পটনা, 26 নভেম্বর : আমাদের দেশের ইতিহাস প্রগতিশীল । আর এই ইতিহাসেই লুকিয়ে রয়েছে দেশের কিছু জানা ও অজানা তথ্য । কিন্তু অনেকেই জানেন না ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার আগে ডঃ সচ্চিদানন্দ সিনহা দেশের অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি ছিলেন । তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি আচার্য জে বি কৃপালানি তাঁকে এই পদে নির্বাচিত করেন । 1946 সালে 9 ডিসেম্বর গণপরিষদ গঠন হয় । ওই একইদিনে অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হন সচ্চিদানন্দ সিনহা । পরে 1946 সালের 11 ডিসেম্বর পরোক্ষ নির্বাচনের দ্বারা ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন ।
প্রথম জীবন
ডঃ সচ্চিদানন্দ সিনহা 1871-র 10 নভেম্বর মহর্ষি বিশ্বমিত্রর জন্মস্থল বক্সারের মুরার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবা বক্সি শিবপ্রসাদ সিনহা ডুমরাওঁ মহারাজের মুখ্য তহশিলদার ছিলেন । গ্রামেরই একটি স্কুলে সচ্চিদানন্দ তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন । 18 বছর বয়সে 1889 সালের 26 ডিসেম্বর তিনি আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে ইংল্যান্ডে যান । 1893 সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কেরিয়ার শুরু করেন । পরে এলাহাবাদ হাইকোর্টে 10 বছরের জন্য আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন । এরই মধ্যে তিনি 'ইন্ডিয়ান পিপলস্' ও 'হিন্দুস্তান রিভিউ' নামে দুটি সংবাদপত্রের সম্পাদনা করেছেন । । দীর্ঘদিন এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সচ্চিদানন্দ ।
অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভূমিকা
1946 সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করে । 1946-র 9 ডিসেম্বর দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চল থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দিল্লির কনস্টিটিউশন হলে জমায়েত হন । এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী । গণপরিষদে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি আচার্য জে বি কৃপালানি অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি পদের জন্য ডঃ সচ্চিদানন্দের নাম প্রস্তাব করেন । কৃপালানির এই প্রস্তাবে সবাই সমর্থন জানান । অ্যামেরিকা, চিন ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের প্রতিনিধিদের থেকেও শুভেচ্ছা বার্তা পান সচ্চিদানন্দ । এরপরই তিনি স্বাধীন ভারতের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান তৈরিতে বিশ্বের বিভিন্ন সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও তাদের বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ করেন ।
খুদাবক্স লাইব্রেরির সঙ্গে সচ্চিদানন্দের সম্পর্ক
1894 সালে সচ্চিদানন্দের সঙ্গে বিচারপতি খুদাবক্স খানের দেখা হয় । এলাহাবাদ হাইকোর্টে ওকালতি করার সময় তিনি খুদাবক্সের অধীনে কাজ করতে শুরু করেন । 1891-র 29 অক্টোবর চাপড়ার এই ব্যক্তি খুদাবক্স পটনায় একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন । ভারতের পুরোনো লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম । এরপর হায়দরাবাদে নিজ়াম হাইকোর্টে বদলি হয়ে যান খুদাবক্স । সেইসময় এই লাইব্ররির দায়িত্ব নেন সচ্চিদানন্দ । 1894 থেকে 1898 সাল পর্যন্ত তিনি খুদাবক্স লাইব্রেরির দায়িত্ব সামলান ।
বাংলা থেকে বিহারকে আলাদা করতে সচ্চিদানন্দের তৎপরতা ও পদক্ষেপ
বাংলা থেকে বিহারের আলাদা হওয়ার বিষয়ে সচ্চিদানন্দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । এক্ষেত্রে সাংবাদিকতাকে তিনি হাতিয়ার করেন । সেই সময় বিহার থেকে একটিই সংবাদপত্র প্রকাশিত হত । যার নাম 'দ্য বিহার হেরাল্ড' । গুরুপ্রসাদ সেন ছিলেন তার সম্পাদক । এরপর 1894 সালে সচ্চিদানন্দ একটি ইংরেজি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন । তার নাম 'দা বিহার টাইমস'। 1906 সালে এই সংবাদপত্রের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'বিহারি' । কয়েক বছর ধরে মহেশ নারায়ণের সঙ্গে এই সংবাদপত্রটি যৌথভাবে সম্পাদনা করতেন সচ্চিদানন্দ । এই সংবাদপত্রের মাধ্যমে তিনি পৃথক বিহার রাজ্যের দাবিতে প্রচার চালিয়েছিলেন । পৃথক বিহার রাজ্যের জন্য হিন্দু ও মুসলমানদের একত্রিত হওয়ার আবেদনও করেন । তাঁর চেষ্টায় অবশেষে 1905-এর 19 জুলাই বিহার বাংলা থেকে আলাদা হয় । ঘোষিত হয় পৃথক রাজ্য হিসেবে ।
স্বর্গীয় স্ত্রীর স্মৃতিতে 'সিনহা' লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা সচ্চিদানন্দের
1924 সালে স্ত্রী স্বর্গীয় রাধিকা সিনহার স্মৃতিতে সচ্চিদানন্দ 'সিনহা' লাইব্ররির প্রতিষ্ঠা করেন । মানুষের মানসিক, বৌদ্ধিক ও শিক্ষাগত উন্নতির জন্য এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি । 1926-এর 10 মার্চ লাইব্রেরিটি পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্ট কমিটি গঠিত হয় । সদস্যদের মধ্যে প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সহ সেই সময়ের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এই লাইব্রেরির আজীবন সদস্যপদ গ্রহণ করেন ।
সেই লাইব্রেরির কর্মী সঞ্জয় কুমার বলেন, "ডঃ সাহেব লন্ডন ব্যারিস্টার পড়তে যেতে চেয়েছিলেন । কিন্তু মা-বাবা তাঁকে প্রথমে অত দূরে পাঠাতে চাননি । কিন্তু বাবা-মাকে বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি লন্ডনে গিয়েছিলেন । লন্ডন থেকে ফিরে পৃথক বিহার রাজ্যের জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন ।"
পটনায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
1950-র 6 মার্চ বিহারের পটনায় সচ্চিদানন্দ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা কারণে তিনি ভুগছিলেন । তাঁর মৃত্যুর কয়েক দিন আগেই তিনদিনের পটনা সফরে গিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ । সেখানে দু'বার সচ্চিদানন্দকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ । তাঁর মৃত্যুর আগে স্ত্রী রাধিকা সিনহার একটি পোট্রেট প্রকাশ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি । পরে সচ্চিদানন্দের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেন, "সচ্চিদানন্দ এক বুদ্ধিমান ব্যক্তি । তিনি আধুনিক বিহারের জনক ।"
সমাজকর্মী অনীশ অঙ্কুর বলেন, "ডঃ সচ্চিদানন্দ সিনহার জন্যই আজ বিহারের আলাদা অস্তিত্ব রয়েছে ।" সাংবাদিক ও লেখক অরুণ সিং বলেন, " তিনি তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য গণপরিষদের অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং সংবিধান রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । "
সচ্চিদানন্দ পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন । 1936 থেকে 1944 পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব সামলান । তিনি বিহার ও ওড়িশার আইন পরিষদের সভাপতিও ছিলেন । পাশাপাশি তাঁকে এই দুটি রাজ্যের নির্বাহী কাউন্সিলর ও আর্থিক বিষয়ক সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয় । শুধু তাই নয়, তিনি প্রথম ভারতীয় যাকে একটি প্রদেশের আর্থিক বিষয়ক সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল ।