ETV Bharat / bharat

পিছিয়ে যাওয়া একটি পরিষেবা চাঙ্গা হল যেভাবে...

"2016সালে শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক সি রবীন্দ্রনাথ একটি বিশেষ মিশন ‘পাবলিক মিশন রিজুভিনেশন মিশন’ চালু করেছিলেন। এর মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে, সকলের জন্য উৎকৃষ্ট শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং কেরলকে প্রান্তিকতা—মুক্ত করা। আর গত সাড়ে চার বছরে এই প্রক্রিয়ায় যে ফল মিলেছে, তা বিস্ময়কর।', লিখেছেন কে প্রবীণ কুমার ৷

author img

By

Published : Jan 13, 2021, 5:01 PM IST

কীভাবে একটি মুমূর্ষু, অযত্নে চলা পরিষেবাকে পুনরুজ্জীবিত করে দেশের মধে্য সবচেয়ে বলিষ্ঠ করে তোলা হল?
কীভাবে একটি মুমূর্ষু, অযত্নে চলা পরিষেবাকে পুনরুজ্জীবিত করে দেশের মধে্য সবচেয়ে বলিষ্ঠ করে তোলা হল?

1995 সালের আগে কেরলে হাজার হাজার এমন সরকারি স্কুলশিক্ষক ছিলেন, যাদের রাতের ঘুম ভেঙে যেত চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে। বেশিরভাগ সময়েই স্কুলে, পড়ুয়াদের ধরে রাখার তাদের মরিয়া প্রচেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হত, কারণ অভিভাবকরা তাদের আশেপাশে নিত্যনতুন গজিয়ে ওঠা, চটকদার, সু—পরিচালিত বেসরকারি স্কুলগুলিতে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করার পিছনেই দৌড়তেন। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি তাদের উপার্জিত সমস্ত অর্থ নিংড়ে নিয়ে সেই সব স্কুলের মহার্ঘ বেতন এবং ক্যাপিটেশন দিতেন, যাতে তাদের সন্তানরা স্কুলে থাকতে পারে। সেইসময় জনশিক্ষাব্যবস্থায় বিভাগ ছঁাটাই এবং চাকরি ছঁাটাই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। শিক্ষক—শিক্ষিকারা বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন যাতে শিশুদের মনে আগ্রহ সৃষ্টি করে, তাদের সরকারি স্কুলে পড়ানোর জন্য রাজি করাতে পারেন। তাদের এই প্রচেষ্টার ফলে যদিও সরকারি স্কুলগুলিতে পাসের শতকরা হার বাড়ত, তবুও সরকারি স্কুল থেকে বেসরকারি স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের চলে যাওয়ার ধারা ছিল অব্যাহত।

যখন সব উপায়ই ব্যর্থ মনে হল, তখন কেরলের সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা 2016 সাল থেকে এমন পুনরুজ্জীবনের দৃষ্টান্ত মেনে চলতে লাগল, যা এককথায় অতুলনীয়। আর মাত্র সাড়ে চার বছরের মধে্য নীতি আয়োগের ‘স্টেট এডুকেশন কোয়ালিটি ইনডেক্স রিপোর্ট2019’, কেরলের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে দেশের সেরা বলে অভিহিত করল।

  • সরকার কী করেছিল?

2016সালে শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক সি রবীন্দ্রনাথ একটি বিশেষ মিশন ‘পাবলিক মিশন রিজুভিনেশন মিশন’ চালু করেছিলেন। এর মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে, সকলের জন্য উৎকৃষ্ট শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং কেরলকে প্রান্তিকতা—মুক্ত করা। আর গত সাড়ে চার বছরে এই প্রক্রিয়ায় যে ফল মিলেছে, তা বিস্ময়কর।

এই মিশনের সূচনার সঙ্গেই সরকারের তরফে আরও কিছু প্রকল্প শুরু হয়েছিল। যেমন আইটি@স্কুল প্রকল্প, যা শুরু হয়েছিল 2001—02 সালে। তবে ফের একে চালু করা হয় কেরল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড টেকনোলজি ফর এডুকেশন (কেআইটিআই) নামে। কেআইটিআই হল কেরলের শিক্ষা দফতরের প্রথম ‘স্পেশ্যাল পারপাস ভেহিক্যল’, যার ঘাড়ে ন্যস্ত ছিল বড় কাজের বোঝা। কেআইটিআই—এর মূল লক্ষ্য ছিল রাজে্যর15,000—এরও বেশি সরকারি এবং সরকারি অর্থে পরিচালিত স্কুলগুলিতে আইসিটি—ভিত্তিক কর্মকাণ্ডের বিন্যাস করা, গড়ে তোলা এবং সংস্কার করা। কেআইটিই এছাড়াও প্রথম এসপিভি—ও হয়েছিল, যা কেরল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বোর্ডের (কেআইআইএফবি) অর্থে পরিচালিত হত। কেআইটিই ‘পাবলিক এডুকেশন রেজুভিনেশন মিশন’—কেও পরিচালিত করত একাধিক বিশেষ বিশেষ উদে্যাগের মাধ্যমে যেমন ‘সমগ্র কনটেন্ট পোর্টাল’, ‘সম্পূর্ণ স্কুল ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার’ এবং ‘স্কুলউইকি’, যা 15,000 স্কুলকে সংযুক্ত করত জোটবদ্ধ ‘কনটেন্ট ডেভলপমেন্ট প্রসেস’ তৈরি করার জন্য। কেআইটিই এছাড়াও চালু করেছিল ‘ভিকটার্স’ চ্যানেল, দেশের মধে্য প্রথম সম্পূর্ণ শিক্ষামূলক চ্যানেল, যা খুবই কাজে এসেছে কোভিড লকডাউনের জেরে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই যখন অনলাইনে বদলে গিয়েছিল।

কেআইটিই—র চালু করা একটি বিশেষ প্রকল্প হল ‘লিটল কেআইটিই’স আইটি ক্লাবস’। এতে পঁাচটি পৃথক বিভাগ যেমন অ্যানিমেশন, সাইবার সেফটি, হার্ডওয়্যার, ইলেকট্রনিক্স, মালয়ালম কম্পিউটিং, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং রোবোটিক্সে, 1 লাখেরও বেশি পড়ুয়াকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কেআইটিই—র আইসিটি উদে্যাগের মাধ্যমে প্রতি বছর 1.5 লাখেরও বেশি শিক্ষক—শিক্ষিকা এবং 50 লাখেরও বেশি পড়ুয়া উপকৃত হয়।

  • লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ গুরুত্ব

এই শিক্ষার পুনরুজ্জীবন অভিযানের অঙ্গ হিসাবে স্কুলপড়ুয়াদের মধে্য লিঙ্গগত সাম্যের পাঠ পড়াতে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান চালু করা হয়েছিল। ‘গেট আপ’ নামে মেয়েদের ক্ষমতায়নের প্রশিক্ষণ উদে্যাগের লক্ষ্য ছিল আপার প্রাইমারি, সেকেন্ডারি এবং হায়ার সেকেন্ডারি স্তরে ছাত্রীদের সার্বিক বিকাশের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। স্পেশ্যাল গার্লস ক্লাব এই সমস্ত স্কুলগুলিতে তৈরি করা হয়েছিল যাতে শিশুদের গ্রুপ ডিসকাশান, বিতর্ক এবং অন্যান্য নানা ধরনের কার্যকলাপের অর্ন্তভুক্ত করা যায়। এর উদ্দেশ্য ছিল, লিঙ্গ নির্বিশেষে স্কুলের কার্যকলাপের মধে্য শিক্ষাগত যতটুকু ফারাক তৈরি হয়, তা মিটানো। তাছাড়াও ছাত্রীদের, লিঙ্গ—সাম্যতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেও উৎসাহ দেওয়া হত।

  • স্থানীয় স্কুল, স্থানীয় যোগদান

স্থানীয় জনগণও যে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গ, তা বোঝাতে তাদের যোগদানভিত্তিক শিক্ষার বন্দোবস্ত করা ছিল সঠিক দিকেই এক কদম এগিয়ে যাওয়া। ‘পাবলিক—পাবলিক’ অংশীদারিত্বের মতো অভিনব একটি ধারণা ফলপ্রসূ করার মাধ্যমে কেরালা ‘পাবলিক—প্রাইভেট’ অংশীদারিত্বের ধারণাকে নতুনভাবে তুলে ধরেছিল। এই ক্ষেত্রে প্রথম ‘পাবলিক’ ছিল সরকারের তরফে কেআইআইএফবি—র মাধ্যমে স্কুলগুলির বিকাশে তহবিলের নিরবিচ্ছিন্ন যোগান। আর দ্বিতীয় ‘পাবলিক’ হল স্থানীয় মানুষ যারা যথাযথ শিক্ষালাভ নিশ্চিত করতে সক্রিয়ভাবে এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিল। কেআইআইএফবি তহবিল ছাড়া, স্থানীয় পঞ্চায়েত—পৌরসভা এবং জেলা পঞ্চায়েত ছাড়াও সাংসদ—বিধায়ক তহবিল থেকেও অর্থের যোগান এসেছে পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য। স্কুলগুলির আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল ক্লাসরুমের পরিকাঠামো ও প্রযুক্তি—বান্ধব পরিবেশে, যা সার্বিক উৎকৃষ্ট বিকাশ নিশ্চিত করে।

স্থানীয় জনগণ এবং স্কুলের প্রাক্তনীদের অংশগ্রহণকেও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যাতে সরকারি স্কুলগুলির বাহি্যক পরিকাঠামোর উন্নয়ন হয়।

আরও পড়ুন : স্টুডেন্ট আইডি-র অভাবে পড়ুয়াদের স্কুলে ভরতি নিতে অস্বীকার করা যাবে না, নির্দেশিকা

  • নিজের পছন্দের ভাষা

সরকারি স্কুলগুলিতে ইংরেজি ভাষাশিক্ষার নিম্ন মান ছিল কেরলে অধিকাংশ পড়ুয়ার সরকারি স্কুল ছেড়ে চলে আসার অন্যতম কারণ। পুনরুজ্জীবন কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে সরকার একই চত্বরে দুই মাধ্যমের স্কুলই চালু করল এবং পড়ুয়াদের কাছে বিকল্প রাখল, তারা বেছে নিক, কে কোন ভাষায় পড়তে চায়। সেই কারণেই কেরালার বেশিরভাগ সরকারি স্কুলেই, ইংরেজি ও মালায়লম, দুই মাধ্যমই রয়েছে এবং দু’টি ক্ষেত্রেই পড়ুয়াদের উৎসাহ হয়েছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অর্ন্তভুক্তির ফলে মালয়ালম মাধ্যম স্কুলগুলিতে ইংরেজি শিক্ষার উৎকর্ষও বহুগুণ বেড়েছে। সিলেবাস ও পাঠ্যসূচিতে আনা সক্রিয় পরিবর্তনের জেরেই সরকারি স্কুলের পড়ুয়ারা বর্তমানে বিশ্বের যে কোনও স্কুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বসার যোগ্য।

  • আমরা আমাদের পড়ুয়াদের যত্ন নিই

সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় নাম লেখানো পড়ুয়াদের জন্য কল্যাণমূলক শিক্ষাব্যবস্থার ধারণায় কেরালা সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, আর্থিক পরিস্থিতি নির্বিশেষে সমস্ত পড়ুয়াদের জন্য ইউনিফর্ম বিনামূলে্য দেওয়া হয়েছে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রী এবং তফশিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত পড়ুয়াদের জন্য ইউনিফর্ম বিনামূলে্য দেওয়া হয়। কেরালা সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের হ্যান্ডলুমের তৈরি ইউনিফর্ম দেবে আর এইভাবে ওই রুগ্ন শিল্পকেও তারা পুনরুজ্জীবিত করেছে।

আরও পড়ুন : দলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ 'অসম্মানিত, অপমানিত' তৃণমূলপন্থী শিক্ষকদের

ইউনিফর্ম ছাড়াও পুষ্টিকর খাদ্য কর্মসূচির আওতায়, স্কুলগুলিতে দুধ এবং ডিম দেওয়া হচ্ছে বিনামূলে্য দেওয়া দুপুরের সম্পূর্ণ সুষম পথে্যর সঙ্গে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত পড়ুয়াদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিনামূলে্য। শিশুদের উপর যাতে ভারী ব্যাগের বোঝা এসে না পড়ে, তার জন্য পাঠ্যপুস্তকগুলিকে খণ্ডে খণ্ডে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। স্কুল খোলার অনেক আগেই পড়ুয়াদের কাছে বই পেঁৗছে দেওয়া হচ্ছে।

এখন কেরালার সরকারি স্কুলগুলি কোনও আন্তর্জাতিক স্কুলের সঙ্গে পরিকাঠামোগত সুযোগসুবিধা বা শিক্ষার গুণমানে রীতিমতো পাল্লা দিতে পারে। প্রতি বছর সরকারি স্কুলগুলিতে যে হারে পড়ুয়াদের সমাগম হচ্ছে, তাই হল প্রমাণ, যে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় কেরালা ঠিক কতটা উন্নতি করতে পেরেছে।

1995 সালের আগে কেরলে হাজার হাজার এমন সরকারি স্কুলশিক্ষক ছিলেন, যাদের রাতের ঘুম ভেঙে যেত চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে। বেশিরভাগ সময়েই স্কুলে, পড়ুয়াদের ধরে রাখার তাদের মরিয়া প্রচেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হত, কারণ অভিভাবকরা তাদের আশেপাশে নিত্যনতুন গজিয়ে ওঠা, চটকদার, সু—পরিচালিত বেসরকারি স্কুলগুলিতে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করার পিছনেই দৌড়তেন। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি তাদের উপার্জিত সমস্ত অর্থ নিংড়ে নিয়ে সেই সব স্কুলের মহার্ঘ বেতন এবং ক্যাপিটেশন দিতেন, যাতে তাদের সন্তানরা স্কুলে থাকতে পারে। সেইসময় জনশিক্ষাব্যবস্থায় বিভাগ ছঁাটাই এবং চাকরি ছঁাটাই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। শিক্ষক—শিক্ষিকারা বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন যাতে শিশুদের মনে আগ্রহ সৃষ্টি করে, তাদের সরকারি স্কুলে পড়ানোর জন্য রাজি করাতে পারেন। তাদের এই প্রচেষ্টার ফলে যদিও সরকারি স্কুলগুলিতে পাসের শতকরা হার বাড়ত, তবুও সরকারি স্কুল থেকে বেসরকারি স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের চলে যাওয়ার ধারা ছিল অব্যাহত।

যখন সব উপায়ই ব্যর্থ মনে হল, তখন কেরলের সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা 2016 সাল থেকে এমন পুনরুজ্জীবনের দৃষ্টান্ত মেনে চলতে লাগল, যা এককথায় অতুলনীয়। আর মাত্র সাড়ে চার বছরের মধে্য নীতি আয়োগের ‘স্টেট এডুকেশন কোয়ালিটি ইনডেক্স রিপোর্ট2019’, কেরলের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে দেশের সেরা বলে অভিহিত করল।

  • সরকার কী করেছিল?

2016সালে শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক সি রবীন্দ্রনাথ একটি বিশেষ মিশন ‘পাবলিক মিশন রিজুভিনেশন মিশন’ চালু করেছিলেন। এর মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে, সকলের জন্য উৎকৃষ্ট শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং কেরলকে প্রান্তিকতা—মুক্ত করা। আর গত সাড়ে চার বছরে এই প্রক্রিয়ায় যে ফল মিলেছে, তা বিস্ময়কর।

এই মিশনের সূচনার সঙ্গেই সরকারের তরফে আরও কিছু প্রকল্প শুরু হয়েছিল। যেমন আইটি@স্কুল প্রকল্প, যা শুরু হয়েছিল 2001—02 সালে। তবে ফের একে চালু করা হয় কেরল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড টেকনোলজি ফর এডুকেশন (কেআইটিআই) নামে। কেআইটিআই হল কেরলের শিক্ষা দফতরের প্রথম ‘স্পেশ্যাল পারপাস ভেহিক্যল’, যার ঘাড়ে ন্যস্ত ছিল বড় কাজের বোঝা। কেআইটিআই—এর মূল লক্ষ্য ছিল রাজে্যর15,000—এরও বেশি সরকারি এবং সরকারি অর্থে পরিচালিত স্কুলগুলিতে আইসিটি—ভিত্তিক কর্মকাণ্ডের বিন্যাস করা, গড়ে তোলা এবং সংস্কার করা। কেআইটিই এছাড়াও প্রথম এসপিভি—ও হয়েছিল, যা কেরল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বোর্ডের (কেআইআইএফবি) অর্থে পরিচালিত হত। কেআইটিই ‘পাবলিক এডুকেশন রেজুভিনেশন মিশন’—কেও পরিচালিত করত একাধিক বিশেষ বিশেষ উদে্যাগের মাধ্যমে যেমন ‘সমগ্র কনটেন্ট পোর্টাল’, ‘সম্পূর্ণ স্কুল ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার’ এবং ‘স্কুলউইকি’, যা 15,000 স্কুলকে সংযুক্ত করত জোটবদ্ধ ‘কনটেন্ট ডেভলপমেন্ট প্রসেস’ তৈরি করার জন্য। কেআইটিই এছাড়াও চালু করেছিল ‘ভিকটার্স’ চ্যানেল, দেশের মধে্য প্রথম সম্পূর্ণ শিক্ষামূলক চ্যানেল, যা খুবই কাজে এসেছে কোভিড লকডাউনের জেরে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই যখন অনলাইনে বদলে গিয়েছিল।

কেআইটিই—র চালু করা একটি বিশেষ প্রকল্প হল ‘লিটল কেআইটিই’স আইটি ক্লাবস’। এতে পঁাচটি পৃথক বিভাগ যেমন অ্যানিমেশন, সাইবার সেফটি, হার্ডওয়্যার, ইলেকট্রনিক্স, মালয়ালম কম্পিউটিং, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং রোবোটিক্সে, 1 লাখেরও বেশি পড়ুয়াকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কেআইটিই—র আইসিটি উদে্যাগের মাধ্যমে প্রতি বছর 1.5 লাখেরও বেশি শিক্ষক—শিক্ষিকা এবং 50 লাখেরও বেশি পড়ুয়া উপকৃত হয়।

  • লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ গুরুত্ব

এই শিক্ষার পুনরুজ্জীবন অভিযানের অঙ্গ হিসাবে স্কুলপড়ুয়াদের মধে্য লিঙ্গগত সাম্যের পাঠ পড়াতে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান চালু করা হয়েছিল। ‘গেট আপ’ নামে মেয়েদের ক্ষমতায়নের প্রশিক্ষণ উদে্যাগের লক্ষ্য ছিল আপার প্রাইমারি, সেকেন্ডারি এবং হায়ার সেকেন্ডারি স্তরে ছাত্রীদের সার্বিক বিকাশের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। স্পেশ্যাল গার্লস ক্লাব এই সমস্ত স্কুলগুলিতে তৈরি করা হয়েছিল যাতে শিশুদের গ্রুপ ডিসকাশান, বিতর্ক এবং অন্যান্য নানা ধরনের কার্যকলাপের অর্ন্তভুক্ত করা যায়। এর উদ্দেশ্য ছিল, লিঙ্গ নির্বিশেষে স্কুলের কার্যকলাপের মধে্য শিক্ষাগত যতটুকু ফারাক তৈরি হয়, তা মিটানো। তাছাড়াও ছাত্রীদের, লিঙ্গ—সাম্যতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেও উৎসাহ দেওয়া হত।

  • স্থানীয় স্কুল, স্থানীয় যোগদান

স্থানীয় জনগণও যে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গ, তা বোঝাতে তাদের যোগদানভিত্তিক শিক্ষার বন্দোবস্ত করা ছিল সঠিক দিকেই এক কদম এগিয়ে যাওয়া। ‘পাবলিক—পাবলিক’ অংশীদারিত্বের মতো অভিনব একটি ধারণা ফলপ্রসূ করার মাধ্যমে কেরালা ‘পাবলিক—প্রাইভেট’ অংশীদারিত্বের ধারণাকে নতুনভাবে তুলে ধরেছিল। এই ক্ষেত্রে প্রথম ‘পাবলিক’ ছিল সরকারের তরফে কেআইআইএফবি—র মাধ্যমে স্কুলগুলির বিকাশে তহবিলের নিরবিচ্ছিন্ন যোগান। আর দ্বিতীয় ‘পাবলিক’ হল স্থানীয় মানুষ যারা যথাযথ শিক্ষালাভ নিশ্চিত করতে সক্রিয়ভাবে এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিল। কেআইআইএফবি তহবিল ছাড়া, স্থানীয় পঞ্চায়েত—পৌরসভা এবং জেলা পঞ্চায়েত ছাড়াও সাংসদ—বিধায়ক তহবিল থেকেও অর্থের যোগান এসেছে পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য। স্কুলগুলির আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল ক্লাসরুমের পরিকাঠামো ও প্রযুক্তি—বান্ধব পরিবেশে, যা সার্বিক উৎকৃষ্ট বিকাশ নিশ্চিত করে।

স্থানীয় জনগণ এবং স্কুলের প্রাক্তনীদের অংশগ্রহণকেও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যাতে সরকারি স্কুলগুলির বাহি্যক পরিকাঠামোর উন্নয়ন হয়।

আরও পড়ুন : স্টুডেন্ট আইডি-র অভাবে পড়ুয়াদের স্কুলে ভরতি নিতে অস্বীকার করা যাবে না, নির্দেশিকা

  • নিজের পছন্দের ভাষা

সরকারি স্কুলগুলিতে ইংরেজি ভাষাশিক্ষার নিম্ন মান ছিল কেরলে অধিকাংশ পড়ুয়ার সরকারি স্কুল ছেড়ে চলে আসার অন্যতম কারণ। পুনরুজ্জীবন কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে সরকার একই চত্বরে দুই মাধ্যমের স্কুলই চালু করল এবং পড়ুয়াদের কাছে বিকল্প রাখল, তারা বেছে নিক, কে কোন ভাষায় পড়তে চায়। সেই কারণেই কেরালার বেশিরভাগ সরকারি স্কুলেই, ইংরেজি ও মালায়লম, দুই মাধ্যমই রয়েছে এবং দু’টি ক্ষেত্রেই পড়ুয়াদের উৎসাহ হয়েছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অর্ন্তভুক্তির ফলে মালয়ালম মাধ্যম স্কুলগুলিতে ইংরেজি শিক্ষার উৎকর্ষও বহুগুণ বেড়েছে। সিলেবাস ও পাঠ্যসূচিতে আনা সক্রিয় পরিবর্তনের জেরেই সরকারি স্কুলের পড়ুয়ারা বর্তমানে বিশ্বের যে কোনও স্কুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বসার যোগ্য।

  • আমরা আমাদের পড়ুয়াদের যত্ন নিই

সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় নাম লেখানো পড়ুয়াদের জন্য কল্যাণমূলক শিক্ষাব্যবস্থার ধারণায় কেরালা সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, আর্থিক পরিস্থিতি নির্বিশেষে সমস্ত পড়ুয়াদের জন্য ইউনিফর্ম বিনামূলে্য দেওয়া হয়েছে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রী এবং তফশিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত পড়ুয়াদের জন্য ইউনিফর্ম বিনামূলে্য দেওয়া হয়। কেরালা সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের হ্যান্ডলুমের তৈরি ইউনিফর্ম দেবে আর এইভাবে ওই রুগ্ন শিল্পকেও তারা পুনরুজ্জীবিত করেছে।

আরও পড়ুন : দলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ 'অসম্মানিত, অপমানিত' তৃণমূলপন্থী শিক্ষকদের

ইউনিফর্ম ছাড়াও পুষ্টিকর খাদ্য কর্মসূচির আওতায়, স্কুলগুলিতে দুধ এবং ডিম দেওয়া হচ্ছে বিনামূলে্য দেওয়া দুপুরের সম্পূর্ণ সুষম পথে্যর সঙ্গে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত পড়ুয়াদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিনামূলে্য। শিশুদের উপর যাতে ভারী ব্যাগের বোঝা এসে না পড়ে, তার জন্য পাঠ্যপুস্তকগুলিকে খণ্ডে খণ্ডে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। স্কুল খোলার অনেক আগেই পড়ুয়াদের কাছে বই পেঁৗছে দেওয়া হচ্ছে।

এখন কেরালার সরকারি স্কুলগুলি কোনও আন্তর্জাতিক স্কুলের সঙ্গে পরিকাঠামোগত সুযোগসুবিধা বা শিক্ষার গুণমানে রীতিমতো পাল্লা দিতে পারে। প্রতি বছর সরকারি স্কুলগুলিতে যে হারে পড়ুয়াদের সমাগম হচ্ছে, তাই হল প্রমাণ, যে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় কেরালা ঠিক কতটা উন্নতি করতে পেরেছে।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.