ভারতীয় রাজনীতি এবং তার সঙ্গে ভারতের গণতন্ত্র আজ দুর্নীতির এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন অপরাধে অভিযুক্ত ও দোষীদের দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলে যোগদানের আহ্বান জানানো হচ্ছে ৷ আর এই বিষয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলই একই পথের পথিক ৷ প্রত্যেকে সমানভাবে দায়ি ৷ অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট করাতে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে দেশের সংবিধানের 324 নম্বর অনুচ্ছেদ ৷ অপরাধে যুক্তদের দেশের রাজনৈতিক পরিধিতে প্রবেশ আটকাতে এই ক্ষমতা যে যথেষ্ট নয় এবং ক্ষমতা যে নীতি নির্ধারণ ও সংস্কারের প্রস্তাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা এখন সকলের জানা ৷ এরপরও কিছু মামলা আদালতের চৌহদ্দি পর্যন্ত গড়ায়, যেখানে দাবি করা হয় সরকার তাদের নীতি-নির্ধারণ ও সহজ সমাধানের আশায় সুবিধাজনক সংস্কার করেছে, যাতে অপরাধে যুক্তদের সুবিধা দেওয়া যায় ৷
এই মামলার শুনানিতে নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, অপরাধীদের রাজনীতিতে আসতে চাওয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলির তাতে প্রশ্রয় দেওয়ার ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ৷ যদিও সুপ্রিম কোর্ট সেই যুক্তি খারিজ করে দিয়েছে ৷ আদালতের মতে যে সমস্ত রাজনৈতিক দল অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদের দলে নিচ্ছে এবং তাদের আড়াল করছে, তারা নিশ্চয় এর কারণ ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হবে ৷ এর যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা প্রকাশ্যে আসা উচিত বলেই মনে করছে আদালত ৷ আদালত জানিয়েছে, একজন প্রার্থীর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তাঁর শক্তি-দুর্বলতা, সম্পদ, দায়-দায়িত্বের সঙ্গে অতীতের কাজের খতিয়ানও ঘোষণা করা উচিত ৷ আর তা করতে হবে খবরের কাগজ, সোশাল মিডিয়া ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের ওয়েবসাইটে ৷ একই সঙ্গে এও জানাতে হবে যে কেন তাঁকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নেওয়া হল ৷ অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগে পর্যন্ত একজন অভিযুক্ত দোষী নয় ৷ এই নীতিকথা মাথায় রেখেও আদালত মনে করছে বড় অভিযোগ, যা জটিলতা তৈরি করতে পারে, তার সঙ্গে ছোট অভিযোগের পার্থক্য দেখা হচ্ছে না ৷ আদালত সংসদকে পরামর্শ দিয়েছে এমন একটি আইন তৈরি করার, যাতে অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিরা জনজীবনে না আসতে পারে ৷ এবং আইন তৈরিতে কোনও ভূমিকা না নিতে পারে ৷ আর আদালত কাউকে নির্বাচনে লড়াই করা থেকে আটকাতে পারে না ৷ বিচারব্যবস্থা সেই পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, যেখানে মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষদিন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ ওঠে ৷ একই সঙ্গে ব্যাপক সংস্কার ছাড়া এই দেশের রাজনীতিকে অপরাধীমুক্ত করা যাবে না ৷
"ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, জেলাশাসক, পুলিশ সুপার কিংবা বিচারক হওয়ার মতো পেশায় অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদের কোনও জায়গা নেই ৷ সেখানে অপরাধে অভিযুক্তদের বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী করাটা একেবারে অযৌক্তিক নয় কি !" ঠিক এই কারণেই অশ্বিনীকুমার উপাধ্যায় জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন ৷ এর আগে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ বলেছিলেন, কোনও কোনও মামলার নিষ্পত্তি হতে লেগে যায় প্রায় 20 বছর ৷ ততদিনে যিনি অভিযুক্ত, তিনি অন্তত চারবার জন প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে চলে আসেন ৷ 14 তম লোকসভায় অপরাধে অভিযুক্ত সাংসদের সংখ্যা ছিল 24 শতাংশ ৷ 15 তম লোকসভায় তা বেড়ে দাঁড়ায় 30 শতাংশ ৷ 16 তম লোকসভায় এই পরিসংখ্যান ছিল 34 শতাংশ ৷ আর চলতি লোকসভায় অপরাধে অভিযুক্ত সাংসদের সংখ্যা 43 শতাংশ ৷ সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক তথ্য হল এই লোকসভার 29 শতাংশ সাংসদের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে ৷ আরও খারাপ হল এই জনপ্রতিনিধিদের আবার ভোটে জিতে নেতা হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে ৷ তাই উপাধ্যায়ের দায়ের করা মামলায় তিনি আবেদন করেছেন যে 1968 সালের নির্বাচনী প্রতীক রুল বুকে কড়া কোনও নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে অপরাধে অভিযুক্তরা কোনওভাবেই নির্বাচনে লড়াইয়ের সুযোগ না পায় ৷
আবেদনে আরও বলা হয়েছে যে পাঁচ বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য কারাবাসে সাজাপ্রাপ্তদের ফৌজদারি অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হোক ৷ না হলে মনোনয়নের আগের এক বছরের মধ্যে অপরাধে অভিযুক্ত হলে, সেই সদস্যকেও ফৌজদারি অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হোক ৷ এ নিয়ে সাধারণ মানুষের তরফে বারবার আবেদন করা হয়েছে ৷ কিন্তু কবে এই আইনভঙ্গকারীদের তৈরি করা শক্তভিত ধ্বংস করা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে ৷ দুষ্কৃতী, পুলিশ, শুল্ক আধিকারিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের মধ্যে যে বেআইনি যোগাযোগ আছে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ 1993 সালের মুম্বই বোমা বিস্ফোরণ ৷ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সাধারণ মানুষ এই জিনিসটি চলতে দেখেছেন ৷ রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের সন্ধান করতে তৈরি হয়েছিল বোরহা কমিটি ৷ ওই কমিটি জানিয়েছিল যে বড় শহরের অপরাধী, প্রশাসন, পুলিশ এবং রাজনৈতিক নেতারা হাত মিলিয়েছে ৷ রাজনৈতিক নেতাদের টাকাই নির্বাচনের সময় এই নেটওয়ার্ককে আরও বড় আকারে চালাতে সাহায্য করে ৷
দু’দশক আগে এই রিপোর্ট তৈরির সময়ই স্পষ্ট হয়েছিল যে অপরাধ নির্মূল করার জন্য তৈরি ফৌজদারি বিচারবিভাগ বিশাল এই মাফিয়া নেটওয়ার্ক বন্ধ করতে কিছুই করতে পারেনি ৷ যদিও সরকার বোরহা কমিটির রিপোর্টকে লালফিতের ফাঁসেই আটকে রাখে ৷ ফলে নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহারের জেরে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন আরও বেড়েছে ৷ 1999 ও 2014 সালের বিচারপতি কমিটির রিপোর্ট, 2002 সালের সাংবিধানিক রিভিউ কমিটির রিপোর্ট এবং দ্বিতীয় অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কমিটির পরামর্শ-সহ 2004 সালে নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের প্রস্তাব, সবক’টিই রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন রুখে দেশকে বাঁচানোর পরামর্শ দিয়েছিল ৷ দেশের ভালো করার চেয়েও ক্ষমতা দখলের স্বার্থপর ইচ্ছে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলি অপরাধীদের সংসদীয় রাজনীতিতে নিয়ে আসে ৷ যতক্ষণ না রাজনৈতিক দলগুলি এ নিয়ে সতর্ক এবং সংকীর্ণ মনোভাব ত্যাগ করছে, ততদিন সর্বতোভাবে স্বচ্ছ ভারত তৈরি করা সম্ভব নয় ৷