নয়াদিল্লি, 14 জুন : ইউহান ল্যাবরেটরি লিক তত্ত্ব (Lab Leak Theory) । গবেষণাগার থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার তত্ত্বটি প্রথমবার প্রকাশ্যে আসার পর রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছিল । এক্ষেত্রে সবার আগে যে নামটি আসে তা হল 2020 সালে টুইটারে তৈরি হওয়া ড্রাসটিক (DRASTIC) গ্রুপের কথা । 24 জন বিজ্ঞানীকে নিয়ে তৈরি এই দলটির পুরো নাম ডিসেন্ট্রালাইজ়ড ব়্যাডিক্যাল অটোনমাস সার্চ টিম ইনভেস্টিগেটিং কোভিড 19 । দলের মূল লক্ষ্য সার্স কোভ 2-এর (Sars-CoV-2) সংক্রমণ কীভাবে শুরু হল, তা খুঁজে বের করা । দলের কয়েকজন নিজেদের আসল নাম ব্যবহার করলেও, বেশিরভাগ সদস্যই ছদ্মনামের ।
ড্রাসটিকের এমনই একজন সদস্য হলেন দ্য সিকার (The Seeker) । না, অবশ্যই আসল নাম নয় । ছদ্মনাম । এই নামেই নিজের টুইটার হ্যান্ডেল চালান । পদবি অবশ্য রায় । আপাদমস্তক বাঙালি । থাকেন ভুবনেশ্বরে । কিন্তু তিনি আসলে কে, তা কেউ জানে না । সিকার কথাটার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, যিনি কিছু একটা খুঁজছেন । কিন্তু কী খুঁজছেন তিনি ? ব্যোমকেশের মতো তিনিও সত্যান্বেষী । সত্যকে খুঁজে বেরাচ্ছেন । আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে করোনা ভাইরাসের উৎসের আসল সত্যটা খুঁজছেন তিনি ।
করোনার উৎস সন্ধানের চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলছে । প্রথমদিকে বলা হচ্ছিল, ইউহানের কাঁচা মাংসের বাজার (Wuhan Wet Market) থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে । যে তত্ত্বটি সবথেকে বেশি খাঁড়া করার চেষ্টা হচ্ছিল -- বাদুড়ের থেকে প্যাঙ্গোলিনের শরীর হয়ে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়েছে করোনা । কিন্তু যত সময় এগোতে থাকে ততই জোরালো হতে থাকে ল্যাব লিক তত্ত্ব । প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, ইউহানের ল্যাবরেটরি থেকেই ভাইরাস ছড়ায়নি তো ? আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো সরাসরি চায়না ভাইরাস বলে বসেছিলেন করোনাকে । কিন্তু তখন পুরোটাই ছিল শূন্যে ঢিল মারার মত । কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেননি ট্রাম্প । অনেকেই ভেবেছিলেন, হয়ত চিনকে কূটনৈতিকভাবে প্যাঁচে ফেলতেই ট্রাম্প এই ধরনের মন্তব্য করছেন ।
আরও পড়ুন : কোন সত্যি লুকিয়ে রয়েছে ইউহানের ল্যাবরেটরিতে ?
পরে যত সময় এগিয়েছে, তত তত্ত্ব সামনে এসেছে । এমনও বেশ কিছু তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে যা ইঙ্গিত দিচ্ছে ভাইরাসের সংক্রমণ অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল চিনে । কেউ বলছেন চিন জৈব অস্ত্র তৈরি করছিল করোনা ভাইরাসকে ব্যবহার করে । কিন্তু আসল সত্যটা এখনও অজানা । আর সেটাই খুঁজে চলেছেন সিকার মহাশয় । চিনের এক গাদা গবেষণাপত্রও ঘেঁটে ফেলেছেন ।
এইসব করতে করতেই মে মাসে একটি গবেষণাপত্র তাঁর নজরে আসে । 2013 সালে প্রকাশিত হয় গবেষণাপত্রটি । সেখানে মোজিয়াংয়ের একটি খনির কথা বলা হচ্ছে । যে ঘটনাটির কথা বলা হচ্ছে তা আরও এক বছর আগের । 2012 সালের । খনিতে কর্মরত ছয় জন শ্রমিক শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা অনুভব করতে শুরু করেন । খনিটিতে প্রচুর সংখ্যায় বাদুড় ছিল । পরে কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে কুনমিং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হন । তিন জনেরই মৃত্যু হয় তিন মাসের মধ্যে ।
সিকার মহাশয়ের হাতে আসা গবেষণাপত্র থেকে এটা স্পষ্ট যে ওই শ্রমিকদের শরীরে এমন কিছু একটা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছিল, যার সঙ্গে সার্স কোভ-2 এর হুবহু মিল না থাকলেও অনেকটা মিল রয়েছে । প্রায় 96 শতাংশ মিল । গবেষণাপত্র অনুযায়ী, যে তিন জন মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের এক জনের রক্তের নমুনা পাঠানো হয়েছিল ইউহানের ল্যাবরেটরিতে ।
আরও পড়ুন : 2015 সালেই করোনা নিয়ে গবেষণা ! জৈব অস্ত্র তৈরি করছিল চিন ?
আর ইউহান শহর থেকে এই খনি এলাকার দূরত্বও খুব বেশি নয় । মাত্র হাজার মাইল । অর্থাৎ, দেখতে গেলে জল যেখানকারই হোক, সব এসে মিশছে ইউহানের ল্যাবরেটরিতে । হতেই পারে এই সব যাবতীয় তত্ত্ব ভুল । তাহলে এত রাখঢাক কীসের ? যদি সত্যিই স্বাভাবিক নিয়মেই সংক্রমণ ছড়িয়ে থাকে... তাহলে তো চিনের কোনও দোষ নেই । কিন্তু চিন শুরু থেকেই বিষয়টিকে ধাপাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে আসছে । করোনার উৎস সন্ধানে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিকে কোনওরকমভাবে সাহায্য করছে না শি চিনপিংয়ের দেশ । বরং একের পর এক 'ভেটো' দিয়ে যাচ্ছে । এখন তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও হাল ছেড়ে দিয়েছে -- বলছে, চিনকে জোর করা যায় না ।
যদি কিছু নাই হয়ে থাকে, তাহলে কোন কেঁচো খুড়তে কেউটের ভয় পাচ্ছে চিন ? আর এই প্রশ্নকেই আরও জোরালো করছে ইউহানের ল্যাবরেটরির দায়িত্বে থাকা শি চেংলির হাবভাব । যখন করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হল, তারপর যখন সবাই চিনের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করল, তখন বারবার চেংলি বলে এসেছেন, এর সঙ্গে ইউহানের ল্যাবরেটরির কোনও যোগ নেই । কিন্তু বেমালুম এড়িয়ে গিয়েছেন 2012 সালে মোজিয়াংয়ের খনিতে তিন শ্রমিকের মৃত্যুর কথা । অথচ ওই বাদুড়ে খনিতে মৃত শ্রমিকের রক্তের নমুনা এসেছিল তাঁর ল্যাবরেটরিতেই । তাঁর ল্যাবরেটরিতেই পরীক্ষা হয়েছিল নমুনার, যাতে দেখা গিয়েছিল সার্স কোভ-2-এর সঙ্গে ওই ভাইরাসের 96 শতাংশ মিল ।
আরও পড়ুন : ইউহানের ল্যাবরেটরিতেই তৈরি হয়েছে করোনা ভাইরাস, দাবি ব্রিটিশ অধ্যাপকের
পরে করোনা অতিমারির আকার নিলে চেংলি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন । সেখানে একটি নতুন ভাইরাসের কথা বলা হয় । ব়্যাটজি 13 । করোনার সঙ্গে এই ভাইরাসের জিনগত 96 শতাংশ মিল রয়েছে, একথাও স্বীকার করা হয় । কিন্তু ঠিক কোথায় এই ভাইরাসের হদিশ পাওয়া গিয়েছিল, তা স্পষ্ট করেননি ইউহানের ল্যাবরেটরির ওই গবেষক ।
তাহলে কি সত্যিই কোনও জৈব অস্ত্র তৈরি করছিল চিন ? এতদিনে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে অতিমারির আকার নেওয়ার অনেক আগে থেকেই চিনের গবেষণাগারে বিভিন্ন করোনা ভাইরাস নিয়ে গবেষণা চলছিল । সম্প্রতি এক বেসরকারি ইংরেজি দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিকার মহাশয় জানিয়েছেন, খুব সম্ভবত মোজিয়াংয়ের সেই খনিতে শ্রমিকরা যে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেটি একটি করোনা ভাইরাস । অথবা এমন কোনও একটি ভাইরাস যার থেকে পরবর্তী সময়ে সার্স কোভ-2 তৈরি হয়েছে ।
যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে এটাও স্পষ্ট হয় যে চিনের কাছে এই ভাইরাসের সন্ধান বহু বছর আগে থেকেই ছিল । কিন্তু তখন চিন তা প্রকাশ্যে আনতে চায়নি । এদিকে বিভিন্ন প্রাণী এবং কোষের মধ্যে বিভিন্ন করোনা ভাইরাস নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিল । লক্ষ্য ছিল, ভ্যাকসিন তৈরি করা । সিকার মহাশয়ের অনুমান, সার্স কোভ-2 এই ধরনের কোনও পরীক্ষা নিরীক্ষা চলাকালীনই তৈরি হয়েছে । তারপর পর্যাপ্ত সেফটি প্রটোকলের অভাবে সম্ভবত গবেষণাগার থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে ।
আরও পড়ুন : চিনা ভাইরাস ইউহানের ল্যাবরেটরি থেকেই এসেছে, করোনার উৎস প্রসঙ্গে ফের সরব ট্রাম্প
কিন্তু চিনের তরফে যে চক্রান্তের তত্ত্ব খাঁড়া করার চেষ্টা চলছে, তা একেবারেই মানতে নারাজ সিকার । তাঁর স্পষ্ট কথা, যেখান থেকে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছে, তার আশেপাশেই এমন কিছু করোনা ভাইরাসের স্ট্রেন নিয়ে কাজ চলছিল, যা সার্স কোভ-2-এর কাছাকাছি । কীভাবে মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে পারে এমন একটি ভাইরাস নিয়ে কাজ চলছিল, তার প্রকৃত সত্য জানতে তদন্ত অবশ্যই হওয়া দরকার । কিন্তু ইউহান ইনস্টিটিউন অফ ভাইরোলজির থেকে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা বিভ্রান্তিকর । অনেক কিছু সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং বেশ কিছু জায়গায় একটি তথ্যের সঙ্গে অন্য তথ্যের কোনও মিল নেই ।
কী কী সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, সেই সংক্রান্ত তথ্য গবেষণাগারে থাকার কথা । কিন্তু চিন সেই বিষয়ে মুখ খুলছে না । সমস্যাটা শুরু থেকেই ছিল । এখনও রয়েছে । স্বচ্ছতার অভাব । বাদুড়ের কোন কোন করোনা ভাইরাস নিয়ে কাজ চলছিল, তার নমুনা, স্পেসিমেন এবং আসল তথ্য ইউহানের ল্যাবরেটরি থেকে প্রকাশ্যে আনা হচ্ছে না । তাদের কাছে বাদুড়ের করোনা ভাইরাসের সব থেকে বড় ডেটাবেস রয়েছে । কিন্তু তা অফলাইন করে দেওয়া হয়েছে । যদি কিছু নাই গোপন করার থাকে, বা যদি চিন কোনও ভুল নাই করে থাকে, তাহলে তথ্যগুলি প্রকাশ্যে কেন আনা হচ্ছে না ? প্রশ্ন সিকার মহাশয়ের ।
ড্রাসটিক দলের আরও দুই ভারতীয় সদস্য রাহুল বাহুলিকার ও মোনালি রাহালকারও সিকারের এই মোজিয়াং খনি তত্ত্বের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন । তাঁদেরও দাবি, খনিতে বাদুড়ের শুকনো গুড়ো গুড়ো হয়ে যাওয়া মল বাতাসের মাধ্যমে শ্রমিকদের শরীরে ঢুকে পড়েছিল । তারপর ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটিয়েছিল ।
আরও পড়ুন : 2019’র ডিসেম্বরের আগে ইউহানে মেলেনি করোনার অস্তিত্বের প্রমাণ
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, যদি তাই হয়, তবে শুধু ছয় জন কেন, ওই এলাকার আরও অনেকের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারত । কিন্তু তা হয়নি । সংক্রমণ ছড়িয়েছে ইউহান থেকেই । আর এই ধারণা আরও স্পষ্ট হয়েছে কারণ, সার্স কোভ-2-এর জিনগত গঠন এমনই যেন তা মানুষের শরীরে সংক্রমিত হওয়ার জন্যই তৈরি হয়েছে । মানে, খনির শ্রমিকরা যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, আর এই সার্স কোভ-2 জিনগতভাবে আলাদা । অর্থাৎ এমনটা হতেই পারে, ওই মৃত শ্রমিকের শরীর থেকে যে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে নোভেল করোনা ভাইরাসে পরিণত করা হয়েছে ।
সম্ভাবনা অনেক রয়েছে । আসল সত্যিটা কী, তা এখনও অজানা । তবে যত দিন এগোচ্ছে, ততই জোরালো হচ্ছে ল্যাব লিক তত্ত্ব । সদ্য সমাপ্ত জি-7 বৈঠকেও করোনার উৎস সন্ধানের প্রসঙ্গ উঠেছে । ট্রাম্পের মতো আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বিষয়টির উপর জোর দিচ্ছেন । মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছেন করোনার শিকড় কোথায়, তা খুঁজে বের করে আনার । তবে করোনার উৎস সন্ধানে ড্রাসটিক দলের এই বাঙালি সত্যান্বেষী নিঃসন্দেহে করোনার উৎস সন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলে যাচ্ছেন ।