দিল্লি : চিনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে জাপান ৷ ঘটনাটি শুক্রবারের । তাদের বক্তব্য, চিনের উপকূলরক্ষী বাহিনীর দু'টি জাহাজ তাদের জলসীমার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল ৷ এই পরিস্থিতিতে জাপানের রাষ্ট্রদূত সাতোশি সুজুকি ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছেন ৷ ভারতের উত্তরদিকের প্রতিবেশীর সঙ্গে লাদাখের সীমান্তে যে লড়াই চলছে, তা নিয়েই ভারতের প্রতি সমর্থনের বার্তা দিয়েছেন তিনি ৷ এর দ্বারা নয়াদিল্লি ও টোকিওর মধ্যে শক্তিশালী কৌশলগত অংশীদারিত্বের বিষয়টিই প্রতিফলিত হয়েছে ৷
COVID পরবর্তী যুগে ভারত ও জাপানের সম্পর্ক নিয়ে একটি ভার্চুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল এখানে ৷ আয়োজন করেছিল বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ৷ সেখানেই সুজুকি বিদেশসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে বলেন , লাদাখে চিনের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (LAC) বরাবর যে কোনও ধরনের স্থিতাবস্থা পরিবর্তন করার ঘটনার তীব্র ভাবে বিরোধিতা করে টোকিও ৷ এই আলোচনার পর সুজুকি টুইটারে লিখেছেন, ‘‘FS শ্রিংলার সঙ্গে ভালো কথাবার্তা হল ৷ LAC নিয়ে তাঁর বিবৃতি প্রশংসা করার মতো ৷ একই সঙ্গে GOI (ভারত সরকার)-এর তরফেও শান্তিপূর্ণ ভাবে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার নীতিও প্রশংসনীয় ৷ জাপানও আশা করছে যে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিতেই গোটা বিষয়টি মিটে যাবে ৷ জাপান একতরফাভাবে যে কোনও ধরনের স্থিতাবস্থা বদল করার বিরোধী ৷’’
গত মাসে লাদাখ অঞ্চলের গালওয়ান উপত্যকায় চিনা সেনার সঙ্গে রক্তক্ষয়ী শারীরিক সংঘর্ষে 20 জন ভারতীয় সেনা-জওয়ান নিহত হন ৷ এর পর নয়াদিল্লি এবং বেজিং কূটনৈতিক এবং সেনাস্তরে আলোচনা করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছে ৷ পূর্ব চিন সাগরে যে বিতর্কিত সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে, সেখানে চিনের উপকূলরক্ষী বাহিনীর ভেসেল জাপানের জলসীমার মধ্যে ঢুকে পড়ে ৷ গতকাল, এই নিয়ে চিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে জাপান ৷ আর তার পরই সুজুকির এই মন্তব্য সামনে এল ৷
একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সন্ধে দু'টি চিনা জাহাজ সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের জলসীমায় ঢুকে পড়ে ৷ আর সেই দুইটি জাপানের ভেসেলর দিকে তেড়ে যায় ৷ বেজিং ওই দ্বীপপুঞ্জকে ডিয়ায়ু দ্বীপপুঞ্জ বলে থাকে ৷ গতকাল টোকিওতে সাংবাদিক বৈঠক করেন জাপানের প্রধান ক্যাবিনেট সচিব ইয়োশিহিডে সুগা ৷ সেখানে তিনি জানান যে জাপানের মাছ ধরার ভেসেলগুলির দিকে এগিয়ে চিনকে থামতে বলা হয় এবং তারা সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের জলসীমা থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায় ৷ সুগা বলেন, ‘‘আমরা বিষয়টির সঙ্গে লাগাতার শান্ত এবং অটলভাবে মোকাবিলা করব ৷’’22 জুনের পর এই প্রথমবার চিনা জাহাজ জাপানের জলসীমার মধ্যে ঢুকে পড়ল ৷ এটা মনে রাখতে হবে যে বেজিং এই জল-এলাকায় টানা 80 দিন ধরে জাহাজ পাঠিয়েছিল ৷ যদিও চিন এবং জাপান সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের উপর নিজেদের অধিকার দাবি করে ৷ কিন্তু 2012 সাল থেকে এই দ্বীপপুঞ্জে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে টোকিও ৷ এই দ্বীপপুঞ্জ পাঁচটি জনহীন দ্বীপ এবং তিনটি অনুর্বর শিলার সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে ৷ এর আকার ৮০০ বর্গ মিটার থেকে 4.32 বর্গ কিমি । এই অঞ্চলে চিনের সম্প্রসারণবাদী নীতি সাম্প্রতিক কালে প্রতিবেশীদের উত্তরোত্তর বিরোধিতার মুখে পড়েছে ৷
কেভি কেসভন ৷ অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ফেলো এবং জাপান সংক্রান্ত বিষয়ে অন্যতম ভারতীয় স্কলার ETV ভারত-কে জানিয়েছেন, এই অঞ্চলে ভারত ও জাপান যে দৃঢ় কৌশলগত সম্পর্কে আবদ্ধ, তা সুজুকির মন্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে ৷ কেসভন বলেন, ‘‘আমরা (ভারত ও জাপান) চিন সম্পর্কে সমানভাবে চিন্তিত ৷ এটা শুধু দ্বিপাক্ষিক দিক থেকেই নয় ৷ বরং অন্যদিক থেকেও ৷’’ 2017 সালে ভারত-চিন-ভূটান তিন দেশের সংযোগস্থল ডোকলামে ভারত ও চিনের সেনার মধ্যে টানা 73 দিন ধরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ৷ সেই সময় জাপানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন কেনজি হিরামাটসু ৷ তিনিও একই রকমভাবে ভারতের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছিলেন ৷ সে কথাই কেসভন মনে করিয়ে দিয়েছেন ৷ কেসভন বলেন, ‘‘এটা আমাদের সম্পর্কের স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া ৷ আমরাও পূর্ব চিন সাগরে জাপানের সঙ্গে যা হচ্ছে তার প্রতি সমবেদনাশীল ৷’’
2014 সালে যখন প্রধানমন্ত্রী পূর্ব এশিয়ার এই দেশ সফরে গেছিলেন, তখন ভারত ও জাপানের মধ্যে সম্পর্ক ‘স্পেশাল স্ট্রাটেজিস্ট অ্যান্ড গ্লোবাল পার্টনারশিপ’-এ উন্নীত হয়েছিল ৷ কেসভন জানিয়েছেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছাড়াও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্থিতাবস্থা এবং নিরাপত্তা বজায় রাখা নিয়ে নয়াদিল্লি ও টোকিও সমানভাবে চিন্তিত ৷ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল জাপানের পূর্ব উপকূল থেকে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ৷ কেসভন বলেন, ‘‘আমরা (ভারত ও জাপান) এই অঞ্চলে আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার ডাক দিয়েছি এবং কোনও দেশই আঞ্চলিক বিবাদ জোর করে সমাধান করতে পারবে না ৷ আমরা সহমতের ভিত্তিতে আলোচনায় বিশ্বাসী ৷ আমরা সমুদ্র পথে যাতায়াতের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ৷’’
এর সঙ্গে তিনি উদাহরণ হিসেবে যোগ করেছেন দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে চিনের যুদ্ধংদেহী মনোভাবকে ৷ দক্ষিণ চিন সাগরে স্পার্টলি ও পার্সেল দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে চিন ওই অঞ্চলের অন্য দেশগুলির সঙ্গে লড়াইয়ে লেগেই আছে ৷ মালেশিয়া, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান ও ভিয়েতনাম স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জের দাবিদার ৷ আর ভিয়েতনাম ও তাইওয়ান পার্সেল দ্বীপপুঞ্জের দাবি করে আসছে ৷ দক্ষিণ চিন সাগর বিশ্বের ব্যস্ততম বাণিজ্যিক জলপথ ৷ সেখানে চিন ফিলিপিন্সের অধিকার খর্ব করেছে বলে 2016 সালে রায় দিয়েছিল দ্য হেগ-এ অবস্থিত পার্মানেন্ট কোর্ট অফ আরবিট্রেশন ৷ িচিনকে অভিযুক্ত করে ওই আদালত জানিয়েছিল যে ফিলিপিন্সের মাছ ধরা এবং পেট্রোলিয়াম সংক্রান্ত কাজে চিন নাক গলাচ্ছে ৷ ওই অঞ্চলে কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ বানিয়ে অন্যদের মাছ ধরতে বাধা দিচ্ছে ৷ যাতে চিনের মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে পারেন ৷
দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের তরফে বারবার সমুদ্র সংক্রান্ত আইন ভাঙার অভিযোগে গত মাসেই ফিলিপিন্স ও ভিয়েতনাম সরব হয়েছিল ৷ অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস (ASEAN)-এর নেতাদের নিয়ে একটি ভার্চুয়াল বৈঠক হয় ৷ সেখানে ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী এনগুয়ান ফুয়ান ফুক বলেন, ‘‘যখন সারা বিশ্ব এই প্যানডেমিকের (COVID-19) বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, তখন আন্তর্জাতিক আইন ভাঙার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ এখনও হয়ে যাচ্ছে ৷ আমাদের অঞ্চল-সহ অন্য অঞ্চলের স্থিতাবস্থা ও নিরাপত্তার উপর এর প্রভাব পড়ছে ৷’’
রাষ্ট্রদূত সুজুকির এই মন্তব্য ভারত ও জাপান এবং জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যারা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে চতুর্দেশীয় জোট রয়েছে, তার অংশ হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ ওই অঞ্চলে বেজিংয়ের পদক্ষেপ বৃদ্ধি করার প্রেক্ষিতে এটাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা ৷ সমুদ্র সংক্রান্ত আইন নিয়ে UN-এর কনভেনশনে (UNCLOS) চিন মেনে চলতে বাধ্য এই কথা মনে করিয়ে দিয়ে কেসভন প্রশ্ন তুলেছেন যে পূর্ব চিন সাগরে সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জকে চিন কীভাবে নিজের বলে দাবি করতে পারে ৷ তিনি বলেন, ‘‘চিন সব নিয়মই ভাঙছে ৷ আমরা মনে করি চিনের নিয়ম মেনে চলা উচিত ৷ লাদাখে চিন এটাই (নিয়ম ভাঙছে) করছে এবং এর জন্যই জাপান আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে ৷ এটাই তারা (জাপান) ডোকলামে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সময় করেছিল ৷ এটাই তারা এখন করছে ।