দত্তপুকুর, 7 ফেব্রুয়ারি: তদন্ত যত এগোচ্ছে, তত রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে দত্তপুকুর-কাণ্ডে ৷ হজরত লস্কর খুনের ঘটনায় এবার পুলিশের জালে নিহতের প্রাক্তন প্রেমিকার বান্ধবী ৷ ধৃত বছর তিরিশের ওই মহিলার বাড়ি উত্তর 24 পরগনার বামনগাছিতে ৷ অন্যদিকে, এই খুনে ধৃত প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে হজরত বিয়ে করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে ৷ যিনি কি না পেশায় যৌনকর্মী ছিলেন ৷
পুলিশ সূত্রে খবর, ধৃত বান্ধবীর বাড়ির দূরত্ব ঘটনাস্থল থেকে মাত্র 200 মিটার ৷ ঘটনার আগের রাতে প্রাক্তন প্রেমিকার বান্ধবীর বামনগাছির বাড়িতেই উঠেছিলেন হজরত লস্কর ৷ অভিযোগ, তার ঠিক পরেই ঘটে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড ৷ তদন্তকারীরা অনুমান করছেন, ধৃত প্রাক্তন প্রেমিকার মাধ্যমেই তাঁর বান্ধবীর বাড়িতে উঠেছিলেন হজরত ৷ তবে, খুনে এই দু’জনের ঠিক কী ভূমিকা ছিল, তা অবশ্য খোলসা করেনি বারাসত জেলা পুলিশ ৷
দত্তপুকুর-কাণ্ডে গ্রেফতার মৃত যুবকের প্রাক্তন প্রেমিকার বান্ধবী ৷ (ইটিভি ভারত) এই বিষয়ে বারাসত পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝাড়খাড়িয়া বলেন, "এক্ষেত্রে ধৃত মহিলা ও তাঁর বান্ধবীর ভূমিকা ঠিক কী ছিল, তা আমরা খতিয়ে দেখছি ৷ তদন্তের স্বার্থে এর থেকে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয় ৷"
দত্তপুকুর-কাণ্ডে প্রথম থেকেই পুলিশের নজরে ছিল নিহত হজরতের পরিচিতরা ৷ সেভাবেই তদন্ত এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন বারাসত জেলা পুলিশের আধিকারিকরা ৷ মুণ্ডহীন দেহ শনাক্ত হওয়ার পরেই তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ঘটনার পর থেকে বেপাত্তা নিহত হজরতের মামাতো ভাই ওবায়দুল গাজি ৷ এরপরই মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করে ওবায়দুলকে বারাসত স্টেশন চত্বর থেকে আটক করে পুলিশ ৷ পরে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে ৷
ওবায়দুলকে জেরা করে খোঁজ মেলে তাঁর স্ত্রীর ৷ তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ওবায়দুলের স্ত্রী’র প্রাক্তন প্রেমিক ছিলেন হজরত লস্কর ৷ এরপর তাঁকেও প্রাক্তন প্রেমিকের খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ ৷ ধৃতদের মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করে তদন্তকারীরা বামনগাছির এই মহিলার নাম জানতে পারেন ৷ তারপরই পুলিশের একটি দল হানা দেয় বামনগাছির বটতলার বাড়িতে ৷ শুক্রবার ভোরে সেখান থেকেই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে ৷
উল্লেখ্য, দত্তপুকুর-কাণ্ডে তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই একাধিক তথ্য উঠে আসছে ৷ তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, বনগাঁর বাসিন্দা ওবায়দুলের স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিয়ের আগে প্রথমে প্রেমের সম্পর্ক হয় হজরতের ৷ জানা যায়, মহিলা কলকাতার সোনাগাছি এলাকার যৌনকর্মী ছিলেন ৷ দু’বছর প্রেম করার পর হজরত নাকি বিয়েও করেছিলেন তাঁকে ৷
দত্তপুকুরে ত্রিকোণ প্রেমের জেরে নিহত যুবক হজরত লস্কর ৷ (ইটিভি ভারত) বিয়ের পর অবশ্য তিনি পুরনো পেশা ছেড়ে দেন ৷ কিন্তু, বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই তাঁদের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয় ৷ অভিযোগ, একবছর আগে ওই মহিলা বিয়ে করেন হজরতের মামাতো ভাই ওবায়দুল গাজিকে ৷ তবে, বিয়ের পরেও তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন প্রাক্তন স্বামী হজরতের সঙ্গে ৷ ফোনে নিয়মিত কথাও হতো দু’জনের ৷ বিষয়টি জেনে গিয়েছিলেন ওবায়দুল ৷ ফলে, হজরতের উপর তাঁর ব্যক্তিগত আক্রোশ তৈরি হয়েছিল ৷ তাই, খুনের পিছনে পরকীয়ার তত্ত্ব ক্রমশ জোরালো হচ্ছে ৷
পুলিশ এ-ও জানতে পেরেছে, ওবায়দুল ও হজরত দু'জনেই একসময় অপরাধমূলক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ৷ মূলত বেলঘরিয়া, বরাহনগর, হাওড়া, উত্তরপাড়ায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি করতেন দু’জনে ৷ কয়েকবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলও খেটেছিলেন ওবায়দুল এবং হজরত ৷ তবে, উত্তরপাড়ার এক পুলিশ আধিকারিকের পরামর্শে অপরাধ ছেড়ে হজরত মূলস্রোতে ফেরার চেষ্টা করছিলেন বলে সূত্রের খবর ৷ পুলিশের চর হিসেবে কাজও শুরু করেন তিনি ৷
জানা গিয়েছে, কোনও একটি অপরাধমূলক কাজের অভিযোগে ওবায়দুলকে খুঁজছিল পুলিশ ৷ সেই সময়ে পুলিশের টিপার হিসেবে ওবায়দুলকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেন হজরত ৷ এরপরে তাঁর উপর ব্যক্তিগত আক্রোশ চরমে পৌঁছয় ওবায়দুলের ৷ সেই আক্রোশ থেকেও হজরতকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা ৷
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গাইঘাটার আঙুলকাটা গ্রামে বাড়ি দু’জনের ৷ এলাকায় তাঁদের আত্মীয় স্বজনরাও থাকেন ৷ তাই সেখানে খুন করার কোনও ঝুঁকি নেয়নি ওবায়দুল ৷ পরিচিত একজনকে দিয়ে ফোন করিয়ে হজরতকে গত 2 ফেব্রুয়ারি রাতে ডেকে আনা হয় দত্তপুকুরে ৷
তারপরের দিন অর্থাৎ, সোমবার সকালে মালিয়াকপুর বাজিতপুর এলাকার চাষের জমি থেকে উদ্ধার হয় যুবকের মুণ্ডুহীন দেহ ৷ হাত-পা বেঁধে দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল ৷ যুবকের যৌনাঙ্গও ক্ষতবিক্ষত ছিল বলে অভিযোগ ৷ সেই সময় তাঁর পরিচয় জানা না গেলেও, পরে ওই যুবকের স্ত্রী ও পরিবারের লোকজন বারাসত হাসপাতালের মর্গে এসে দেহ শনাক্তকরণ করেন ৷ তবে, দেহটি হজরতের কি না, তা জানতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মৃতের ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হবে জানিয়েছে বারাসত জেলা পুলিশ ৷