দিল্লি : গত সপ্তাহে চিন সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে 20 জন ভারতীয় জওয়ান শহিদ হন ৷ এরপর চিনা পণ্য বয়কটের দাবি চরমে ওঠে ৷ গত রবিবার চিনের সরকারি মুখপত্রে শান্তির আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি বের হয় ৷ তাতে বলা হয়েছে, ভারতীয়রা চিনা পণ্য ছাড়া থাকতে পারবে না ৷ সঙ্গে নিজেদের সংস্থাগুলিকে এশিয়ার জায়ান্ট সংস্থাগুলির অন্যতমও বলে তারা ৷
বেজিংয়ের দৃষ্টিকোণকে তুলে ধরার জন্য পরিচিত ইংরেজি দৈনিক গ্লোবাল টাইমসে সম্প্রতি একটি খবর প্রকাশিত হয় ৷ যার শিরোনাম ছিল " সীমান্ত সমস্যার ফলে চিনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক খারাপ করা উচিত নয় ভারতের " । ওই প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, "একমাত্র সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতার মাধ্যমেই দুই হেভিওয়েট এশিয়ান দেশ ঘনিষ্ঠতর বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারে ৷ যাতে দুই দেশের মানুষই উপকৃত হবেন । " আরও বলা হয়েছে, " সীমান্ত সাম্প্রতিক ঘটনার জেরে যাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও খারাপ ও গভীরভাবে ব্যাহত না হয়, সেজন্য দুই দেশকেই সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে । "
15-16 জুন রাতে লাদাখের গালওয়ান ভ্যালিতে চিনা সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে ভারতীয় সেনার একজন কর্নেলসহ 20 জন জওয়ান প্রাণ হারান । দিল্লি ও বেজিং সামরিক ও কূটনৈতিক আলোচনার মধ্য দিয়ে উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করলেও ভারতে চিনের বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়ছে ৷ এমনকী এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিনা খাবারও নিষিদ্ধ করার পক্ষে সওয়াল করেছেন । ভারতীয়রা চিনে তৈরি টেলিভিশন সহ নানা জিনিস ভাঙছেন, এমন ভিডিয়ো সোশাল মিডিয়ায় ভাইরালও হয়েছে ।
3488 কিলোমিটার দীর্ঘ ওই ভারত-চিন সীমান্তে গত 45 বছরে প্রথম কোনও প্রাণহানির ঘটনা ঘটল । লাদাখের ঘটনাকে একটা ' দুর্ভাগ্যজনক সংঘর্ষ ' বলে বর্ণনা করে গ্লোবাল টাইমস গত রবিবার একটি প্রতিবেদন বের করে ৷ তাতে বলা হয় , " এই ঘটনাকে ভারত ও ভারতের বাইরের রাজনীতিবিদ ও কূটনৈতিকদের জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তুলতে ও চিনের বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরি করতে ব্যবহার করা উচিত নয় । চিন একটি বিশাল প্রতিবেশী দেশ ৷ ভারত নিজের অর্থনৈতিক সম্বৃদ্ধির জন্য চিনের ওপর নির্ভর করে । " প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, " যদিও বহু ভারতীয় সংবাদ সঞ্চালকদের ও সংবাদপত্রগুলিকে সীমান্তে সংঘাতকে বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে । তাদের দাবি , ভারত চিনকে পাল্টা জবাব দিক । তবে, আমরা আশা করব, ভারতের জনগণ তাদের দেশের মৌলবাদী শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হবে না । ভারতের চিনকে প্রয়োজন, অর্থনৈতিকভাবে ও ভূরাজনৈতিকভাবেও । "
বিদেশমন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, 95.54 বিলিয়ন ডলারের ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মধ্যে, ভারতের রপ্তানি 18.84 বিলিয়ন ডলারের । চিনের কাছে ভারত সপ্তম বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য ৷ চিনে সবথেকে বড় রপ্তানিকারীদের মধ্যে সাতাশতম । 2019 - এর জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল 53.3 বিলিয়ন ডলার । চিনে ভারতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল 10.38 বিলিয়ন ডলার ৷ যা 5.02 % কম ৷ ভারতে চিনের রপ্তানির পরিমাণ ছিল 42.92 বিলিয়ন ডলার যা 2.51 শতাংশ কম । ভারত যে দ্রব্যগুলো প্রধানত চিনে রপ্তানি করে , তার মধ্যে রয়েছে তুলো, তামা ও হিরে বা অন্যান্য রত্ন ৷ আর চিন প্রধানত ভারতে রপ্তানি করে যন্ত্রপাতি, টেলিকম ও বৈদ্যুতিন সামগ্রী, জৈব রাসায়নিক ও সার ।
"চিন ভারতের সামনে বিপুল সুযোগ তৈরি করে " একথা উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, " ভারতের সেরা 30 টি তথাকথিত স্টার্ট-আপ সংস্থার মধ্যে 18 টিতেই চিনের বিনিয়োগ রয়েছে । আর দৈনন্দিন যে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ভারতীয়রা উপভোগ করেন, বাড়ির রঙিন টিভি, মাইক্রোওভেন, এয়ার কন্ডিশনার থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ, সবই চিনে তৈরি হয় । আয়ত্বের মধ্যে দাম ও ভালো মানের জন্য, চিনা সামগ্রীর বিকল্প পাওয়া কঠিন । "
"এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা " তৈরি না করতে ভারতকে আহ্বান জানিয়ে ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, " চিনের সঙ্গে ভালো ও পারস্পরিক আদানপ্রদানমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার 100 - র বেশি কারণ আছে ভারতের সামনে ৷ কারণ কেউই তাদের ভূখণ্ডকে একে অন্যের থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারবে না । " এর আগে 2017 সালে ভারত-চিন-ভুটানের সংযোগস্থলে ডোকলামে দু'পক্ষের সেনা 73 দিন ধরে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল । ঘটনার পর সেই বছরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কাজাখস্তানে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলন চলাকালীন দেখা করেন ৷ সেই সময় দুই নেতাই সম্মত হন , দু-দেশের মতানৈক্যকে বিবাদে পরিণত হতে দেওয়া ঠিক হবে না ৷ যাকে কূটনৈতিকভাবে "আস্তানা ঐক্যমত" বলে বর্ণনা করা হয় ।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও মজবুত করার জন্য, জিনপিং মোদিকে 2018 সালে উহান শহরে একটি সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ৷ বর্তমানে যেখান থেকে কোরোনা ছড়িয়ে পড়ে । প্রধানমন্ত্রীও গতবছর চেন্নাইয়ের কাছে মামাল্লাপুরমে এরকম একটি সম্মেলনে চিনা প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানান । লাদাখের সাম্প্রতিক সংঘাতের পর সমালোচকরা মোদি-জিনপিংয়ের সম্পর্কের রসায়ন নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন । তাঁরা বলছেন, কোথায় হারিয়ে গেল "উহান স্পিরিট" আর ' চেন্নাই কানেক্ট '? কোরোনা সংক্রমণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা ছাড়াও চিন-আমেরিকা বাণিজ্য সংঘাতের মধ্যেই দিল্লির ওয়াশিংটন ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অসন্তুষ্ট চিন । ভারত ও আমেরিকা, তার সঙ্গে জাপান ও অস্ট্রেলিয়া হল সেই চতুর্শক্তির অংশ যা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে চায় । এই অঞ্চল জাপানের পূর্ব উপকূল থেকে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত । এই এলাকায় চিনের তৎপরতাবৃদ্ধি ও দক্ষিণ চিন সাগরে তাদের দাপটের প্রেক্ষিতে যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।