2020 সালের 15 ও 16 জুনের মাঝামাঝি সেই রাত , যেদিন হিমেল হাওয়ার স্রোত লুটিয়ে পড়ছিল গালওয়ান উপত্যকায় , যেখানে 1988 সাল থেকে ভারত এবং চিনের মধে্য আস্থা প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপের (CBMs) স্থাপত্যশৈলী গড়ে উঠেছিল , অবশেষে তার করুণ সমাপ্তি হল । এক দশকেরও বেশি সময় ধরেই এই দিনটি আসার অপেক্ষায় ছিল ।
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (LAC) নজরদারি চালানোর জন্য প্রোটোকল এবং CBMs গুলির স্থাপত্যশৈলীর নির্যাস হল 1993, 1996 , 2005 এবং 2013 সালে স্বাক্ষরিত চারটি চুক্তি । এর মধ্যে 1993 সালে স্বাক্ষরিত শান্তি ও স্থিতাবস্থা রক্ষা সংক্রান্ত চুক্তিতে বলা হয়েছিল যে দু’পক্ষ কখনও একে অন্যকে হুমকি বা হুঁশিয়ারি দিতে সেনার প্রয়োগ করবে না এবং প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা সংক্রান্ত নিয়মনীতিকে সম্মান জানিয়ে তা মেনে চলবে । 1996 সালের চুক্তি আবার গুরুত্ব দিয়েছিল CBMs-এর উপর । এটা আসলে ছিল ‘যুদ্ধ করা যাবে না’ । সদৃশ চুক্তির আওতায় বলা হয়েছিল যে , কোনও পক্ষই অন্যের বিরুদ্ধে সেনাবল প্রয়োগ করতে পারবে না । পাশাপাশি বলা হয়েছিল যে , LAC-র দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনও পক্ষই বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করতে পারবে না , কোনও বিস্ফোরণ ঘটাতে পারবে না , বন্দুক , বিস্ফোরকও ব্যবহার করতে পারবে না । আবার ২০০৫ সালের প্রোটোকলে বলা হয়েছিল যে , যদি দু’পক্ষের সীমান্তরক্ষীরা কখনও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার বিন্যাস নিয়ে বা অন্য কোনও কারণে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে সম্মুখ সমরে উপস্থিত হয় , তাহলে প্রথমেই তাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং পরিস্থিতি যাতে হাতের বাইরে চলে না যায় । তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থা নিতে হবে । স্পষ্টভাবে একথা বলা হয়েছিল যে , দু’পক্ষের সেনারা যদি সম্মুখ সমরে এসে উপস্থিত হয় , তাহলে ওই এলাকায় তাদের গতিবিধি প্রথমে নিয়ন্ত্রণ করবে , কেউ এগোবে না এবং পরপর, নিজ নিজ ছাউনিতে ফিরে আসবে । সম্মুখ সমরের পরিস্থিতি থাকাকালীন , কোনও পক্ষই, অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রয়োগ করবে না বা বাহিনী প্রয়োগ করার ভয় দেখাবে না । কোনও উস্কানিমূলক পদক্ষেপ করবে না এবং পরস্পরের সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক আচরণ করবে ।
2013 সালের ভারত-চিন সীমান্ত চুক্তিতে এই বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল যে, কোনও পক্ষই অন্যের বিরুদ্ধে নিজ নিজ সেনা , সমরাস্ত্রের প্রয়োগ করবে না এবং নিজের সেনাশক্তি দিয়ে অন্যপক্ষকে ভয় দেখাবে না বা আক্রমণ করবে না । বিগত কয়েক বছরে যতবার দু’পক্ষের সেনা সীমান্তে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে , সেই অভিজ্ঞতা থেকেই একটি সতর্কিকরণ চুক্তিতে যোগ করা হয়েছিল যে , LAC-র নিয়মাবলী নিয়ে যদি কোনও বোঝাপড়ার অভাব হয় , সেক্ষেত্রে দু’পক্ষের সেনার কেউই , অন্যপক্ষের অধিকৃত এলাকায় নজরদারি চালাবে না । বা সেনাদলকে অনুসরণ করবে না । এবারও একই বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল যে , যে কোনও পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ স্তরের আত্মসংযম বজায় রাখতে হবে । কোনও প্ররোচনামূলক পদক্ষেপ করা যাবে না । অন্য পক্ষের সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক আচরণ করতে হবে এবং গোলাগুলি বা সশস্ত্র সংঘর্ষ রুখতে হবে ।
1996 এবং 2005 সালের চুক্তিতে কার্যকরী প্রোটোকল এবং নজরদারি চালাতে গিয়ে সম্মুখ সমরের পরিস্থিতিতে ড্রিলসমূহ যোগ করা হয়েছিল । যেমন ব্যানার ড্রিল , যেখানে ছাউনিতে ফিরে আসার পরামর্শের পুনরাবৃত্তির ব্যানার দেওয়া থেকে শুরু করে নির্ধারিত স্থানে বর্ডার পারসোনেল মিটিং (BPMs)-এর আয়োজন করার মতো জরুরি পদক্ষেপ অনুসরণ করার কথাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । সত্যি কথা বলতে , বেশিরভাগ সম্মুখ সমরের ঘটনায় এই সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত মাত্রাবিধি অনুসরণ করা হয়েছে এবং এর ফলে সেনাবাহিনী উপদ্রুত স্থান থেকে সরে গিয়ে , নিজ নিজ ছাউনিতে ফিরে গিয়েছে । কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিবাদ এবং হাতাহাতি, ঘুষোঘুষির বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে যা পরে BPMs-এ আলোচনা করা হয়েছে । এই কথা নির্দিষ্ট করে বলা উচিত যে , সবসময় বাহিনীর সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র মজুত ছিল নিরাপত্তার কারণে এবং প্রতিবারই যথাযথ সেনা মহড়া রীতি অনুসরণ করা হয়েছে ।
গত 8 বছরে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে প্রোটোকল ভাঙা হয়েছে । এইসব ঘটেছে রাকি নাল্লা , চুমার , প্যানগং সো , ডেমচক এবং ডোকলামে । যখন প্রোটোকল ভেঙে চিনা সেনা ছাউনিতে ফিরে যেতে অস্বীকার করেছে এবং এর ফলে সম্মুখ সমর সদৃশ পরিস্থিতির মেয়াদ বেড়েছে । ধীরে ধীরে যে প্রোটোকলগুলি ক্ষয়ে যাচ্ছে , তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ।
পূর্ব লাদাখ , প্যানগং সো , গালওয়ান উপত্যকা এবং উষ্ণ প্রস্রবণ-গোগরায় সম্প্রতি যা ঘটেছে , তা আবারও প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে প্রোটোকল এবং CBMs রক্ষার ব্যর্থতা । প্রথমে প্যানগং সো এবং পরে 15/15-এ গালওয়ানে সংঘর্ষ এবং হাতাহাতিতে চিনা সেনা , ভারতীয় সেনার উপর আঘাত হানতে মধ্যযুগীয় সমরাস্ত্র যেমন পেরেক লাগানো কোদাল , কাঁটাতার জড়ানো রড , নাকেল ডাস্টার ব্যবহার করে যে বর্বরতা এবং নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে , তা দু’পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রোটোকল ও চুক্তির প্রতি পুরোপুরি অবমাননাকর । এই ধরনের প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্র চিনা সেনার কাছে থাকার অর্থ , এই হামলা ছিল পূর্বপরিকল্পিত । ভারতীয় সেনা 15 জুন , 2020-তে গালওয়ান উপত্যকায় হওয়া সংঘর্ষে 20 জন নির্ভীক জওয়ানকে হারিয়েছে । যে ঘটনায় বিচিত্র ধরনের হিংসার আশ্রয় নিতে দেখা গিয়েছিল চিনা বাহিনীকে ।
LAC—র রক্ষণাবেক্ষণের পুনরায় পর্যালোচনা করার এটাই সময় । 1988 থেকে 2005 সাল পর্যন্ত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের 15 টি বৈঠক এবং বিশেষ প্রতিনিধিদের মধ্যে হওয়া 22 টি বৈঠক সত্ত্বেও LAC-র সীমা নির্ধারণে কোনও অগ্রগতি হয়নি । তাৎপর্যপূর্ণভাবে চিনা সেনা এ প্রসঙ্গে কথা বাড়াতে আর চায় না । কারণ ভারতের বিরুদ্ধে তাদের উদ্দেশ্যসাধনের অভিপ্রায় তাদের তা করতে দেবে না । LAC-তে চিনারা যে সবচেয়ে অবিশ্বস্ত , তারা তা বুঝিয়ে দিয়েছে আর ধীরে ধীরে সেখানে তারা এগোনোর চেষ্টা করছে এবং অতিরিক্ত এলাকা দখলের চেষ্টা করছে এবং অধিকৃত অংশ ছেড়ে দিতেও অস্বীকার করছে । আর তা করতে গিয়ে, তারা সেনাবাহিনীর ব্যবহার করতেও বিরত হচ্ছে না । চিনা বাহিনীর মধ্যে বিশ্বস্ততারক্ষার অভাবও এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় ।
এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , ক্রমাগত হুমকি বা প্ররোচনার মুখে পড়লে আত্মরক্ষা করা বা নিজের বাহিনীকে রক্ষা করার অধিকার সেনার আছে । একে ‘রাইট টু ইনডিভিজ়ুয়াল’ বা ‘ইউনিট সেল্ফ ডিফেন্স’ বলা হয় । যা সেনাদের যে কোনও প্রাণঘাতী হুমকি থেকে নিজেদের রক্ষা করার অনুমতি দেয় । যেখানে যতই বাহিনী প্রয়োগের উপরে বিধিনিষেধ আরোপিত থাকুক না কেন । চিনা প্ররোচনার যে খোলাখুলি ছবিটা সামনে এসেছে , তা দেখে এটা বলা যায় যে ভারতীয় সেনা জওয়ানদের কথা ভেবে , তাঁদের পক্ষেই এবার সেনার নিয়মনীতি সংশোধন করা উচিত , যাতে প্রয়োজনীয় কৌশলগত বিষয়ে সেনা মোতায়েন করা যেতে পারে এবং নিজেকে ও বাহিনীকে বাঁচাতে সমরাস্ত্রের প্রয়োগ করা যেতে পারে । এক্ষেত্রে এটা উল্লেখ করা দরকার যে সেনার কখনওই আত্মরক্ষা করতে গিয়ে সেকেলে , মধ্যযুগীয় অস্ত্র , যা চিনা সেনা সম্প্রতি ব্যবহার করেছে , তা করা উচিত নয় । কারণ এতে সে অভ্যস্ত নয় আর সেভাবে তার প্রশিক্ষণ হয়নি ।
বাহিনীর প্রতিটি জওয়ানের জীবন যে কোনও দেশের কাছে অত্যন্ত দামী । কোনও দেশেরই উচিত নয় তার সেনাবাহিনীকে সীমান্তে নিরাপত্তারক্ষার দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো । কিন্তু একইসঙ্গে তার হাতদু’টো কূটনৈতিক নিয়মনীতি এবং CBMs দিয়ে বেধে রাখা । দ্বিতীয় বিষয়টি তাও পুনরায় পর্যালোচনা করা যেতে পারে । যত দ্রুত সম্ভব, নয়া নিয়মনীতি জারি করা প্রয়োজন ।
প্রতিবেদনটি লিখেছেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনেরাল রাকেশ শর্মা