কোভিড-19 প্যানডেমিকের ধাক্কায় বিশ্বজুড়ে বসে গিয়েছে অর্থনীতির চাকা। সংক্রমণে নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হলে অর্থনীতির কিছুটা প্রাণ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর এবং সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কার দুভভুরি সুব্বারাওয়ের মতে, সরকারকে এখনই শিল্প এবং নাগরিকদের জন্য কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে । তবে কেন্দ্রীয় সরকারকে আর্থিক ঝুঁকি না নেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি । ইনাডুর বিশেষ সংবাদদাতা এমএল নরসীমা রেড্ডির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের বিশেষ কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হল ।
বিশ্ব অর্থনীতি, বিশেষ করে ভারতীয় অর্থনীতির উপর কোভিড-19 এর প্রভাব কী ?
আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF) ইতিমধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতিতে এই সংক্রমণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সাবধানবাণী শুনিয়েছে। ২০০৮ সালের মন্দার চেয়েও এর প্রভাব অনেকটাই বেশি হতে চলেছে । অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোরোনা যেন এক বহিঃশত্রুর আক্রমণ । চাহিদা ও জোগান বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পন্থাও অতীতে নেওয়া হয়েছে । এখন, সুদ কমানো এবং বাজারে অর্থের জোগান বাড়ানো হলেও লকডাউনের জেরে অর্থনীতির হাল খারাপই রয়েছে ।
কোরোনা আবহের আগেও অর্থনীতি বর্ণহীন ছিল। 2019-20 অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে GDP বৃদ্ধির হার ছিল 5 শতাংশের নীচে । চতুর্থ ত্রৈমাসিকের হাল ছিল আরও খারাপ । এর থেকে আর কতটা খারাপ হতে পারে ?
IMF-এর তথ্য অনুযায়ী, বৃদ্ধির হার 4.2 শতাংশ। মনে করা হচ্ছে যে, এটা কমে 1.9 শতাংশে চলে আসতে পারে। যেখানে উন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক । সেখানে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার 1.9 হলে তা কোনও অবস্থাতেই খারাপ নয় । তবে এটা আমাদের নিজেদের সাফল্যের শিঙা ফোঁকার সময় নয় । ভারতে দারিদ্রের হার চরম । অনুৎপাদক সম্পদ (NPA) এবং ঋণের ভারে আমাদের অর্থনীতি জর্জরিত। আমরা এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, যেখানে আমাদের পক্ষে আর ধার করাও সম্ভব নয় । কিন্তু আমাদের মূলধনে এখনও কোপ পড়েনি । ভূমিকম্প বা বন্যা হলে পুনর্গঠনের জন্যই আমাদের প্রচুর খরচ করতে হতো । কিন্তু কোরোনার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা আলাদা । আর সেই কারণেই এ ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে ।
বহু দেশ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে । ভারতও একই পথে হাঁটছে । এই ধরনের প্যাকেজ অর্থনীতির কতটা উন্নতি করতে পারবে বলে মনে হয় ?
ভারতের প্রায় 83 শতাংশ কর্মী কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে । সাম্প্রতিক লকডাউনে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন এঁরাই । সরকারের দায়িত্ব এদের পাশে দাঁড়ানো । এদের সাহায্য করা । গত মাসে অর্থমন্ত্রী আর্থিক ত্রাণের প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন । যা মোট GDP-এর 0.8 শতাংশ। অন্যান্য দেশের দিকে যদি নজর দেওয়া হয় কিংবা ভারতের অবস্থার দিকে যদি তাকানো হয়, তা হলে দেখা যাবে যে এই ত্রাণের পরিমাণ যথেষ্ট নয় । সরকারের হাতে যথেষ্ট টাকা নেই । রাজস্ব ঘাটতি এমনিতেই যথেষ্ট বেশি । লকডাউনের ফলে কর সংগ্রহেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে । কোভিড-19 এর আগে কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্মিলিত রাজস্ব ঘাটতি ছিল মোট GDP-এর 6.5 শতাংশ । এই পরিমাণ ইতিমধ্যেই 10 শতাংশের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে । আর্থিক প্যাকেজের জন্য অতিরিক্ত ঋণ করলে তাতে বোঝা অতিরিক্ত বেড়ে যাবে । কেন্দ্র যদি ঠিক করে যে, মোট GDP এর 2 থেকে 2.5 শতাংশ পর্যন্ত কোরোনা ত্রাণে খরচ করবে, তা হলে সরকারকে সেই অনুযায়ী ঋণ করতে হবে । এর ফলে যে সমস্যা হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই । অতিরিক্ত ঋণের ফলে আমাদের রেটিং কমে যেতে পারে । বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হতে পারে । তার পর সমস্যা শুরু হবে বিদেশি মুদ্রা বিনিময় নিয়ে । মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে । কেন্দ্রকে এমন এক পরিকল্পনা নিয়ে ঋণ নিতে হবে, যেখানে স্পষ্ট করে বলা থাকবে যে কোরোনা মোকাবিলায় করা এই ঋণ আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে শোধ করে দেওয়া হবে । এর ফলে বাজারের ভরসা ফিরে আসবে।
লকডাউন উঠে যাওয়ার পর কোন সমস্যার সমাধান সবার আগে করা উচিত বলে আপনার মনে হয় ?
RBI যদি মোরাটোরিয়াম প্রয়োগ করে বা বাজারে অর্থের জোগান বাড়িয়ে দেয় বা সুদ আরও কমিয়ে দেয়, তা হলেও এই অবস্থার হঠাৎ পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না । সাহায্য করতে হবে পরিকাঠামো এবং গৃহ নির্মাণ শিল্পকে । সরকারের উচিত বড় সংস্থাগুলিকে তাদের বকেয়া অর্থ দিয়ে দেওয়া । এর ফলে এই সব সংস্থা ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থাগুলিকে অর্থ দিতে পারবে । এর ফলে নগদের চলাচল বাড়বে । কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় ঋণ করতে হবে । RBI সুদ কমিয়ে দিলেও বিপুল পরিমাণ অনুৎপাদক সম্পদের জন্য ব্যাঙ্কগুলি ঋণ দিতে ভয় পাবে । এই ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে । 2008 সালের আর্থিক মন্দার সময় আমেরিকা যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, তাতে কর ছাড় থেকে সংস্থাগুলিকে উজ্জীবিত করার মতো একাধিক ঘোষণা ছি ল। এই অবস্থায় ভারত সরকারকেও এই ধরনের প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে ।
কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং এবং হেলিকপ্টার মানির মতো আর্থিক নীতি প্রয়োগ করা যায় কি না সে বিষয়ও আলোচনা হচ্ছে । এ বিষয়ে আপনার কী মত ?
ভারতের অবস্থা এখনও অতটা খারাপ নয় । 2008-09 অর্থবর্ষে আর্থিক মন্দার সময় অ্যামেরিকা ও ইউরোপ কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং নীতির প্রয়োগ করেছিল । প্রতিটা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক দেশের মোট নগদের উপর নজর রাখে । বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এবং মিউচুয়াল ফান্ড কম্পানিগুলো সরকারি বন্ড ধরে রাখে । কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এই সব বন্ড কিনে নিয়ে নগদের জোগান ঠিক রাখে । এটা একটা প্রাত্যহিক প্রক্রিয়া । 2008-09 অর্থবর্ষে বন্ড কেনার পরেও নগদের জোগান যথেষ্ট ছিল না । সেই অবস্থায় নগদের জোগান বাড়াতে ব্যাঙ্ক তখন কর্পোরেট বন্ড, মর্টগেজ কিনতে থাকে । ভারতের ক্ষেত্রে, সরকারি বন্ড কেনা ছাড়া RBI-এর অন্য কোনও বন্ড কেনার এক্তিয়ারই নেই । প্রয়োজন হলে আইন সংশোধন করা যেতে পারে । কিন্তু আমরা এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছাইনি । হেলিকপ্টার মানির ক্ষেত্রে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বেশি করে নোট ছাপিয়ে তা সরকারের হাতে তুলে দেয় । বাজারে নগদের জোগান বাড়াতে সরকার তখন বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এই টাকা সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেয় । এর ফলে বাজারে পণ্য ও পরিষেবা সংক্রান্ত চাহিদা বাড়বে । অর্থাৎ, কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং এবং হেলিকপ্টার মানির মধ্যে স্পষ্টতই প্রভেদ রয়েছে । কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের ক্ষেত্রে উলটো পথে আমরা বাজারে টাকার জোগান বাড়াতে পারি । এই বিষয়টি হেলিকপ্টার মানির মাধ্যমে কখনওই করা সম্ভব নয় । অ্যামেরিকার ফেডারেল রিজার্ভের প্রাক্তন চেয়ার বেন বার্নানকে জাপানের ক্ষেত্রে হেলিকপ্টার মানি নীতি প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছিলেন । অবশ্যই জাপান এই পরামর্শ গ্রহণ করেনি । এমনকি 2008 সালের বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার সময়ও আমেরিকা হেলিকপ্টার মানি নীতির প্রয়োগ করেনি । তাই খুব সম্ভবত ভারতও এই নীতির প্রয়োগ করবে না । কোনও দেশ যদি হেলিকপ্টার মানি নীতির প্রয়োগ করে, তা হলে সে দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে ।
পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা আমরা কী ভাবে দূর করব ?
ভারতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হলেন এই পরিযায়ী শ্রমিকরা । অসংগঠিত ক্ষেত্রের সমস্যাগুলির এই মুহূর্তে সমাধান করা সম্ভব নয় । আন্তরাজ্য শ্রমিকরা থাকবেন । কিন্তু সরকারকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ করতে হবে । তাঁদের থাকার সুব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে ।
বর্তমানের কোরোনা সঙ্কটকে কি 2008-09 এর আর্থিক মন্দার অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা ঠিক ? কোন অবস্থাটা বেশি ভয়ঙ্কর বলে আপনি মনে করেন ?
কোভিড-19 এর ফলে অর্থনীতিতে মন্দা মারাত্মক অবস্থায় যেতে পারে । আর্থিকক্ষেত্রে বিশ্বজোড়া মন্দা শুরু হয়েছিল এক দশক আগে থেকে । এই ক্ষেত্রের সম্ভাব্য ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা মাথায় রেখে উন্নত দেশের ব্যাঙ্ক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল । এর ফলে মানুষ তাঁদের সম্পদ হারিয়েছিলেন । এর প্রভাব অর্থনীতিতেও পড়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে 2008-09 এর আর্থিক মন্দার অবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা । বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এক প্যানডেমিকের জন্য । যা প্রথমে অর্থনীতিতে আঘাত করে এবং তার পরে বিভিন্ন আর্থিক ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে । চাহিদা ও জোগানের চেন ভেঙে পড়েছে । যেহেতু এই দুই পরিস্থিতির মূল কারণটা ভিন্ন, তাই দুই ক্ষেত্রেই সমাধানটাও ভিন্ন । সেই সময়ে, আর্থিক ক্ষেত্রগুলির সাহায্যের প্রয়োজন ছিল । আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে টেনে তুলতেই হতো । এর ফলে সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতি উজ্জীবিত হতো । কিন্তু এখন সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করতে সবার আগে প্রয়োজন এই প্যানডেমিককে নিয়ন্ত্রণে আনা । অর্থাৎ, সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতি চাঙ্গা হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিও চাঙ্গা হবে । এই সমস্যার ক্ষেত্রও আলাদা । 2008-09 অর্থবর্ষে আমেরিকার মর্টগেজ ক্ষেত্র থেকে সমস্যার শুরু হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে । আর এ বার, চিনের উহান থেকে কোরোনা ভাইরাস সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে ।