কাশ্মীর, 30 এপ্রিল : গত একদিনে কিংবদন্তি দুই তারকাকে হারালাম আমরা । ঋষি কাপুর ও ইরফান খান । বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের মনে তাঁদের চিহ্ন রেখে গেলেন তাঁরা । একজন বেশ কয়েকটি ব্লকবাস্টার ছবির মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছেন । সত্তরের দশকের ছবিগুলিতে যুবসমাজের কাছে রোম্যান্সের প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি । এই সমস্ত ছবির শুটিং যে সমস্ত জায়গায় হয়েছিল, সেই জায়গাগুলি পর্যটকদের কাছে বিশেষ করে নবদম্পতিদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল ।
কাশ্মীরের তৃণভূমি, নদীগুলি কখনও ঋষি কাপুরকে ভুলবে না । 'হাম তুম এক কমরে মে বন্ধ হো...' এই আইকনিক গানের মাধ্যমে গুলমার্গের জঙ্গলের মধ্যে থাকা 'ববি হাট'-কে জনপ্রিয় করেছিলেন ঋষি কাপুর ও ডিম্পল কাপাড়িয়া ।
কাশ্মীরে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের কাছে এই কুঁড়েঘরের একটি সফর আবশ্যিক ছিল ।
মণি রত্নমের তৈরি 'রোজ়'-র মতো ছবিতে কাশ্মীরের অন্ধকার দিকটি উঠে আসতে থাকে । ফলে, রোম্যান্টিক কাশ্মীর নিয়ে ঋষি কাপুরের স্মৃতি আসতে আসতে ম্লান হতে শুরু করেছিল । এই সময়টা ছিল 1990-র দশক । সেই সময় কাশ্মীরে হিংস্রতা ছড়াতে থাকে এবং চিত্রনাট্যকাররা এই হিংস্রতাকে তাঁদের লেখার মাধ্যমে আরও ভয়াবহ করে তোলে । এর ফলে ঋষি কাপুরের মতো তারকাদের ইমেজ মেকওভারের কোনও সুযোগ ছিল না । বলিউডে যেভাবে কাশ্মীরকে তুলে ধরা হয়েছিল, তার ফলে উচ্চ মহলের পর্যটকদের জন্য কাশ্মীর ঘুরতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । ওই অঞ্চলের মানুষ বিশেষ করে পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল মানুষের জন্য এটি একটি খারাপ পরিণতি ছিল ।
ঋষি কাপুরের ছবিগুলিতে কাশ্মীরকে একটি রোমাঞ্চকর জায়গা হিসেবে দেখানো হয়েছিল । যেখানের বাতাসে শুধু রোম্যান্সই ছিল । দম্পতিরা মনোরম দৃশ্যের মধ্যে ভালোবাসার গান গায়ত । তবে, সেই রোম্যান্সের সংজ্ঞা পালটে যায় 90-র দশকের ছবিগুলির শুটিংয়ের পর । ছবিগুলিতে রোম্যান্স বলতে শুধুই ছিল ভয় আর হতাশা । এর মানে ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতাও ছিল । কাশ্মীর প্রসঙ্গে প্রেম শুধু সন্দেহকেই প্রতিফলিত করবে । কাপুরের ছবিগুলির গান শান্তি দিলেও পরবর্তী ছবিগুলির গান মনের মধ্যে ভয় ও বিশ্বাসঘাতকতাকে তুলে ধরে ।
1990-র পরের বলিউড ছবিগুলিতে কাশ্মীরের অঞ্চল ও সেখানকার বাসিন্দাদের বিকৃত রূপ তুলে ধরেছিল । শহরে বসে সাউন্ড ডিজ়াইনাররা কাশ্মীরের প্রাকৃতিক দৃশ্যকে বিপর্যয় ও ধ্বংসের জায়গাগুলির মতো করে দেখাতেন । ছবিতে দেখানো ঘটনাগুলি লক্ষ্যহীন হিংসা প্রদর্শন করে । দেখে মনে হবে, এই উপত্যকা জুড়ে একটি বিকৃত রাজনৈতিক গেমের পরিকল্পনা ঘটে চলেছে ।
তবে, 'হায়দার' ছবিতে ইরফান খানের চরিত্র 'রুদার' ছবি নির্মাতাদের গবেষণার উপর ভিত্তি করে এমন ছবি তৈরিতে উৎসাহিত করছিল, যা কমবেশি ওই জায়গার বাস্তব চিত্রকে তুলে ধরে । যদিও 'স্লামডগ মিলিয়নেয়ার' তাঁকে বেশি খ্যাতি দিয়েছিল, তবু, ছবি নির্মাতাদের কাছে কাশ্মীরের সমস্যাটিকে আলাদা লেন্সের মাধ্যমে দেখানোর জন্য 'হায়দার' ছবিটি একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল । সেই কারণেই 'শিকারা'-র মতো ছবি, যা ফের কাশ্মীরের বিকৃতদিকটি তুলে ধরে । যেন এই ছবিতে 'হায়দার'-এ ইরফানের অসাধারণ অভিনয়ের ছোঁয়া লেগেছে ।
ঋষি কাপুর ও ইরফান খান দু'টি ভিন্ন যুগে কাশ্মীরের সঙ্গে যুক্ত ছিল । একটি তুলনামূলকভাবে শান্ত কাশ্মীর এবং অন্যটিতে কাশ্মীর মৃত্যুর সমার্থক ছিল । তাঁদের ছবিগুলি কাশ্মীরের প্রকৃত উপস্থাপনা না হলেও তাঁরা কল্পিত কাশ্মীরের একটি অংশ ছিলেন । ববি অনেক মানুষকে পর্যটনের মাধ্যমে উপার্জন করতে সাহায্য করেছিলেন । তবে, 'হায়দার' ছবিতে ইরফানের চরিত্রটি অন্ততপক্ষে বাঁধা ছকের থেকে আলাদা ছিল ।
কাশ্মীরের দু'টি ভিন্ন যুগের জন্য ঋষি কাপুর ও ইরফান খান উভয়কেই স্মরণ করা হবে । একটির সঙ্গে বর্তমান প্রজন্ম সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পারে । অন্যটি তাঁরা জীবদ্দশায় কখনও না কখনও খুঁজে পাবে বলেই আশা করা যায় । উভয় তারকাই চরিত্রগুলি বাইরের লোকের দৃষ্টিকোণ থেকে অভিনয় করেছেন । কারণ, চিত্রনাট্যকার তাঁদের জন্য এমনই চরিত্র বেছে রেখেছিলেন । যার ফলে উভয়ের অভিনয়েই একটা আকর্ষণ রয়েছে । উভয়ক্ষেত্রেই দুর্দশা নেই । আমরা এটিকে বলিউডের অন্য কারও জন্য রেখে যাচ্ছি । যিনি প্রকৃত কাশ্মীরের চিত্রটি তুলে ধরবেন । কাশ্মীরের শান্ত ও পরবর্তী হিংস্রতার জন্য দুর্দশা, যুক্তি ও ক্রোধকে প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে প্রতিফলিত করবেন ।
বিলাল ভাট