কলকাতা, 21 ফেব্রুয়ারি: নদী ঘাটের অ্যাম্বাস্যাডর ৷ সোজা বাংলায় বললে নদীর ঘাটগুলির দূত ৷ আর দূত তাঁরাই হবেন, এই ঘাটগুলিই যাঁদের বাড়িঘর, রুটিরুজি ৷ অর্থাৎ হকার, নাপিত ও ঝাড়ুদাররা ৷ শুনতে অবাক লাগলেও এমনই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বেসরকারি সংস্থার তরফে । এই উদ্যোগ সফল হলে বাঁচবে বহু প্রাণ, উন্মোচিত হবে নদী ঘাটের ইতিহাস ৷
সকাল থেকে রাত, এঁদের কেউ নদীর ঘাটে চা, ঝালমুড়ি ফেরি করেন ৷ কেউ আবার ক্ষৌরকর্ম করেন ৷ কেউ করেন সাফাইয়ের কাজ ৷ বছরের পর বছর নদীর ঘাটগুলিই যেন তাঁদের ঘর-সংসার ৷ সারাদিনে সেখানকার নানা ঘটনার সাক্ষী থাকেন তাঁরা । দীর্ঘদিন ধরে এই ঘাটগুলিতে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকায় ঘাটের পরিবর্তনকেও তাঁরা নিত্যদিন চাক্ষুস করছেন । এসব কারণেই আহিরিটোলা ঘাট থেকে বাগবাজার মায়ের ঘাট পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ঘাটের অ্যাম্বাস্যাডার করা হয়েছে সেখানে কর্মরত হকার, নাপিত ও ঝাড়ুদারদের ।
তাঁদের ক্লাস নেওয়া হচ্ছে । তাঁদের মুখ থেকে গল্প শুনে, তাঁদেরই বলা হচ্ছে ঘাটের শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস । বলা হচ্ছে, ঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে । পাশাপাশি সাঁতার জানা হকারদের ডুবন্ত মানুষের জীবনরক্ষার প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে । মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে চাঁপাতলা ঘাটে চা-ঘটি গরম বিক্রেতা, নাপিত মিলিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন 16 জন । এই অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয় 'রিভার অ্যাম্বাস্যাডর'। সকলকে সচিত্র পরিচয় পত্র দেওয়া হয়েছে । তাঁদের কাজের সময়ের মধ্যেই ক্লাস করানো হচ্ছে । প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময়টুকুর জন্য তাঁরা যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হন, সেই কারণে তাঁদের 100 টাকা করে দেওয়া হচ্ছে । এই উদ্যোগে খুশি 'রিভার অ্যাম্বাস্যাডার'রাও ৷
পাঁচ ধাপ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মধ্যে মঙ্গলবার তৃতীয় দফার এক ঘণ্টার এই কর্মশালা আয়োজিত হয় । তাতে, চা, ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের মধ্যে কিরণ সাহা, অভিমন্যু মণ্ডল, শঙ্কর মজুমদার, গোকুল মণ্ডল, রঞ্জিত দাস, প্রদীপ দাস, বালেশ্বর যাদব, নিরঞ্জন কুমার, রাম কুমার ঠাকুর, যোগেন্দ্রকুমার, দীনেশ মাহাতো, মণীশ মল্লিক-সহ মোট 16 জন অংশগ্রহণ করেন ।
হুগলি নদীর তীর বরাবর প্রায় 42টি ঘাট রয়েছে । তারমধ্যে চাঁপাতলা ঘাটে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কর্মসূচি শুরু হলেও উদ্যোক্তাদের দাবি, প্রাথমিক পরিকল্পনা বা কাজ সম্পূর্ণ হলে আগামী দিনে আহিরিটোলা ঘাট থেকে বাগবাজার মায়ের ঘাট পর্যন্ত এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হবে ।
কোন কোন বিষয়ে প্রশিক্ষণ ?
উদ্যোক্তারা জানান, বার্ষিক রিভার ফেস্টিভ্যালের মাধ্যমে চাঁপাতলা ঘাটের সংস্কার করা হবে । এই ঘাটকে দত্তক নিয়ে নানা বিষয়ে প্রচার চালানো হবে । কারণ এখানে শুধু শহর কলকাতার মানুষই নয়, দেশ-বিদেশের বহু মানুষেরা ঘুরতে আসেন । ঘাট পরিষ্কার রাখা থেকে শুরু করে ঘাটের ইতিহাস তুলে ধরাটাও গুরুত্বপূর্ণ । তাই নানা রকম পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে । ইতিমধ্যেই চা বিক্রেতাদের নোংরা ফেলার জন্য বালতি দেওয়া হয়েছে । আর যা শেখানো হচ্ছে 'রিভার অ্যাম্বাস্যাডর'দের সেগুলি হল,
1) 100 জন হকার তথা চা-মুড়ি বিক্রেতাকে ঘাটের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে ঘাট পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব দেওয়া হবে । তাঁরা চা-খাবার বিক্রি করার পাশাপাশি ঘাটের বিভিন্ন জায়গায় ছোট বালতি বা ছোট ডাস্টবিন রাখবেন । সেখানেই ক্রেতাদের কাছে অনুরোধ করবেন, চায়ের কাপ কিংবা খাবারের প্যাকেট বা ঠোঙাগুলো ফেলার জন্য ৷
2) ঘাটের গৌরবময় ইতিহাস তাঁদের জানানো হবে । একইভাবে যাঁরা দীর্ঘদিন এই ঘাটে ব্যবসা করছেন তাঁদের থেকেও অভিজ্ঞতার কথাও শোনা হবে । গৌরবময় ইতিহাস এবং এই সমস্ত হকারদের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে যে তথ্য উঠে আসবে, তা সুন্দর করে পরিবেশন করা হবে । যাতে ঘাটে আগত দর্শনার্থীদের কাছে তাঁরা তা তুলে ধরতে পারেন ।
3) ডুবন্ত মানুষকে বাঁচানোর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে । কারণ বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, নদীতে জোয়ারের সময় ঘাটে আগত অনেকেই সাঁতার না-জানার কারণে ভেসে যান । অনেক ক্ষেত্রে মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন । এই সমস্ত মানুষদের এই ভুল পদক্ষেপ বা বিপদ সবার আগে দেখেন এই ঘাটে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়ানো মানুষেরা । তাই তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, কীভাবে ডুবন্ত মানুষকে বাঁচানো যায় । যে সমস্ত হকাররা সাঁতার জানেন না, তাঁদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে ।
উদ্যোগী সংস্থার কর্ণধারের স্বপ্ন