভারতের মতো সিঙ্গাপুরেও বিদেশি পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে অনেকে কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের কোনওভাবে আইসোলেট করা যাচ্ছিল না । পরিযায়ী শ্রমিকদের দ্রুত এবং কঠোর পরীক্ষা করানোর মাধ্যমে এবং শুধুমাত্র তাদেরই জন্য তৈরি বিশেষ আশ্রয়স্থলে তাদের কোয়ারান্টিনের ব্যবস্থা করে, যাতে সংক্রমণের চেন মাঝপথেই ভেঙে দেওয়া যায় । অনিশ্চয়তা এবং ব্যবধান ঘুচিয়ে জনগণের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর যাতে যুক্তিগতভাবে, যথেচ্ছভাবে এবং স্বচ্ছভাবে নেওয়া যায়, তার দিকে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে । এই যোগাযোগের মধ্যে একদিকে রয়েছে জনতা আর অন্যদিকে পৌর প্রশাসনের নেতারা । জাতীয় স্তরে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সাহায্যে (একতরফা মেসেজিং) সরকার নাগরিকদের প্রায়ই সংক্রমণ এড়ানোর বিশ্বস্ত তথ্য প্রদান করে চলেছে । আর শেষমেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল,
  • স্বাস্থ্যকর্মীদের সমর্থন, সংহতি এবং সক্রিয়তা : গোটা প্যানডেমিক জুড়ে এই স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে অতিরিক্ত বাহিনী, অস্বাস্থ্যক্ষেত্রের স্বেচ্ছাসেবী এবং নানা ধরনের স্বাস্থ্য তথা পৌর পরিষেবাক্ষেত্রের ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা পেশাদার কর্মীরা । সরকারি এবং বেসরকারি, দু'ক্ষেত্রেরই ফ্রন্টলাইন কর্মীরা একযোগে কাজ করেছেন ৷

তবে নভেল কোরোনা ভাইরাসের প্রতি ভিয়েতনাম যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাকে বিশ্বের অন্যতম সফল বলে ধরে নেওয়া হয় । এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে শুধুমাত্র তারাই নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন, যারা বিদেশ থেকে দেশে ফিরে কোয়ারান্টিনে ছিলেন । যদিও চলতি কিছু সপ্তাহে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণেরও খবর মিলেছে । ভিয়েতনামের স্ট্র্যাটেজি ছিল

  • গোটা সমাজকে নিয়ে চলা : এর আগে প্রধানমন্ত্রী আর্থিক উদ্বেগের তুলনায় স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এবং ভিয়েতনাম প্যানডেমিক মোকাবিলা নিয়ে একটি ‘ন্যাশনাল রেসপন্স প্ল্যান’ ও ‘ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটি’ তৈরি করেছিল । জনগণের প্রতি বার্তায় নাগরিকদের যুদ্ধের (এক্ষেত্রে কোরোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রূপক হিসাবে) বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল । সরকারি নানা স্তরের প্রাসঙ্গিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, নানাবিধ কর্মসূচিতে তাদের একজোট করে এগিয়ে নিয়ে চলা সহজ ছিল না । সংক্রমণ মোকাবিলা ও নিয়ন্ত্রণের কৌশল তৈরি করা হয়েছিল সেনা, জনস্বাস্থ্যপ্রতিনিধি, তৃণমূলস্তরের সংগঠন, সকলকে নিয়ে ৷ তা সফলভাবে বাস্তবায়িতও করা হয়েছিল ।
  • র‌্যাপিড কনটেনমেন্ট : কনটেনমেন্টের কঠোর নিয়মকানুন ধীরে ধীরে লাগু করা হয়েছিল । আর এর মধ্যে ছিল বিমানবন্দরে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত স্ক্রিনিং, সামাজিক দূরত্ববিধি বজায় রাখা, বিদেশি ভিজ়িটরদের সফরে নিষেধাজ্ঞা, বিদেশ থেকে যাঁরা দেশে ফিরবেন তাঁদের জন্য 14 দিনের কোয়ারান্টিনে রাখার নিয়ম পালন ৷ স্কুল বন্ধ রাখা এবং যাবতীয় উৎসব, অনুষ্ঠান সেখানে বাতিল করা হয় । তাছাড়াও WHO—এর সুপারিশ জারি হওয়ার আগেই প্রকাশ্যে মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল । একইসঙ্গে জরুরি ঘোষণা হয়েছিল বাড়ির বাইরে বেরোলে, কাজের জায়গায় ও আবাসনগুলিতে স্যানিটাইজার ব্যবহার । দেশজুড়ে কোনও অত্যাবশকীয় পরিষেবা বন্ধ করা হয়নি, তবে চলাফেরার উপর কড়া নজরদারি আরোপ করা হয়েছিল ।
  • প্রাথমিক স্বাস্থ্যস্তরে কড়া নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি: উন্নত অর্থনীতির দেশগুলিতে যেখানে গণহারে পরীক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই ভিয়েতনাম গুরুত্ব দিয়েছিল ঝুঁকিপূর্ণ এবং সন্দেহভাজন কোরোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার উপরে এবং দ্রুত হারে পরীক্ষার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছিল ৷ SARS-এর প্রকোপের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভিয়েতনাম সন্দেহভাজন কোরোনা হটস্পটগুলিতে গণ কোয়ারান্টিনের ব্যবস্থা করে ৷ সময়ের ভিত্তিতে এপিডেমিওলজিক্যাল প্রমাণের উপর নির্ভর করে । যার ফলে প্রতি 1000 জন পিছু নিশ্চিত কোরোনা আক্রান্তের পরীক্ষা করা সম্ভব হয়, যে হার বিশ্বে সর্বোচ্চ । যেই মাত্র কোনও কোরোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হতেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সরকার পরিচালিত কোনও স্থান যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মিটরি বা সেনা বারাকে রেখে দেওয়া হত । তাঁর সংস্পর্শে আসার সমস্ত রাস্তা ‘স্ট্যান্ড বাই’-তে রেখে দেওয়া হত, কেউ উপসর্গবিহীন হলেও । পাশাপাশি চলত ব্যাপক হারে ‘কনট্যাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন এবং কোয়ারান্টিনিং, অন্তত তিন স্তর পর্যন্ত । নিশ্চিত কোরোনা আক্রান্তের কাছাকাছি যারা থাকত, কখনও কখনও গোটা একটা রাস্তা বা গ্রামজুড়ে, তাদেরও পরীক্ষা করা হত ও আইসোলেশনে রাখা হত, যাতে গোষ্ঠী সংক্রমণ না হয় । এইভাবে অন্তত 45,000 মানুষকে কোয়ারান্টিন করে রাখা হয়েছে (হয় হাসপাতাল বা সরকার পরিচালিত স্থান বা সেলফ আইসোলেশনে)।
  • স্পষ্ট, স্থায়ী ও সৃষ্টিশীল জনস্বাস্থ্য মেসেজিং: একাধিক মানুষের কাছ থেকে গোষ্ঠীগত প্রতিক্রিয়া পেতে এই প্রক্রিয়া কাজে লেগেছে । গোড়া থেকেই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশল জানানোর বিধি ছিল স্বচ্ছ । উপসর্গ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং পরীক্ষাকেন্দ্রের নাম গণমাধ্যম, সরকারি ওয়েবসাইট, তৃণমূল স্তরের সংগঠন, হাসপাতাল, অফিস, আবাসন ও বাজারে, মোবাইল ফোনে ভয়েস মেসেজ বা টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে পাঠানোর বন্দোবস্ত গ্রহণ করা হয়েছিল । এই সুসংহত মাল্টি-মিডিয়া পদক্ষেপ এবং সবসময় খবরাখবর নেওয়ার উদ্যোগ জনতার মধ্যে সরকারি ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্বাস তৈরি করেছিল এবং সমাজকে একটি নিরাপত্তার বার্তা দিয়েছিল, যেখানে প্রতিটি নাগরিক নিজ নিজ ভূমিকা পালনে উদ্যোগী হয়েছিল । তা সে প্রকাশ্যে মাস্ক পরাই হোক বা কোয়ারান্টিনে সপ্তাহের পর সপ্তাহ থাকাই হোক ।

ঘরের কাছেই অবস্থিত শ্রীলঙ্কার দিকে তাকানো যাক । এই ছোটো দ্বীপরাষ্ট্রটিও প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণে তুলনামূলকভাবে ভালোই সফল হয়েছে । শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল যথেষ্টই উপরের দিকে কারণ এখানে দেশজুড়ে সকলে যেতে পারেন এমন হাসপাতাল রয়েছে, যোগ্য স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন আর আছে স্থানীয় প্রশাসন ৷ জন স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে জনস্বাস্থ্য ইনস্পেক্টর মোতায়েন করা হয় প্রশাসনের তরফে । যদিও এত বিপুল হারে ভাইরাস সংক্রমণ রুখতে প্রতিষ্ঠানগত সাহায্যের এখানে ঘাটতি রয়েছে, তবু সেনাবাহিনী এখানে সাহায্যের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছে । তারা দেশের কোয়ারান্টিন সেন্টারগুলির হাল খতিয়ে দেখে, কনট্যাক্ট ট্রেসিং নজরদারি করে । পুলিশ এখানে কারফিউ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নিয়মলঙ্ঘনের ঘটনায় পদক্ষেপ নেয় এবং সন্দেহভাজন নিয়ম লঙ্ঘনকারীকে গ্রেপ্তার করে । সরকার এছাড়াও আরও কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যার মধ্যে রয়েছে অন্তঃদেশীয় বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া, বাজারহাট ও গণপরিবহণ স্টেশনগুলিতে নিয়মিত জীবাণুনাশক ছড়ানো । এই সব স্থানেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনা ও পুলিশের কৃতিত্ব প্রশংসার দাবি রাখে । এখান থেকে ভারতের রাজ্যগুলি দু’টি প্রধান শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে ।

  • রোগ নজরদারির প্রতিষ্ঠিত বন্দোবস্ত : অসংখ্য ছোঁয়াচে ও অ-ছোঁয়াচে রোগের প্রকোপের অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রীলঙ্কা জনস্বাস্থ্য নজরদারিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে । সেটাই কোরোনা ভাইরাস প্যানডেমিক মোকাবিলায় তাদের কাজে এসেছে । এই দেশে ‘ওপেন সোর্স DHIS2 প্ল্যাটফর্মের উপর ভিত্তি করে 2020-র গোড়াতেই একটি নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে আর এরই মাধ্যমে তারা দেশের কোরোনা প্যানডেমিক পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে । এইভাবেই তারা জানুয়ারিতে দেশে প্রথম সন্দেহভাজন কোরোনা আক্রান্তের হদিশ পেয়েছিল । সরকার নিশ্চিত করেছে যে জনস্বাস্থ্যে কড়া নজরদারি চালু করা হয়েছে যাতে শ্বাসক্রিয়াজনিত অসুস্থতা কারও থাকলে, তাঁকে চিহ্নিত করা যেতে পারে । একবার সংক্রামিতকে চিহ্নিত করতে পারলে প্রয়োজনীয় ডায়াগনিস্টিকস পালন করা হবে । এর ফলে সন্দেহভাজন কোনও কোরোনা আক্রান্ত নজরদারির আওতার বাইরে থাকবে না ।
  • শ্রীলঙ্কার প্রাথমিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নেটওয়ার্কের উপর ক্রমাগত ভরসা করে যাওয়া : ভাইরাসের প্রকোপের সময় যেখানে বেশিরভাগ দেশে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই এই সরকার, তা করার বদলে, রোগীর বাড়িতে রুটিন চেকআপ এবং সরাসরি ওষুধপত্র পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল । কোভিড আক্রান্ত যারা নন, তারাও যাতে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরামর্শ স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকেই পেতে পারেন তার জন্য তৈরি করা হয়েছিল একটি হটলাইনও ।

একটা দারুণ তুলনামূলক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে কোনও দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে টিম স্পোর্টস যেমন ফুটবলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে । এই ধরনের খেলায়, সব খেলোয়াড় একজোট হয়ে গোল করার চেষ্টা করে ও টুর্নামেন্ট জেতার চেষ্টা করে । একইভাবে, COVID—১৯ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নজরদারি ও যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও এমনই নানা ক্ষেত্রের নানা প্রতিনিধিদের একজোট হয়ে, নানা স্তরে এই সংক্রমণ সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া উচিত । যত সুসংহত এবং ইতিবাচল দল হবে, রোগ নিয়ন্ত্রণে তত ভাল ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে এবং তত বেশি জনসংখ্যাকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হবে । এই ধরনের লক্ষ্যমুখী কর্মসূচি গ্রহণের ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর থেকে চাপ কমবে । আর এই ব্যবস্থাগুলি ভারতের রাজ্যগুলির পক্ষে কনটেনমেন্টের পরবর্তী দফার জন্য লাভজনক সাব্যস্ত হবে ।

(মতামত ব্যক্তিগত ৷ )

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.