দিল্লি, 18 নভেম্বর : জলের অপর নাম জীবন । জল ছাড়া প্রাণের বেঁচে থাকা সম্ভব নয় । মানুষ কিছু দিন না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে । কিন্তু জল ছাড়া তার পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব । তাই সরকার ও নাগরিকদের কর্তব্য জলাশয়গুলিকে সংরক্ষণ করা, জলের অপচয় বন্ধ করা এবং জলের নতুন উৎস তৈরি করা । তেলুগু রাজ্যগুলিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় । কৃষ্ণা ও গোদাবরী নদীর উজানে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় ভাটির দিকে নদীর দুই কূল প্রায় প্রতিবছর প্লাবিত হয় । এই জল অবশ্যই সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা উচিত । কিন্তু এটা খুবই হতাশাজনক যে, সেই জল সংরক্ষণের জন্য কোনও উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত নেওয়া হয়নি ।
1960 সাল থেকে বিশ্বজুড়ে জলের ব্যবহার অনেকটাই বেড়েছে । তার ফলে জলের উৎসগুলি ক্রমশ শুকিয়ে আসছে । বিশ্বের সেই 17টি দেশ যেখানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশের বসবাস সেখানে জল সংকট ভয়াবহ আকার নিতে চলেছে । সেই দেশগুলিতে কৃষিকাজ, শিল্প ও শহরাঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য মোট প্রাপ্য জলের 80 শতাংশ খরচ হয় । অন্যদিকে বিশ্বের সেই 44টি দেশ যেখানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের বসবাস সেখানে মোট প্রাপ্য জলের 40 শতাংশ খরচ হয় । ফলে সেই দেশগুলিও জল সংকটের মুখে পড়তে চলেছে । এছাড়া জলের প্রয়োজন ও সরবরাহের মধ্যে যথেষ্ট ফারাক থাকায় বিভিন্ন দেশে খরাপ্রবণ এলাকার পরিমাণ বাড়ছে । আর তার প্রভাব পড়ছে কৃষি, বাণিজ্য, জীবিকা, খাদ্য নিরাপত্তা সহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উপর । জনসংখ্যা বৃ্দ্ধি, শহরের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং শিল্পের প্রসারের ফলে দেশে জল খরচের পরিমাণ অতীতের তুলনায় এখন অনেকটাই বেড়েছে ।
ভারতের 90 শতাংশ শহরে পাম্পের সাহায্যে জল সরবরাহ করা হয় । দেশের 80 শতাংশের বেশি গ্রামে এখনও পর্যন্ত জল সরবরাহের কোনও ব্যবস্থা নেই । তাই সেখানে মহিলা ও শিশুদের বাড়ি থেকে কয়েক কিমি দূরে গিয়ে জল নিয়ে আসতে হয় । স্বাধীনতার পর সরকার মূলত গ্রামগুলিতে সেচের মাধ্যমে কৃষিকাজের জন্য জল সরবরাহের পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল । সেজন্য একাধিক জলাধার নির্মাণ করেছিল । কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় পানীয় জল সরবরাহের বিষয়টিতে সেভাবে গুরুত্বই দেওয়া হয়নি । পরবর্তীতে স্বাধীনতার প্রায় 40 বছর পর সরকার বুঝতে পারল দেশে জলের উৎসগুলির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমজনতার পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন । তারপর 1987 সালে তৈরি হল জাতীয় জল নীতি (ন্যাশনাল ওয়াটার পলিসি) ।
খরা কবলিত এলাকায় জলের প্রধান উৎস হল বর্ষা । উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে ভূগর্ভস্থ জলস্তর অনেকটাই উপরে । কিন্তু দক্ষিণের রাজ্যগুলির পরিস্থিতি এর ঠিক উলটো । সেখানে জমি পাথুরে । তাই ওই রাজ্যগুলিতে বৃষ্টির জল সঞ্চয় করতে বিশেষ সমস্যা রয়েছে । ভারতের অনেক অঞ্চলে বর্ষার মরশুমে গড়ে 500 মিমি বৃষ্টিপাত হয় । এই বিষয়টি মাথায় রাখলে 10-12 বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বৃষ্টির জল বা ভূগর্ভস্থ জল সংরক্ষণ করা সম্ভব ।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজস্থান ও তামিলনাড়ুর বাসিন্দারা তীব্র জল সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলেন । সেই সংকট তামিলনাড়ুতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণে ব্যর্থতার বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে । শিল্পের বর্জ্য, রাসায়নিক সার ও অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের জন্য ভূগর্ভস্থ জল দূষিত হয়েছে । এছাড়া অনুন্নত মানের পাম্প ও পাইপে লাইনে ফুটো থাকার ফলে নর্দমার জল অনেক ক্ষেত্রে পানীয় জলের সঙ্গে মিশে যায় । এর ফলে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে । রাজস্থান দেশের অন্যতম রাজ্য যেখানে জল সংকট তীব্র হচ্ছে । এই এলাকায় খালের মাধ্যমে পানীয় জল সরবরাহ করার পরিমাণ খুবই কম ।
নীতি আয়োগের 2018 সালের রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বের যে দেশগুলি জল সংকটে ভুগছে তাদের মধ্যে ভারতের অবস্থান ত্রয়োদশ । 17টি দেশের মোট জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ । সেই জনসংখ্যার তিনগুণ হল ভারতের জনসংখ্যা । কেন্দ্রীয় ভূগর্ভস্থ জল পর্ষদের 2018 সালের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি বছর ভারতে ভূগর্ভস্থ জল ভাণ্ডারের উচ্চতা 8 সেমি করে কমছে । এর প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে । যদি এই সমস্যা মেটাতে বিশেষ উদ্যোগ না নেওয়া হয় তবে আগামী কয়েক দশকে সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করবে । ইন্টারন্যাশনাল রিসোর্স প্যানেলের 2019 সালের রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বে জল সংকটের ক্রমতালিকায় অষ্টম স্থানে থাকা সৌদি আরব জল সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে । আগামী এক দশকের মধ্যে জল খরচের পরিমাণ 43 শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে তারা । নামিবিয়া জল সংকটের ক্রমতালিকায় 37 নম্বরে রয়েছে । গত 50 বছর ধরে দেশটি ব্যবহৃত জল শোধন করে তা ফের পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করছে । অস্ট্রেলিয়া এই ক্রমতালিকায় 50 নম্বরে রয়েছে । খরার সময় দেশটি জল ব্যবহারের পরিমাণ 50 শতাংশ কমিয়েছে । চিন ক্রমতালিকায় 56 নম্বরে রয়েছে । তারা নতুন নির্মিত ভবনগুলিতে জল চাষের (ভূস্তরীয় জল সংরক্ষণ) পরিকাঠামো রাখা বাধ্যতামূলক করেছে ।
ব্যয়বহুল পাতন বা বাষ্পায়ন পদ্ধতি ছাড়া কৃত্রিম উপায়ে পানীয় জল পাওয়া সম্ভব নয় । তাই জল সংকট এড়াতে কার্যকরী উপায় হল জলের প্রাকৃতিক উৎসগুলির সঠিক ও পরিমিত ব্যবহার এবং সংরক্ষণ । তাই বৃষ্টির জল সংরক্ষণের পাশাপাশি ব্যবহৃত জল পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার উপর বিশেষ জোর দেওয়া উচিত । সাধারণ নাগরিকদেরও এই বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া উচিত । তাহলে এই সংকট এড়ানো সম্ভব ।