জলপাইগুড়ি, 9 অক্টোবর: "রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে ।" কবি সুকান্তের বিখ্যাত এই কবিতার সঙ্গে আজকের এই রানারের গল্পের একাধিক মিল রয়েছে ৷ একদিকে, আস্ত এক পোস্ট অফিসের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে ৷ অন্যদিকে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁকেই পৌঁছে দিতে হয় চিঠি ৷ তবে এই 'রানার' একজন মহিলা ৷ নাম শ্রীজনা থাপা ৷
124 বছর ধরে ডাক পরিষেবায় বক্সাদুয়ার পোস্ট অফিস:
'ডিজিটাল ইন্ডিয়া'র যুগে, ইমেল-মেসেজের যুগে আজও বক্সা পাহাড় অঞ্চলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডাক পৌঁছে দেন শ্রীজনা ৷ প্রতিদিন রাতে ঘণ্টা না বাজলেও, দিনের বেলায় আজও ডাক নিয়ে ছুটে চলেছেন বর্তমান যুগের এই রানার ৷ তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও কর্মচারীর অভাবে আজ বন্ধ হতে চলেছে ব্রিটিশ আমলের এই ঐতিহ্যবাহী পোস্ট অফিস ৷ 124 বছর ধরে ডাক পরিষেবা দিয়ে আসছে বক্সাদুয়ার পোস্ট অফিস । সেখানে গেলে ব্রিটিশ আমলের বাটখারা-সহ বাকি জিনিসপত্র আজও চোখে পড়বে । তবে ব্রিটিশ আমলের সেই জৌলুস হারিয়ে গিয়েছে ৷
বক্সাদুয়ার ডাকঘর (ইটিভি ভারত)
নেই বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট সংযোগ:
বিদ্যুৎ সংযোগ নেই ৷ কাজের গতি আনতে বাকি পোস্ট অফিসগুলির মতো ঐতিহ্যবাহী এই পোস্ট অফিসে ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷ কিন্তু, উঁচু পাহাড়ে নেটওয়ার্ক না পাওয়ায় সেই পরিষেবাও অকেজ হয়ে পড়ে রয়েছে ৷ ফলে বিপাকে পড়েছেন পোস্ট মাস্টার ও তাঁর গ্রাহকরা ৷ জরুরী ভিত্তিতে টাকা দরকার হলেই বিপত্তি । টাকা তুলতে পাহাড় থেকে নিচে নেমে ইন্টারনেট সংযোগ থাকা পোস্ট অফিসে আসতে হয় গ্রাহকদের । শুধু তাই নয়, টাকা তোলা কিংবা জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজাভাতখাওয়া পোস্ট অফিসে আসতে হয় তাঁদের ৷
ব্রিটিশ জামানার স্ট্যাম্প (নিজস্ব চিত্র)
11 গ্রামে প্রতিনিয়ত চিঠি পৌঁছয় বক্সাদুয়ার পোস্ট অফিস:
আলিপুরদুয়ার জেলার রাজাভাতখাওয়া পোস্ট অফিস থেকে সপ্তাহে 3 দিন, মঙ্গলবার বৃহস্পতিবার ও শনিবার ডাক নিয়ে যান পোস্টমাষ্টার শ্রীজনা ৷ সেখান থেকে সকালে ডাক নিয়ে সানতালাবাড়ি পর্যন্ত বাসে বা স্কুটিতে যান তিনি ৷ সেখান থেকে আঠাস বস্তি এলাকা ৷ তারপর পায়ে হেঁটে পাহাড়ি পথে 3 কিলোমিটার অতিক্রম করে বক্সা পোষ্ট অফিস পৌঁছন শ্রীজনা । এরপর বক্সা পাহাড়ের সদর বাজার, লেপচাখা, 28 বস্তি, 29 বস্তি, আদমা, চুনাভাটি, সান্তালাবাড়ি, টাসিগাও, বক্সা ফোর্ট, ডারাগাও, খাটালিং, ফুলবাড়ির মতো 11টি গ্রামে গিয়ে প্রতিনিয়ত ডাক পৌঁছে দিতে হয় তাঁকে ৷ বিশ্বায়নের যুগে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজও নিজের ভঙ্গিমায় সাবলিল মহিলা এই পোস্টমাষ্টার ।
ব্রিটিশ জামানার পোস্টাল সামগ্রি (নিজস্ব চিত্র)
বক্সার সঙ্গে ডুয়ার্সের ডাক-যোগাযোগ রক্ষা:
1942 সালে বক্সার এই পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে ডুয়ার্সের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত ব্রিটিশরা । 77 বছর আগে চলে এই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে ব্রিটেশরা ৷ কিন্তু, বক্সা দুয়ারের এই পোস্ট অফিস আজও সাধারণ মানুষদের পরিষেবা দিয়ে চলেছে এই ডাকঘর ৷ সেই সঙ্গে, রানারের উপর সেই সময়ের নির্ভরতার বিষয়টিও থেকে গিয়েছে আজও ৷ অস্থায়ী ভাবে একজন 'রানার' রয়েছেন ৷ কিন্তু, পোস্ট অফিসের বেশিরভাগ কাজ অফলাইনে হওয়ায় গুরুদায়িত্ব সামলাতে হয় শ্রীজনাকেই ৷
ব্রিটিশ যুগের বাটখারা (নিজস্ব চিত্র)
দুই অস্থায়ী রানারের ভরসায় 11 গ্রাম:
দশ বছর আগে ডাক বিভাগের স্থায়ী কর্মী বক্সার বাসিন্দা ছিরিং ভুটিয়া পোস্টম্যান তথা রানারের কাজটি করতেন ৷ তাঁর মৃত্যুতে ছেলে পাশাং ভুটিয়া অস্থায়ী রানার হিসাবে কাজটি করতেন ৷ কিন্তু তাঁকে স্থায়ী করার দাবি ওঠায় পাশাংকে বাদ দিয়ে অস্থায়ী ভাবে শঙ্কর মণ্ডলকে রানারের দায়িত্ব দেওয়া হয় ৷ তিনি ছেড়ে দেওয়ার পর এখন রাজাভাতখাওয়ার শিবু দাস কাজটি করেন ৷ তবে সপ্তাহে 3 দিন ৷ তাই অগত্যা বাকি দিনগুলির দায়িত্ব সামলাতে হয় শ্রীজনাকে ৷
পোস্টমাস্টার ও রানারের কাজ একাই সামলান শ্রীজনা (নিজস্ব চিত্র)
বক্সাদুয়ার ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসের এই পোষ্টমাস্টার বলেন, "খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পোষ্ট অফিসটি চলছে । আমাদের সমস্ত পোস্ট অফিস অনলাইন হয়ে গিয়েছে । অফলাইনে কোন কাজ হচ্ছে না । ফলে টাকা তোলা কিংবা জমা দেওয়ার কাজ বক্সাদুয়ার পোস্ট অফিস থেকে হয় না ।একজন অস্থায়ী রানার থাকলেও আমাকে রানারের কাজ ও পোষ্টমাষ্টারির দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে ৷ এইভাবে চলতে থাকলে এই পোষ্ট অফিস বন্ধও হয়ে যেতে পারে ।"
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ডাক পৌঁছে দেন রানার শ্রীজনা (নিজস্ব চিত্র)
তিনি আরও বলেন, "বক্সা পাহাড়ে আমার জন্ম ৷ তাই কষ্ট হলেও আসতে হয় । প্রতিদিন 6 কিলোমিটার ট্রেকিং করেই আসতে হয় । অস্থায়ী পোস্টম্যানকেও সপ্তাহে 3 দিন 5 কিলোমিটার পাহাড়ি পথে হেঁটে আসতে হয় । পাহাড়ের 11টি গ্রামে চিঠি পৌঁছানোটাও বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় ।" বক্সাদুয়ারের স্থানীয় বাসিন্দা অরূন থাপা জানান, এই পোস্ট অফিসটি ব্রিটিশ আমলে তৈরী । আগে অফলাইনে সব সুবিধা পাওয়া যেত । কিন্তু অনলাইন হয়ে যাওয়ার পর টাকা জমা কিংবা তোলার ক্ষেত্রে বেশ সমস্যা হচ্ছে ৷