ETV Bharat / bharat

বসুন্ধরা দিবসের শপথ – পুনরুৎপাদন, স্থিতিশীলতা এবং স্বদেশী

কীভাবে তা সম্ভব লিখছেন ইন্দ্রশেখর সিংহ (অধিকর্তা – পলিসি অ্যান্ড আউটরিচ, ন্যাশনাল সিড অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া)

author img

By

Published : Apr 22, 2020, 12:12 PM IST

ছবি
ছবি

লকডাউনের মধ্যে, 22 এপ্রিল দিল্লির কাছে বা বিশ্বজুড়ে একটা ঐতিহাসিক দিন ৷ কারণ 1970 সালের পর থেকে এটাই হবে পরিচ্ছন্নতম বসুন্ধরা দিবস । এই বিশেষ দিনটির স্রষ্টা জন ম্যাককনেল হয়ত স্বর্গ থেকে হাসছেন ৷ কারণ অবশেষে বিষাক্ত মেঘও নেই, নেই বিমান থেকে বেরিয়ে আসা সাদা ধোঁয়ার রেখাও। বেড়ে যাওয়া অক্সিজেনের মাত্রা হয়ত দেবদূতদেরও কিছুটা উচ্ছ্বসিত করেছে।

কিন্তু মহাজাগতিক ঘটনা দূরে থাক, আমরা আমাদের গ্রহকে রক্ষা করতে পারব তো? শপথ নিতে পারব, যে অর্থনীতির বৃদ্ধির সঙ্গে বাতাস ও জল নির্মল থাকবে ? যখন আমরা আত্মসমীক্ষা করি, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়, যে প্রকৃতিকে জয় করার এই অভিযান আসলে গ্রহটিকেই বিপর্যয়ের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।

পরিবেশের অবক্ষয় পরমাণু যুদ্ধের পরেই মানবজীবনের সামনে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিপদ, যার গুরুতর ভূ-রাজনৈতিক পরিণতিও রয়েছে । ‘গণতন্ত্র এখন’ অনুষ্ঠানে নোয়াম চমস্কি সম্প্রতি বলেছেন, কমতে থাকা জলের উৎস নিয়ে পরমাণু যুদ্ধ বাঁধতে পারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে । সব মিলিয়ে, যা হওয়ার হয়েছে, এবং এই পৃথিবী আর হিংসার ভার নিতে পারবে না । রোগ ও মহামারীর মাধ্যমে প্রকৃতি মনে করাচ্ছে, যে এটা বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংসের পথ থেকে সরে নতুন পৃথিবীর নতুন অর্থনীতি পুনর্নির্মাণের সময়।

কী করে আমরা একটা নতুন পৃথিবী তৈরি করতে পারি ? আমরা কী বস্তুজগৎ ছেড়ে, আমাদের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে, প্রযুক্তিবিহীন জীবন বেছে নিয়ে জঙ্গলে সন্ন্যাসী হয়ে যাবো ?

না! কোরোনা ভাইরাস একটা মারাত্মক বিপর্যয় হলেও, এটা আমাদের সামনে যথেচ্ছ ভোগের পথ ছেড়ে একটা নতুন দৃশ্যপট ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে ৷ যেখানে বাতাস নির্মল, জল পরিচ্ছন্ন এবং শহরে ফের ডাকছে পাখিরা । জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিলুপ্তি থেকে বাঁচতে গেলে, আমাদের জীবন ও অর্থনীতিতে পাঁচটি নীতি নিয়ে চলতে হবে – কমানো, পুনর্ব্যবহার, পুনর্নির্মাণ, স্বদেশী এবং কৃষি-বাস্তুতন্ত্র । ভারত তথা বিশ্বকে গড়ে তুলতে আমাদের এতটা শক্তিশালী সবুজ অর্থনীতির (দূষণহীন, বৃত্তাকার, পুনর্নবীকরণভিত্তিক) প্রয়োজন । গত শতাব্দির বেশিরভাগটা জুড়ে প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হয়েছে পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য, এবার আমাদের দু'টিকে জুড়তে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে গড়ে উঠতে হবে একটা দূষণহীন, বৃত্তাকার এবং পুনর্নবীকরণ ভিত্তিক প্রযুক্তির উপর । কিন্তু এই পথ কোথা থেকে শুরু হয় ? শুরুটা করা যাক, আমাদের জীবনে পৃথিবী সম্পর্কে সচেতনতা এনে । পৃথিবী জীবন্ত, সে শুধু ধূলো, জল অথবা পাহাড় নয় যাকে খনন করে ফেলা যাবে । এই জীবন্ত গ্রহে সে আমাদের মধ্যেই দিয়েই বেঁচে থাকে । আমাদের ফের যোগাযোগ করতে হবে পাহাড় আর মাটির সঙ্গে অনুভব করতে হবে বসুন্ধরার হৃদস্পন্দন । পৃথিবী জীবন্ত, তার দেওয়া উপহারগুলোও জীবন্ত, আর আমাদের উচিত তার সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করা। যখনই এই চেতনায় আমরা পরিপূর্ণ হব, তার পরের ধাপ হবে, এই বিশ্বের বুকে আমাদের ছাপ কমানো। প্রতিটা পদক্ষেপ, বা কোনও পণ্য কেনা বা ব্যবহারে এই পৃথিবীর উপর প্রভাব পড়ে । তবুও আমাদের সাফল্যের মাপকাঠিগুলো, যেমন বড় বাড়ি, অনেক গাড়ি ইত্যাদি বাস্তুতন্ত্রের কাছে ভারসাম্যহীন। জল, জ্বালানি অথবা বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো যে শুধু বুদ্ধিমানের কাজ তাই নয়, এতে খরচও বাঁচে। আমাদের এই ভোগের পথ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থনীতি থেকে সরে বিকল্প খুঁজতে হবে। পৃথিবীর রসদ সীমিত, আর প্রতিটা অতিরিক্ত ব্যয়ের মধ্যে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাঁদের ভাগ থেকে বঞ্চিত করছি । আমাদের এমন পণ্য কেনা বন্ধ করতে হবে বা কমাতে হবে, যার মাধ্যমে কোনও মানুষ বা পৃথিবীকে শোষণ করা হয় । কোনওকিছু কেনার আগে ভালো করে ভাবুন, সত্যিই কি আমার এটা প্রয়োজন ? এতে কি আমার এবং পৃথিবীর ক্ষতি হবে?

সম্পদের খরচ কমানোর একটা খুব সহজ উপায় হল, জিনিসপত্রের পুনর্ব্যবহার করা । RO আউটলেটের কয়েক গ্যালন জল গাছের জন্য বা বাসন ধোয়ার জন্য ব্যবহার করে, পুরোনো পোশাককে কম্বলে পরিণত করে এই ভাবনার সূত্রপাত করা যেতে পারে। ভারতে জিনিসপত্র পুনর্ব্যবহারের অনেক সৃষ্টিশীল আইডিয়া আছে। ব্যক্তিগতভাবে, আমরা আবর্জনা আলাদা করে রাখি, এবং রান্নাঘরের বর্জ্য কয়েক মাস ধরে ফেলে দেওয়া হয়নি । তার বদলে আমরা সেগুলো দিয়ে মাটিতে সার দিই বা রাস্তার গোরুদের খাওয়াই। প্রস্রাবকেও সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে এতে শহরের বাগানগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় ইউরিয়া ও ফসফেট রয়েছে। যত কম পারেন নষ্ট করুন, কারণ একটা জিনিসের অনেক রকমের পুনর্ব্যবহার থাকতে পারে। তাই কোনওকিছু ফেলে দেওয়ার আগে একটু দাঁড়ান, আর ভাবুন, কীভাবে সেটাকে অন্যভাবে ব্যবহার করা যায় । দুটো নঞর্থক ব্যবহার কমার অর্থ, পরিবেশের একটা বড় উপকার । মানুষ পৃথিবীর প্রভু নয়, বরং বিখ্যাত মার্কিন পরিবেশবিদ অল্ডো লিওপোল্ডের ভাষায়, ‘ভূমির সেবক’ মাত্র। এই জমি ও পৃথিবী আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পেয়েছি, শুধুমাত্র আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আমাদের উদ্দেশ্য বাড়িতে এয়ার পিউরিফায়ারের আরামে থেকে বাতাস, জল মাটিকে লুট করা নয় । এবং কার্বন ফুটপ্রিন্ট দেখে শুধুমাত্র কার্বন কমানোর ব্যবস্থা করাটাই একমাত্র সমাধান নয় । কার্বন কমানোর বিচ্ছিন্ন নঞর্থক দৃষ্টিভঙ্গির বদলে আমাদের পুনর্নির্মাণের সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোতে হবে। আমাদের লক্ষ্য শুধুই জীবাশ্ম জ্বালানি-অর্থনীতির জায়গায় জৈব জ্বালানি বা লো-কার্বন প্রযুক্তি চালু করা নয়, বরং পুনর্নির্মাণভিত্তিক নীতির মাধ্যমে আমাদের জীবন ও অর্থনীতিকে পুনরাবিস্কার করা । আমাদের অর্থনীতি ও সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিকে বায়োমিমিক্রি, বায়ো-ফিলিক ডিজাইন, এবং বাস্তুতান্ত্রিক ও বৃত্তাকার অর্থনীতির দিকে চালিত করতে হবে ।

একজন ব্যক্তি হিসেবে আপনার পদক্ষেপকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার বদলে সামগ্রীক হিসেবে দেখুন, যা সমগ্র পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করছে । এমন ভাবে কাজ করুন যাতে এই বিশ্বে যোগদান থাকে, এবং সম্মান জানানো হয়। 100 বছরেরও বেশি আগে মহাত্মা গান্ধি আমাদের জন্য সমাধানের রূপরেখা চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি একে বলতেন স্বদেশি অর্থনীতি। এটা এমন একটা ব্যবস্থা যা দাঁড়িয়ে রয়েছে আত্মনির্ভরতা, মর্যাদা ও স্থানীয় সহযোগিতার উপর, এবং এতে পরিবেশের ওপর ন্যূনতম কুপ্রভাব অথবা সদর্থক প্রভাব পড়ে । তিনি কল্পনা করেছিলেন, এবং প্রতিটা গ্রামকে কীভাবে এতটাই স্বনির্ভর করা যায়, যাতে তারা ‘প্রয়োজনকে গোটা পৃথিবীর থেকেও নিজেদের রক্ষা করতে পারে’, তা নিয়ে লিখেছিলেন। এই অর্থনীতি হচ্ছে উৎপাদনের একটি বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা যা উদ্বৃত্ত ভাগ করে নেয়, এবং অন্যদের থেকে সেটাই নেয়, যেটা তারা উৎপাদন করতে পারে না । এটাই সময় যখন আমরা ভারতে ইকোলজিক্যাল প্রযুক্তির সহায়তার স্বদেশির দ্বিতীয় সংস্করণকে গ্রহণ করি। এটা কোনও নেতিবাচক প্রক্রিয়া নয়, যেখানে বয়কট করা বা ঘৃণা করা রয়েছে, বরং এটা আত্মনির্ভরতা বাড়ানোর একটা ইতিবাচক প্রয়াস। একটা পরিবার বা দেশ হিসেবে আমাদের সমস্ত কিছু নিজেদেরই উৎপাদন করার ওপর জোর দিতে হবে। ওষুধ হোক বা খাবার, সব যেন আমাদের কাছাকাছিই তৈরি হয়। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে। আমাদের যত বেশি সম্ভব স্থানীয় এবং টেকসই পণ্য ব্যবহার করতে হবে। স্বদেশি ও স্থিতিশীলতায় বিনিয়োগ করতে হবে। কোনও কিছু কেনার আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আপনি তার বদলে একইরকম ভালো কোনও স্থানীয় পণ্য কিনতে পারেন কি না।

এবার, শপথের চূড়ান্ত স্তম্ভ – কৃষি বাস্তুতন্ত্র । পশুপালন এবং পোলট্রি সহ শিল্পভিত্তিক খাদ্যব্যবস্থা শুধু মানুষের স্বাস্থ্যকেই ধ্বংস করেনি, পাশাপাশি পৃথিবীকে ক্যান্সারে আক্রান্ত করেছে । কৃষক আত্মহত্যা, ক্যান্সার, ছোট কৃষকদের কাজ বন্ধ হওয়া, গ্রামীণ সমাজে অপরাধের এই বিশ্বজোড়া ছবিটা আসলে একটা রোগগ্রস্ত উৎপাদন ব্যবস্থারই উপসর্গ। আমাদের নদীগুলোকে দূষিত করেছে সার ও কীটনাশক, আর গ্রাহকদের পরিবারগুলোকে একগুচ্ছ অসুখের মুখে পড়তে হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, যৌন অক্ষমতা থেকে ক্যান্সার । কিন্তু সারের ভর্তুকিতে ভারতীয় করদাতাদের টাকার একটা বিরাট অংশ খরচ হয় ।

কিন্তু কৃষি-বাস্তুতন্ত্র কী প্রাসঙ্গিক ? CIMMOIT-র প্রধান গবেষক M L জাট একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে সেটাই প্রমাণ করেছেন । কৃষি-বাস্তুতন্ত্র শুধু স্বাস্থ্যকর খাবারই জোগায় না, পাশাপাশি এই অভ্যাস আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা থেকে রাসায়নিক এবং জীবাশ্ম জ্বালানির প্রভাবও কমায় । জল পরিশোধন করে, কার্বন কমিয়ে, নাইট্রোজেন চক্র স্বাভাবিক এবং সুস্বাদু খাবার উৎপাদন করে তা বাস্তুতন্ত্রের উপকার করে ।

তাহলে আমরা কোথা থেকে শুরু করব ?

আপনার ঘর থেকেই শুরু করুন, সবজি বাগান করুন অথবা টবে ধনেপাতার মতো গাছ বসান । তবে মনে রাখবেন রাসায়নিক ব্যবহার করবেন না। চেষ্টা করুন এমন কিছু উৎপাদন করতে, যেটা আপনি খান। যদি না পারেন, তবে এমন কৃষকের কাছে যান, যিনি কৃষি-বাস্তুতন্ত্র মেনে আপনার জন্য খাদ্য উৎপাদন করবেন। আমরা যাঁরা শহরে থাকি, তাঁদের নগর উদ্যানের জন্য সওয়াল করা উচিত, যেখানে আমরা একসঙ্গে আমাদের খাবার উৎপাদন করতে পারব, এবং আমাদের সন্তানদের দেখাতে পারবো যে খাবার গাছ থেকে আসে, ফ্রিজ থেকে নয় । এই সমস্ত নীতির প্রয়োগের পরিণতি হল, একটা সবুজ অর্থনীতির ভিত্তিস্থাপন, যা নির্ভর করবেন পুনরুৎপাদন, অর্থনৈতিক স্ব-শক্তিকরণের উপর । যখন পৃথিবীর অর্থনৈতিক অন্ধকারে নিমজ্জিত,তখন ভাঙাচোরা অর্থনীতি ও শিল্পব্যবস্থার ছাই থেকে ভারতকে বেরিয়ে আসতে হবে একটা নতুন দৃষ্টান্তকে আপন করে নিতে – সবুজ অর্থনীতি। মহাত্মা গাঁধী যেভাবে দেখেছিলেন, স্বদেশী অর্থনীতি আমাদের মধ্যে বইছে। এই বসুন্ধরা দিবসে আমাদের শপথ নিতে হবে বসুধৈব কুটুম্বকম পরিবারের জন্য, এবং বিজ্ঞান, সহনশীলতা এবং পৃথিবীর পথে যাত্রা শুরু করতে হবে।

লকডাউনের মধ্যে, 22 এপ্রিল দিল্লির কাছে বা বিশ্বজুড়ে একটা ঐতিহাসিক দিন ৷ কারণ 1970 সালের পর থেকে এটাই হবে পরিচ্ছন্নতম বসুন্ধরা দিবস । এই বিশেষ দিনটির স্রষ্টা জন ম্যাককনেল হয়ত স্বর্গ থেকে হাসছেন ৷ কারণ অবশেষে বিষাক্ত মেঘও নেই, নেই বিমান থেকে বেরিয়ে আসা সাদা ধোঁয়ার রেখাও। বেড়ে যাওয়া অক্সিজেনের মাত্রা হয়ত দেবদূতদেরও কিছুটা উচ্ছ্বসিত করেছে।

কিন্তু মহাজাগতিক ঘটনা দূরে থাক, আমরা আমাদের গ্রহকে রক্ষা করতে পারব তো? শপথ নিতে পারব, যে অর্থনীতির বৃদ্ধির সঙ্গে বাতাস ও জল নির্মল থাকবে ? যখন আমরা আত্মসমীক্ষা করি, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়, যে প্রকৃতিকে জয় করার এই অভিযান আসলে গ্রহটিকেই বিপর্যয়ের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।

পরিবেশের অবক্ষয় পরমাণু যুদ্ধের পরেই মানবজীবনের সামনে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিপদ, যার গুরুতর ভূ-রাজনৈতিক পরিণতিও রয়েছে । ‘গণতন্ত্র এখন’ অনুষ্ঠানে নোয়াম চমস্কি সম্প্রতি বলেছেন, কমতে থাকা জলের উৎস নিয়ে পরমাণু যুদ্ধ বাঁধতে পারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে । সব মিলিয়ে, যা হওয়ার হয়েছে, এবং এই পৃথিবী আর হিংসার ভার নিতে পারবে না । রোগ ও মহামারীর মাধ্যমে প্রকৃতি মনে করাচ্ছে, যে এটা বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংসের পথ থেকে সরে নতুন পৃথিবীর নতুন অর্থনীতি পুনর্নির্মাণের সময়।

কী করে আমরা একটা নতুন পৃথিবী তৈরি করতে পারি ? আমরা কী বস্তুজগৎ ছেড়ে, আমাদের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে, প্রযুক্তিবিহীন জীবন বেছে নিয়ে জঙ্গলে সন্ন্যাসী হয়ে যাবো ?

না! কোরোনা ভাইরাস একটা মারাত্মক বিপর্যয় হলেও, এটা আমাদের সামনে যথেচ্ছ ভোগের পথ ছেড়ে একটা নতুন দৃশ্যপট ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে ৷ যেখানে বাতাস নির্মল, জল পরিচ্ছন্ন এবং শহরে ফের ডাকছে পাখিরা । জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিলুপ্তি থেকে বাঁচতে গেলে, আমাদের জীবন ও অর্থনীতিতে পাঁচটি নীতি নিয়ে চলতে হবে – কমানো, পুনর্ব্যবহার, পুনর্নির্মাণ, স্বদেশী এবং কৃষি-বাস্তুতন্ত্র । ভারত তথা বিশ্বকে গড়ে তুলতে আমাদের এতটা শক্তিশালী সবুজ অর্থনীতির (দূষণহীন, বৃত্তাকার, পুনর্নবীকরণভিত্তিক) প্রয়োজন । গত শতাব্দির বেশিরভাগটা জুড়ে প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হয়েছে পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য, এবার আমাদের দু'টিকে জুড়তে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে গড়ে উঠতে হবে একটা দূষণহীন, বৃত্তাকার এবং পুনর্নবীকরণ ভিত্তিক প্রযুক্তির উপর । কিন্তু এই পথ কোথা থেকে শুরু হয় ? শুরুটা করা যাক, আমাদের জীবনে পৃথিবী সম্পর্কে সচেতনতা এনে । পৃথিবী জীবন্ত, সে শুধু ধূলো, জল অথবা পাহাড় নয় যাকে খনন করে ফেলা যাবে । এই জীবন্ত গ্রহে সে আমাদের মধ্যেই দিয়েই বেঁচে থাকে । আমাদের ফের যোগাযোগ করতে হবে পাহাড় আর মাটির সঙ্গে অনুভব করতে হবে বসুন্ধরার হৃদস্পন্দন । পৃথিবী জীবন্ত, তার দেওয়া উপহারগুলোও জীবন্ত, আর আমাদের উচিত তার সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করা। যখনই এই চেতনায় আমরা পরিপূর্ণ হব, তার পরের ধাপ হবে, এই বিশ্বের বুকে আমাদের ছাপ কমানো। প্রতিটা পদক্ষেপ, বা কোনও পণ্য কেনা বা ব্যবহারে এই পৃথিবীর উপর প্রভাব পড়ে । তবুও আমাদের সাফল্যের মাপকাঠিগুলো, যেমন বড় বাড়ি, অনেক গাড়ি ইত্যাদি বাস্তুতন্ত্রের কাছে ভারসাম্যহীন। জল, জ্বালানি অথবা বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো যে শুধু বুদ্ধিমানের কাজ তাই নয়, এতে খরচও বাঁচে। আমাদের এই ভোগের পথ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থনীতি থেকে সরে বিকল্প খুঁজতে হবে। পৃথিবীর রসদ সীমিত, আর প্রতিটা অতিরিক্ত ব্যয়ের মধ্যে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাঁদের ভাগ থেকে বঞ্চিত করছি । আমাদের এমন পণ্য কেনা বন্ধ করতে হবে বা কমাতে হবে, যার মাধ্যমে কোনও মানুষ বা পৃথিবীকে শোষণ করা হয় । কোনওকিছু কেনার আগে ভালো করে ভাবুন, সত্যিই কি আমার এটা প্রয়োজন ? এতে কি আমার এবং পৃথিবীর ক্ষতি হবে?

সম্পদের খরচ কমানোর একটা খুব সহজ উপায় হল, জিনিসপত্রের পুনর্ব্যবহার করা । RO আউটলেটের কয়েক গ্যালন জল গাছের জন্য বা বাসন ধোয়ার জন্য ব্যবহার করে, পুরোনো পোশাককে কম্বলে পরিণত করে এই ভাবনার সূত্রপাত করা যেতে পারে। ভারতে জিনিসপত্র পুনর্ব্যবহারের অনেক সৃষ্টিশীল আইডিয়া আছে। ব্যক্তিগতভাবে, আমরা আবর্জনা আলাদা করে রাখি, এবং রান্নাঘরের বর্জ্য কয়েক মাস ধরে ফেলে দেওয়া হয়নি । তার বদলে আমরা সেগুলো দিয়ে মাটিতে সার দিই বা রাস্তার গোরুদের খাওয়াই। প্রস্রাবকেও সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে এতে শহরের বাগানগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় ইউরিয়া ও ফসফেট রয়েছে। যত কম পারেন নষ্ট করুন, কারণ একটা জিনিসের অনেক রকমের পুনর্ব্যবহার থাকতে পারে। তাই কোনওকিছু ফেলে দেওয়ার আগে একটু দাঁড়ান, আর ভাবুন, কীভাবে সেটাকে অন্যভাবে ব্যবহার করা যায় । দুটো নঞর্থক ব্যবহার কমার অর্থ, পরিবেশের একটা বড় উপকার । মানুষ পৃথিবীর প্রভু নয়, বরং বিখ্যাত মার্কিন পরিবেশবিদ অল্ডো লিওপোল্ডের ভাষায়, ‘ভূমির সেবক’ মাত্র। এই জমি ও পৃথিবী আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পেয়েছি, শুধুমাত্র আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আমাদের উদ্দেশ্য বাড়িতে এয়ার পিউরিফায়ারের আরামে থেকে বাতাস, জল মাটিকে লুট করা নয় । এবং কার্বন ফুটপ্রিন্ট দেখে শুধুমাত্র কার্বন কমানোর ব্যবস্থা করাটাই একমাত্র সমাধান নয় । কার্বন কমানোর বিচ্ছিন্ন নঞর্থক দৃষ্টিভঙ্গির বদলে আমাদের পুনর্নির্মাণের সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোতে হবে। আমাদের লক্ষ্য শুধুই জীবাশ্ম জ্বালানি-অর্থনীতির জায়গায় জৈব জ্বালানি বা লো-কার্বন প্রযুক্তি চালু করা নয়, বরং পুনর্নির্মাণভিত্তিক নীতির মাধ্যমে আমাদের জীবন ও অর্থনীতিকে পুনরাবিস্কার করা । আমাদের অর্থনীতি ও সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিকে বায়োমিমিক্রি, বায়ো-ফিলিক ডিজাইন, এবং বাস্তুতান্ত্রিক ও বৃত্তাকার অর্থনীতির দিকে চালিত করতে হবে ।

একজন ব্যক্তি হিসেবে আপনার পদক্ষেপকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার বদলে সামগ্রীক হিসেবে দেখুন, যা সমগ্র পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করছে । এমন ভাবে কাজ করুন যাতে এই বিশ্বে যোগদান থাকে, এবং সম্মান জানানো হয়। 100 বছরেরও বেশি আগে মহাত্মা গান্ধি আমাদের জন্য সমাধানের রূপরেখা চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি একে বলতেন স্বদেশি অর্থনীতি। এটা এমন একটা ব্যবস্থা যা দাঁড়িয়ে রয়েছে আত্মনির্ভরতা, মর্যাদা ও স্থানীয় সহযোগিতার উপর, এবং এতে পরিবেশের ওপর ন্যূনতম কুপ্রভাব অথবা সদর্থক প্রভাব পড়ে । তিনি কল্পনা করেছিলেন, এবং প্রতিটা গ্রামকে কীভাবে এতটাই স্বনির্ভর করা যায়, যাতে তারা ‘প্রয়োজনকে গোটা পৃথিবীর থেকেও নিজেদের রক্ষা করতে পারে’, তা নিয়ে লিখেছিলেন। এই অর্থনীতি হচ্ছে উৎপাদনের একটি বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা যা উদ্বৃত্ত ভাগ করে নেয়, এবং অন্যদের থেকে সেটাই নেয়, যেটা তারা উৎপাদন করতে পারে না । এটাই সময় যখন আমরা ভারতে ইকোলজিক্যাল প্রযুক্তির সহায়তার স্বদেশির দ্বিতীয় সংস্করণকে গ্রহণ করি। এটা কোনও নেতিবাচক প্রক্রিয়া নয়, যেখানে বয়কট করা বা ঘৃণা করা রয়েছে, বরং এটা আত্মনির্ভরতা বাড়ানোর একটা ইতিবাচক প্রয়াস। একটা পরিবার বা দেশ হিসেবে আমাদের সমস্ত কিছু নিজেদেরই উৎপাদন করার ওপর জোর দিতে হবে। ওষুধ হোক বা খাবার, সব যেন আমাদের কাছাকাছিই তৈরি হয়। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে। আমাদের যত বেশি সম্ভব স্থানীয় এবং টেকসই পণ্য ব্যবহার করতে হবে। স্বদেশি ও স্থিতিশীলতায় বিনিয়োগ করতে হবে। কোনও কিছু কেনার আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আপনি তার বদলে একইরকম ভালো কোনও স্থানীয় পণ্য কিনতে পারেন কি না।

এবার, শপথের চূড়ান্ত স্তম্ভ – কৃষি বাস্তুতন্ত্র । পশুপালন এবং পোলট্রি সহ শিল্পভিত্তিক খাদ্যব্যবস্থা শুধু মানুষের স্বাস্থ্যকেই ধ্বংস করেনি, পাশাপাশি পৃথিবীকে ক্যান্সারে আক্রান্ত করেছে । কৃষক আত্মহত্যা, ক্যান্সার, ছোট কৃষকদের কাজ বন্ধ হওয়া, গ্রামীণ সমাজে অপরাধের এই বিশ্বজোড়া ছবিটা আসলে একটা রোগগ্রস্ত উৎপাদন ব্যবস্থারই উপসর্গ। আমাদের নদীগুলোকে দূষিত করেছে সার ও কীটনাশক, আর গ্রাহকদের পরিবারগুলোকে একগুচ্ছ অসুখের মুখে পড়তে হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, যৌন অক্ষমতা থেকে ক্যান্সার । কিন্তু সারের ভর্তুকিতে ভারতীয় করদাতাদের টাকার একটা বিরাট অংশ খরচ হয় ।

কিন্তু কৃষি-বাস্তুতন্ত্র কী প্রাসঙ্গিক ? CIMMOIT-র প্রধান গবেষক M L জাট একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে সেটাই প্রমাণ করেছেন । কৃষি-বাস্তুতন্ত্র শুধু স্বাস্থ্যকর খাবারই জোগায় না, পাশাপাশি এই অভ্যাস আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা থেকে রাসায়নিক এবং জীবাশ্ম জ্বালানির প্রভাবও কমায় । জল পরিশোধন করে, কার্বন কমিয়ে, নাইট্রোজেন চক্র স্বাভাবিক এবং সুস্বাদু খাবার উৎপাদন করে তা বাস্তুতন্ত্রের উপকার করে ।

তাহলে আমরা কোথা থেকে শুরু করব ?

আপনার ঘর থেকেই শুরু করুন, সবজি বাগান করুন অথবা টবে ধনেপাতার মতো গাছ বসান । তবে মনে রাখবেন রাসায়নিক ব্যবহার করবেন না। চেষ্টা করুন এমন কিছু উৎপাদন করতে, যেটা আপনি খান। যদি না পারেন, তবে এমন কৃষকের কাছে যান, যিনি কৃষি-বাস্তুতন্ত্র মেনে আপনার জন্য খাদ্য উৎপাদন করবেন। আমরা যাঁরা শহরে থাকি, তাঁদের নগর উদ্যানের জন্য সওয়াল করা উচিত, যেখানে আমরা একসঙ্গে আমাদের খাবার উৎপাদন করতে পারব, এবং আমাদের সন্তানদের দেখাতে পারবো যে খাবার গাছ থেকে আসে, ফ্রিজ থেকে নয় । এই সমস্ত নীতির প্রয়োগের পরিণতি হল, একটা সবুজ অর্থনীতির ভিত্তিস্থাপন, যা নির্ভর করবেন পুনরুৎপাদন, অর্থনৈতিক স্ব-শক্তিকরণের উপর । যখন পৃথিবীর অর্থনৈতিক অন্ধকারে নিমজ্জিত,তখন ভাঙাচোরা অর্থনীতি ও শিল্পব্যবস্থার ছাই থেকে ভারতকে বেরিয়ে আসতে হবে একটা নতুন দৃষ্টান্তকে আপন করে নিতে – সবুজ অর্থনীতি। মহাত্মা গাঁধী যেভাবে দেখেছিলেন, স্বদেশী অর্থনীতি আমাদের মধ্যে বইছে। এই বসুন্ধরা দিবসে আমাদের শপথ নিতে হবে বসুধৈব কুটুম্বকম পরিবারের জন্য, এবং বিজ্ঞান, সহনশীলতা এবং পৃথিবীর পথে যাত্রা শুরু করতে হবে।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.