পূর্ব লাদাখে সীমান্ত বরাবর গোলমাল চলছে ৷ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী চিনের একাধিক জিনিসের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর ভারত চিনের নাগরিকদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আনতে চলেছে । এই পরিস্থিতিতে চিনের সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে , নয়াদিল্লি তাদের শত্রু নয় । কিন্তু একজন প্রাক্তন কূটনীতিক বলছেন , উত্তরের প্রতিবেশীর কাজের সঙ্গে কথার কোনও মিল নেই ।
চিনে সরকারি সহায়তায় পরিচালিত ইংরেজি ভাষার দৈনিক দ্য গ্লোবাল টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে । যেখানে লেখা হয়েছে, " সীমান্তে গোলমালের জন্য যে চিন বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে, তার জেরে ভারত ভিসা নীতিতেও বিধিনিষেধ আনছে । " ব্লুমবার্গ নামে একটি সংবাদমাধ্যমকে উদ্ধৃত করে ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ৷ সেখানে বলা হয়েছে যে চিনের ব্যবসায়ী, শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ও যারা আইনি পেশার সঙ্গে জড়িত, তাদের ভিসা দেওয়া হচ্ছে না । যদি তা সত্যি হয়, আর তাহলে এটা " রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যা সীমান্তে গন্ডগোলের জেরে চিন বিরোধী মনোভাব থেকে তৈরি হয়েছে । "
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, " ভারত ভুল ভাবে চিনকে তাদের শত্রু ভাবছে । " ওই প্রতিবেদনে চেংডু ইনস্টিটিউট অফ ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট লং জিংচুনের একটি বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে । তিনি বলেছেন , " চিনা নাগরিকদের ভিসা আটকে দেওয়া পুরোপুরিভাবে ভারতীয় আধিকারিকদের রাজনৈতিক অভিসন্ধী । দেশীয় জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে রাজনীতিবিদরা এক চিন বিরোধী মনোভাব পোষণ করছেন । জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে তারা কতটা দেশপ্রেমিক, তার প্রমাণ এই ঘটনাতেই পাওয়া যাচ্ছে । "
জুন মাসে লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভারত ও চিন দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় । তার জেরে 45 বছরের মধ্যে প্রথমবার দুই পক্ষের বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয় । এর ফলে দিল্লি 59 টি চিনা অ্যাপের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে । তার সোশাল নেটওয়ার্কে ভিডিয়ো শেয়ার করার অ্যাপ টিকটকও ছিল । এরপর ভারত চিনা নাগরিকদের ভিসা নিয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা শুরু করেছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ।
দিল্লি ও বেজিংয়ের মধ্যে কূটনৈতিক ও সেনা আলোচনা ফের বন্ধ হওয়ার অবস্থায় চলে এসেছে । কারণ, চলতি মাসের শুরুতে চিন পূর্ব লাদাখের প্যাংগং সো, গালওয়ান উপত্যকা, ডেসপাং সমতল ও গোগরা এলাকাকে নিজেদের বলে দাবি করে তাতে অনড় রয়েছে । লংকে উদ্ধৃত করে দ্য গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে ৷ সেখানে লং জানিয়েছেন , " দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যতবার গোলমাল হয়েছে, ততবারই চিনের উপর ভিসা নীতি নিয়ে কড়াকড়ি করে ভারত । "
লং বলেন, " মহামারী (COVID-19) এবং চিন বিরোধী মনোভাব, উভয়ের জন্য চিনা নাগরিকদের ভারতে আসা আটকে দিচ্ছে ভারত । মহামারীর আগে যে স্থিতাবস্থা ছিল, ভারত ও চিনের মধ্যে সেই পরিস্থিতি ফিরতে অন্তত আরও এক বছর সময় লাগবে । দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আবার ভালো হতে অন্তত দীর্ঘ সময় লাগবেই । " ইতিমধ্যে ভারতের শিক্ষামন্ত্রক ভারতের স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সহযোগিতায় চিনের কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের যে বিভাগ চলছে, তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে ।
চিনের সরকারি শিক্ষা সংক্রান্ত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে অন্যদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অংশীদারিত্বের মাধ্যমেই চলে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট । এই অংশীদারিত্বে অর্থ বিনিয়োগ করা এবং তা দেখভাল করার কাজ করে হ্যানবেন ( সরকারিভাবে চাইনিজ ল্যাঙ্গুয়েজ কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনালের অফিস ), যা চিনের শিক্ষামন্ত্রকের সঙ্গে সংযুক্ত ।
এই কর্মসূচির নির্ধারিত লক্ষ্য হল চিনের ভাষা ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরা, স্থানীয় চিনা শিক্ষাদান পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক স্তরে সমর্থন করা এবং সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান করা । যে সমস্ত দেশে এটা পরিচালিত হয়, সেখানে চিনের প্রভাব বাড়ানোর অভিযোগ উঠছে । ফলে এই প্রক্রিয়া খুবই সমালোচিত হচ্ছে । 2004 সালে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট কর্মসূচি শুরু হয় ও তাতে সাহায্য করে হ্যানব্যান ৷ দেখাশোনার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলির । সারা বিশ্বের স্থানীয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এই ইনস্টিটিউট চলে । আর অর্থ বিনিয়োগ হ্যানব্যান ও আয়োজক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভাগাভাগি করে হয় ।
ফ্রান্সের অ্যালায়েন্স ফ্রান্সিস এবং জার্মানির গোথে ইনস্টিটিউট যেভাবে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে অন্য দেশে তুলে ধরে, সেই ভাবেই বেজিং কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট কর্মসূচিকে তুলে ধরতে চায় । তবে অ্যালায়েন্স ফ্রান্সিস ও গোথে ইনস্টিটিউট অন্যদেশে স্বাধীন ভাবে কাজ করে । কিন্তু কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটও তাদের মতো অন্য দেশের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কাজ করলেও চিনা সরকারের টাকায় চলে ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন যে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট আসলে চিনের ‘তীক্ষ্ণ ক্ষমতা’র সম্প্রসারণবাদ নীতির অংশ । দ্য গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদন আরও জানিয়েছে , এপ্রিলে ভারত যে বিনিয়োগ নীতি নিয়েছে, তা আসলে " চিনের বিনিয়োগকারীদের প্রতি বৈষম্য তৈরি করার জন্য বলেই বিশ্বাস হয় । "
গত কয়েক বছর ধরে ভারতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (FDI)-এর ক্ষেত্রে নিয়মনীতি ছিল খুবই নমনীয় । সংস্থাগুলিকে 100 শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ছাড় দেওয়া হয়েছে ৷ অনেকে ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থা ‘সরাসরি পথে’ বিনিয়োগ আনতে পেরেছে । ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্ত রয়েছে এমন দেশ, বিশেষ করে চিন এই অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে কম টাকায় এই দেশের সংস্থাগুলিকে অধিগ্রহণ করতে পারে এবং ভারতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে । এমন একটা উদ্বেগও তৈরি হয়েছে ।
এই ধরনের ‘সুবিধাবাদী’ বিনিয়োগকে আটকাতে ভারত ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট (নন ডেবট ইনস্ট্রুমেন্ট) রুলস, 2019 (রিভাইসড রুলস) সংশোধন করেছে । এই সংশোধিত নিয়ম অনুযায়ী, কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি, যিনি বিনিয়োগ করতে চাইছেন তিনি যদি ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্ত রয়েছে এমন কোনও দেশের বাসিন্দা হন, তাহলে ওই বিনিয়োগের জন্য ভারত সরকারের ছাড়পত্র লাগবে । এই নিয়ম চলতি বছরের 22 এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে ।
দ্য গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত চিন ভারতের শত্রু নয়, এই প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে চিনে কাজ করে আসা ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত গৌতম বোম্বেওয়ালে বলেন , বেজিংয়ের কাজের সঙ্গে কথার কোনও মিল নেই । ETV ভারতের প্রশ্নে বোম্বেওয়ালের প্রতিক্রিয়া, " যদি তুমি (চিন) ভারতকে শত্রু হিসেবে মনে না কর, তাহলে কেন তুমি লাদাখে স্থিতাবস্থায় ফিরে যাচ্ছ না ? " চিনের অ্যাপ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য কি ভারতের অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগবে না, এই প্রশ্নের উত্তরে প্রাক্তন ওই কূটনীতিক বলেন , এটা চিনের অর্থনীতিতেও আঘাত করবে । বোম্বেওয়ালে বিশেষ করে টিকটকের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন ৷ বলেছেন যে এটা তাদের ‘সত্যিই আঘাত করছে ।’ তিনি আরও বলেন, " ভারত নেতৃত্ব দিয়েছে (টিকটক নিষিদ্ধ করা) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এটাকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছে । "
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত ছাড়াও চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে নেমে পড়েছে, দক্ষিণ চিন সাগর অঞ্চলের দেশগুলি ও পূর্ব চিন সাগরে জাপান-সহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সম্প্রসারণবাদ নীতির জন্যও বেজিং সমস্যার মুখে পড়েছে । ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া একটি চতুর্দেশীয় জোট তৈরি করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে ৷ যা জাপানের পূর্ব উপকূল থেকে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ।