শ্রীনগর, 5 অগাস্ট : জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করার আজ বর্ষপূর্তি ৷ ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তের এক বছর পূর্ণ হওয়ায় BJP বিশাল আকারে দিনটি উদযাপন করার পরিকল্পনা করছে ৷ শুধু বিশেষ মর্যাদা খর্ব নয়, দু'টি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হয় এই রাজ্যকে ৷ বহু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, এই সব অঞ্চলের মানুষ 'বিভ্রান্তি ও ভয়'-র মধ্যে দিয়ে চলেছে ৷
জম্মু ও কাশ্মীরের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছে ETV ভারত ৷ জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করার দিন থেকে সব রকমের উন্নয়নের উপর নজর রেখেছেন বহু বিশেষজ্ঞ ৷ তাঁদের সঙ্গেও কথা বলেছে ETV ভারত ৷
বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণে জমি ব্যাঙ্ক
গত বছর নভেম্বর মাসের প্রথম 15 দিনের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জমি ব্যাঙ্ক তৈরি করা শুরু করে ৷ 5 অগাস্ট কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের চার মাস পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৷ কেন্দ্রের তরফে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত নিয়ে গুজব ছড়িয়েছিল এবং আর একটি বড় উন্নয়ন হতে পারে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছিল ৷ নিজেদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করতে প্রশাসনের তরফে বলা হয়, "আসন্ন জম্মু ও কাশ্মীর গ্লোবাল ইনভেস্টার্স সামিট-2020-তে এটি করা হচ্ছে ৷"
জম্মু ও কাশ্মীর স্টেট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রবিন্দর কুমার বলেন, "জম্মু ও কাশ্মীর গ্লোবাল ইনভেস্টার্স সামিট 2020-এর প্রস্তুতি চলছে ৷ সেখানে উপস্থিত বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জমি ব্যাঙ্ক তৈরির বিষয়ে আমরা নজর দিচ্ছি ৷ জম্মু ও কাশ্মীর উভয় অঞ্চলের প্রায় 624 একর জমি এর জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে ৷ আমাদের চিহ্নিত করা জমি শিল্পের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে ৷"
ডোমিসাইল অ্যাক্ট
জম্মু ও কাশ্মীরে স্থায়ী বসবাসের জন্য কেন্দ্র নতুন আইনের সঙ্গে পরিচয় করায় ৷ এই আইন অনুযায়ী, কিছু নির্দিষ্ট শর্ত মানলে সমস্ত ভারতীয় নাগরিক জম্মু ও কাশ্মীরে সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবে ৷ কেন্দ্র জম্মু ও কাশ্মীর থেকে 29টি আইন তুলে নেয় ও 109টি আলাদা আইনের সংশোধন করে ৷
এই আইনের বিরুদ্ধে বিপুলভাবে সমালোচনা করে উপত্যকার আঞ্চলিক মূল রাজনৈতিক দলগুলি ৷ সঙ্গে বলে এটা পক্ষপাতমূলক ও অপমান ৷
2019 সাল পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীর 370 ধারা ও 35এ ধারার আওতায় বিশেষ মর্যাদা ভোগ করত ৷ যা বাকি ভারতের কাউকেই সেখানের বাসিন্দা হওয়ার অনুমতি দিত না ৷ এর মানে বাইরের কেউ স্থানীয় সরকারের অধীনে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবে না বা সেখানে কোনও জমিও কিনতে পারবে না ৷ তবে, এই নিয়ম কেন্দ্রীয় সরকারের পোস্টিংয়ের উপর এটা প্রযোজ্য ছিল না ৷
জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের জন্য এই নতুন নিয়মে শুধুমাত্র চতুর্থ শ্রেণির নন-গেজ়েটেড চাকরি সংরক্ষিত থাকে ৷ এর তালিকায় এমন কিছু শর্ত থাকে যা পূরণ করলে তবেই কেউ আবেদন করতে পারবেন ৷ আবেদনকারীকে 15 বছরের জন্য জম্মু ও কাশ্মীরে থাকতে হবে বা সাত বছরের জন্য ওই রাজ্যে পড়াশোনা করতে হবে এবং দশম শ্রেণি বা দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় বসতে হবে ৷
কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিকদের (সেনা, আধাসামরিক বাহিনী, IAS, IPS) ছেলেমেয়েরা ও সরকারি ক্ষেত্রের, ব্যাঙ্ক ও কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা যাঁরা 10 বছর ধরে জম্মু ও কাশ্মীরে রয়েছেন, তাঁরা গেজ়েটেড ও নন-গেজ়েটেড সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবেন ৷
সশস্ত্র বাহিনীর জন্য স্ট্র্যাটেজিক এরিয়া
এবছর 17 জুলাই জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসন ঠিক করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ভিতরে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য 'স্ট্র্যাটেজিক এরিয়া' তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় ৷ একটি সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়, লেফটেন্যান্ট গভর্নর জি সি মুর্মুর সভাপতিত্বে জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসনিক পরিষদ এই পদক্ষেপের অনুমোদন দেয় ৷
এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলি ৷ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা নয়িম আখতার দাবি করেন, এই সিদ্ধান্ত জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করার চেয়েও ভয়াবহ ৷ তিনি বলেন, "এতে মনে হচ্ছে, আমাদের কবরস্থানের জন্যও পর্যাপ্ত জমি থাকছে না ৷ এর অর্থ জম্মু ও কাশ্মীরের কোনও বাসিন্দার এমনকী, স্থানীয় সরকারের মূল কাজগুলি নির্ধারণ করার ক্ষমতা নেই ৷"
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা ?
ক্যামেরার সামনে কথা বলতে নারাজ স্থানীয়রা ৷ 370 ধারা প্রত্যাহারের বিষয়ে প্রশাসনের নেওয়া সিদ্ধান্তে তাঁরা বিভ্রান্ত ৷ তবে, জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের বিষয়টি পর্যালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা ৷ তাঁদের মতে এই সিদ্ধান্ত "একতরফা ও সুবিধাবাদী ৷"
বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক রিয়াজ় মাসরুরের মতে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত "একতরফা" ও "অগণতান্ত্রিক" ৷
তিনি বলেন, "গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আইন তৈরি হয় ও সংশোধিত হয় ৷ আইন বাস্তবায়িত হলে নাগরিকদের তা অনুসরণ করতে হয় না হলে তাদের এক পরিণতির মুখোমুখি হতে হয় ৷ কিন্তু কাশ্মীরে মানুষ গত বছর নেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ৷ জম্মু ও কাশ্মীরে কোনও নির্বাচিত সরকার নেই ৷ প্রশাসনিক পরিষদের অধীনে কয়েকটি সরকারি কাজের জন্য দু-তিনজন আধিকারিকদের নিযুক্ত করা হয়েছে ৷ এটি গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ৷ তাই আমরা এই সিদ্ধান্তগুলির বিরোধিতা করতে দেখছি ৷"
মাসরুর আরও বলেন, "এই সিদ্ধান্তগুলি যদি পর্যাপ্ত মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে যেত, তাহলে আমার বিশ্বাস মানুষের মধ্যে কোনও রাগ থাকত না ৷ আজ আমরা যে পরিবর্তনগুলি দেখছি সেগুলি একতরফা ও গণতন্ত্রের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ৷"
গত এক বছরে ওই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থা নিয়েও কথা বলেন মাসরুর ৷ তিনি বলেন, "যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতারা কাশ্মীরে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং মানুষ তাঁদের জন্য ভোটও দিয়েছিল ৷ তাঁরা একবছর ধরে গৃহবন্দী ৷ সম্প্রতি কাশ্মীরে কোনও রাজনীতি নেই ৷ কোনও গণতান্ত্রিক বিন্যাস নেই ৷"
আর একজন সাংবাদিক ফিরদৌজ় ইল্লাহি মনে করেন, "এই সিদ্ধান্তগুলি কাশ্মীরিদের কণ্ঠরোধ করার জন্যই নেওয়া হয়েছে ৷"
তিনি বলেন, "370 ও 35এ ধারা প্রত্যাহার-সহ সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যখন মানুষ তাঁদের বাড়ির মধ্যেই বিধিনিষেধের মধ্যে থাকত ৷ এটা ভুল ৷ কোনও সিদ্ধান্ত যথাযথ রাস্তার মধ্য দিয়ে নিতে হয় এবং যদি সেখানে একটি নির্বাচিত সরকার থাকে ৷ আমার মনে হয় এখানে মানুষের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে ৷ মানুষ ভয়ে ভয়ে রয়েছে এবং কেউই কথা বলার জন্য প্রস্তুত নয় ৷"
আর একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক হায়া জাভেদের মতে, "370 ও 35এ ধারা প্রত্যাহার ভারত ও জম্মু কাশ্মীরের সম্পর্কের আরও বেশি করে চিড় ধরিয়েছে ৷"
তিনি বলেন, "যাঁদের ভারতে বিশ্বাস ছিল ও যাঁদের মনে হয়েছিল দেশ তাঁদের সঙ্গে থাকবে, ধারাগুলি প্রত্যাহারের পর তাঁরা তাঁদের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে ৷ কিছু মানুষ আনন্দ প্রকাশ করলেও জম্মু ও কাশ্মীরের বেশিরভাগ বাসিন্দায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর হতাশ ও ক্রোধ প্রকাশ করেছে ৷"
ডোমিসাইল অ্যাক্টের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "জম্মু ও কাশ্মীরের বেকার যুবসমাজকে কি প্রশাসন চাকরি দিয়েছে যে তারা বাকি দেশের মানুষকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে চাকরির জন্য আহ্বান করেছে ?"