নয়াদিল্লি, 8 সেপ্টেম্বর: গ্রুপ অফ টোয়েন্টি বা জি20-র এবারের শীর্ষ সম্মেলন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর প্রভাব ফেলতে পারে ৷ কারণ, এই গোষ্ঠীর দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এই সম্মেলনে অনুপস্থিত থাকছেন ৷ যাঁদের একজন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ৷ আর দ্বিতীয়জন চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ৷ যদিও জি20 আসলে একটি আন্তঃসরকারি ফোরাম, যা আন্তর্জাতিক আর্থিক স্থিতিশীলতা, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের মতো বৈশ্বিক অর্থনীতি সম্পর্কিত সমস্যাগুলি মোকাবিলা করতেই গঠিত হয়েছে ৷
9-10 সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হবে জি20 শীর্ষ সম্মেলন ৷ সেখানে পুতিন ও জিনপিংয়ের অনুপস্থিতির কারণ অবশ্যই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান গতিশীলতা ও ইউক্রেন যুদ্ধ, যা বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন তৈরি করেছে ৷ বছরের পর বছর ধরে জি20 বিশ্বের নেতৃস্থানীয় অর্থনীতির মধ্যে আলোচনা এবং সহযোগিতার একটি প্ল্যাটফর্ম ছিল । কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের আধিপত্যের উত্থান ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এই আন্তর্জাতিক বন্ধনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে ৷
প্রথমেই উল্লেখ করা যাক রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের অনুপস্থিতির কথা । গত মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে টেলিফোনে কথোপকথনের সময় পুতিন জি20 সম্মেলনে যোগ দেওয়া নিয়ে তাঁর অক্ষমতার কথা জানিয়েছিলেন ৷ একই সঙ্গে জানিয়েছিলেন যে পরিবর্তে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করবেন তাঁর বিদেশমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ।
আরও পড়ুন: দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী-সহ একাধিক মুখ্যমন্ত্রী থাকছেন না জি20'র নৈশভোজে
দুই নেতার মধ্যে টেলিফোনিক কথোপকথনের আগে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছিলেন, ব্যস্ততার কারণে পুতিন এই শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারবেন না ৷ রাশিয়ার যে এখন ইউক্রেনের সঙ্গে সামরিক লড়াই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি ৷ জানিয়েছিলেন, সরাসরি ভ্রমণ এখনই রাশিয়ার এজেন্ডায় নেই ৷
মনোহর পর্রীকর ইনস্টিটিউট অফ ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের অ্যাসোসিয়েট ফেলো স্বাতী রাও-এর মতে, পুতিনের শীর্ষ সম্মেলন এড়িয়ে যাওয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে যে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে রাশিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ৷ ইটিভি ভারতকে তিনি বলেন, "দেখুন, পুতিন গত বছর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি20 সম্মেলনে যোগ দেননি ৷ তিনি গত মাসে জোহানেসবার্গে ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) সম্মেলনেও যোগ দেননি ।"
যদিও পুতিন ব্রিকস সম্মেলনে স্বশরীরে যোগ না দিলেও ভার্চুয়ালি ভাষণ দিয়েছিলেন ৷ দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) স্বাক্ষরকারী দেশ ৷ ওই আদালতে ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য পুতিনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে । ব্রিকস সম্মেলনে স্বশরীরে যোগ না দিয়ে পুতিন দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার বিব্রতকর অবস্থা থেকে বাঁচিয়েছেন । ভারত যদিও আইসিসির স্বাক্ষরকারী নয় । পুতিন যদি নয়াদিল্লিতে জি20 সম্মেলনে যোগ দিতেন, তবে তারা ভারতকে রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর শক্তিশালী অংশীদারিত্ব প্রদর্শনের সুযোগ দিতে পারত ।
আরও পড়ুন: শস্যের ইতিহাস জানাতে জি20 সম্মেলনে আদিবাসী মহিলা কৃষক রাইমতি
স্বাতী রাও বলেন, "আপনাকে এখানে দুই লাইনের মাঝে কী আছে, তা পড়তে হবে৷ এটা আসলে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতাকে তুলে ধরছে ৷" তিনি চলতি বছরের অগস্টে লোহিত সাগরের বন্দর নগরী জেড্ডায় সৌদি আরব আয়োজিত ইউক্রেনের যুদ্ধের উপর আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কথাও উল্লেখ করেন । রাশিয়ার সঙ্গে সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও মস্কোকে ওই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি । তবে ইউক্রেন ছিল । ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল । স্বাতী রাও রাশিয়ার ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ থেকে বেরিয়ে আসার কথা উল্লেখ করে বলেন, "এমনকি যে দেশগুলি সরাসরি যুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হয় না, সেখানেও অস্বস্তির অনুভূতি বাড়ছে ৷"
গত বছরের জুলাই মাসে রাষ্ট্রসংঘ ইউক্রেন, তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে একটি জীবনরক্ষাকারী চুক্তিতে সাহায্য করেছিল, যা ইউক্রেনকে কৃষ্ণ সাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমার মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ টন অত্যাবশ্যকীয় শস্য রফতানি পুনরায় শুরু করতে সক্ষম করেছিল । চুক্তিটি লক্ষ লক্ষ টন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শস্য এবং অন্যান্য খাবার নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে ৷ না হলে তা ইউক্রেনে আটকে থাকবে । ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে আফ্রিকায় নিম্ন-আয়ের দেশগুলিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শস্য সরবরাহ করে এবং খাদ্যের দাম কমিয়ে আনার মাধ্যমে অভাবী মানুষকে সাহায্য করে ।
এই বছরের জুলাই মাসে রাশিয়া ঘোষণা করেছিল যে তারা আর কৃষ্ণ সাগরের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচলের সুরক্ষার গ্যারান্টি দেবে না । ক্রিমিয়ান উপদ্বীপের সঙ্গে রাশিয়ার সংযোগকারী কার্শ সেতুতে বিস্ফোরণের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে । ক্রুদ্ধ পুতিন জানিয়েছেন যে বেশ কয়েক বছরের পুরনো ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ তাঁর দেশের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর ।
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় রাশিয়া-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনের সময়, আফ্রিকান দেশগুলির নেতারা শস্য চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য পুতিনকে অনুরোধ করেছিলেন । পুতিন এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে তাঁর দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এটা করা যাবে না এবং পরিবর্তে বিনামূল্যে খাদ্যশস্যের প্রস্তাব দেন তিনি । আফ্রিকানরা এই উপহার গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এবং পরিবর্তে চুক্তির পুনরুজ্জীবনের উপর জোর দেয় । রাও বলেন, "ইউক্রেনের যুদ্ধে তার ভুল হিসেবের কারণে রাশিয়া সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৷"
আরও পড়ুন: তৈরি ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সংস্কৃতি করিডোর, জি20 অতিথিদের জন্য ভারত মণ্ডপমে স্পেশাল জোন
এদিকে, চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও জি20 শীর্ষ সম্মেলন এড়িয়ে যাওয়া অনেকের কাছেই বিস্ময়কর । চিনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার কারণে ওই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণেই জিনপিং এই সম্মেলন এড়িয়ে গিয়েছেন বলে খবর ৷ তাঁর পরিবর্তে শীর্ষ সম্মেলনে চিনের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য পাঠানো হয়েছে ওই দেশের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংকে ৷
গত মাসে চিন একটি নতুন ‘মানচিত্র’ প্রকাশ করে ৷ সেখানে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চিন এবং দক্ষিণ চিন সাগরের বিতর্কিত এলাকাগুলিকে তার ভূখণ্ডের অংশ হিসাবে দেখিয়েছিল । এতে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম এবং তাইওয়ান থেকে তীব্র প্রতিবাদ করেছে । তার পরই জানা যায় যে জিনপিং এবার থাকছেন না জি20 শীর্ষ সম্মেলনে ৷
স্বাতী রাও জানান, চিন এখন জি20 এর গুরুত্ব হ্রাস করতে চাইবে ৷ কারণ, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বেজিংয়ের প্রতিপক্ষ রয়েছে । যদিও চিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনার জন্য কোনও প্রবণতা দেখাচ্ছে না ৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের তাইওয়ান ও মানবাধিকার ইস্যুতে বেজিংয়ের সঙ্গে সমস্যা রয়েছে । এই বছরের শুরুতে ইতালি চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) থেকে বেরিয়ে আসে । ফ্রান্সও জাপানের পূর্ব উপকূল থেকে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের প্রভাব ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে ৷
রাও-এর মতে, জিনপিংয়ে জি20 শীর্ষ সম্মেলন এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ব্রিকসের সাম্প্রতিক সম্প্রসারণের কারণেও হতে পারে । জোহানেসবার্গ সম্মেলনের সময়, ছয়টি নতুন দেশ ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ৷ সেই দেশগুলি হল - আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এবং সৌদি আরব । এই সব দেশের সঙ্গে চিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে । চিন যদিও ব্রিকসকে পশ্চিম বিশ্বের আধিপত্য থাকা জি7-এর বিকল্প হিসাবে প্রজেক্ট করতে চায় ৷ কিন্তু ব্রিকস ও জি20-এর সদস্য ভারত এবং ব্রাজিল ওই গোষ্ঠীকে পশ্চিম-বিরোধী হিসাবে দেখাতে চায় না ।
আরও পড়ুন: লোকসঙ্গীত, হস্তশিল্প, বিভিন্ন ধরনের খাবারে জি20-র অতিথিদের অভ্যর্থনা দিল্লিতে
স্বাতী রাও আরও বলেন, "চিন মনে করে যে এটি ব্রিকসের সম্প্রসারণের মাধ্যমে যা চেয়েছিল, তা পেয়েছে ৷ তাহলে, জি20 এর গুরুত্ব কি ?" তিনি মনে করেন যে এটা ভালো যে পুতিন এবং জিনপিং নয়াদিল্লিতে শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না । অন্যথায় বেশ কয়েকটি বৈঠক ওয়াকআউট ও প্রতিবাদ দ্বারা চিহ্নিত করা হত ।
এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লি শীর্ষ সম্মেলনের শেষে যৌথ বিবৃতিতে আমরা কী আশা করতে পারি ? স্বাতী রাও বলেন, "আমার মতে, কোনও যৌথ বিবৃতি হবে না ৷" তাঁর ব্যাখ্যা, অনেক দেশ ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধের অন্তর্ভুক্তি চাইবে, যা অন্যান্য দেশ বিরোধিতা করবে । স্বাতী রাও আরও বলেন, "পরিবর্তে, ভারতের উচিত জলবায়ু পরিবর্তন, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের মতো বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচিতে ফোকাস করা এবং এটি প্রদানের চেষ্টা করা উচিত ৷"