মালদা, 12 জুন: ওদেরও প্রতিভা ছিল ৷ প্রতিভার বিচ্ছুরণ শুরুও হয়েছিল ৷ কিন্তু পেটের জ্বালার কাছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিভাকে হার মানতে হয়েছে ৷ এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি ৷ রাজ্য ও জাতীয় স্তরের পদক ঘরে সাজিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে পেটের জ্বালা মেটাতে ৷ ওরা আজ পরিযায়ী শ্রমিক ৷ কিন্তু, এখনও ওরা ভুলতে পারেননি মাঠকে ৷ এখনও মাঠ ডাকে তাঁদের ৷ তাই বাড়ি ফিরলেই ফের নিজেদের পেশিগুলো একটু শানিয়ে নেন ৷ মালদার এই পরিযায়ী শ্রমিক অ্যাথলিটরা চাইছেন, সরকার তাঁদের দিকেও একটু মুখ ফেরাক ৷ তাঁদের নেশাকে পেশা করে তুলুক ৷
মালদার অ্যাথলিটরা আজ পরিযায়ী শ্রমিক (ইটিভি ভারত) মালদার বিদ্যুৎ, বিবেক, বিশ্বজিৎ, রিজওয়ানদের প্রতিভা খুব একটা কম ছিল না ৷ সবুজ ঘাসে নিজেদের প্রতিভার প্রমাণ রেখেছেন তাঁরা ৷ যেমন ইংরেজবাজারের ফুলবাড়িয়া পঞ্চায়েতের বিনপাড়া গ্রামের বাসিন্দা 24 বছরের বিদ্যুৎ চৌধুরী ৷ একসময় নঘরিয়া স্কুলে পড়াশোনা করেছেন ৷ ওই স্কুলের শিক্ষক পুলককুমার ঝা’র হাত ধরে মাঠে নেমেছিলেন জ্যাভলিন থ্রোয়ার বিদ্যুৎ ৷
তিনি বলছেন, "ওড়িশায় কাজ করি ৷ প্রথমে শ্রমিকের কাজ করতাম ৷ এখন সেখানেই নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করি ৷ আমি জ্যাভেলিন থ্রোয়ার ৷ 2014 সালে হাতে জ্যাভলিন তুলে নিয়েছিলাম ৷ 2020 সাল পর্যন্ত খেলাধুলো করেছি ৷ খেলতে গিয়ে কনুইয়ে চোট পাই ৷ আর্থিক সমস্যায় চিকিৎসাও করাতে পারিনি ৷ পেট চালাতে ভিনরাজ্যে কাজে যেতে বাধ্য হই ৷ তবে মাঠ এখনও আমাকে ডাকে ৷ সামনেই স্টেট মিট ৷ তাই ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছি ৷ স্টেট মিটে অংশগ্রহণ করার ইচ্ছে রয়েছে ৷ জ্যাভেলিন থ্রোয়ে আমি আটবার স্টেট চ্যাম্পিয়ন হয়েছি ৷ স্কুলভিত্তিক প্রতিযোগিতায় তিনবার ন্যাশনালও খেলেছি ৷ দু’বার পূর্বাঞ্চল মিটে অংশ নিয়েছি ৷ একবার দ্বিতীয়, একবার তৃতীয় হয়েছি ৷ 2017 সালে 59 মিটারের বেশি থ্রো করে স্টেট লেভেলে আমার রেকর্ডও রয়েছে ৷ কনুইয়ের চিকিৎসাটা করাতে পারলে আমি ফের নিয়মিত মাঠে নামতে পারব ৷ খেলা ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই পারছি না ৷"
বিশ্বজিৎ ঘোষও ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের অ্যাথলিট ৷ হাইজাম্প ও লং জাম্পে রাজ্যস্তরে খেলেছেন 21 বছরের বিশ্বজিৎ ৷ তাঁর বাড়ি ইংরেজবাজারের ফুলবাড়িয়া গ্রামে ৷ এখন পেশায় পরিযায়ী শ্রমিক ৷ খেলার টানে বাড়ি ফিরেছেন মালদায় ৷
বিশ্বজিৎ জানালেন, "খেলতে খুব ভালোবাসি ৷ 2014 সাল থেকে খেলছি ৷ হাই আর লং জাম্পে রাজ্যস্তরেও খেলেছি ৷ স্টেট মিটে পাঁচবার হাই জাম্পে সোনা জিতেছি ৷ ক্লাবের হয়েও বিভিন্ন রাজ্যে খেলেছি ৷ গত বছর ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হয়ে খেলেছিলাম ৷ ইস্টবেঙ্গল ক্লাব থেকেই রাজ্যস্তরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি ৷ তবুও আমাকে ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে হয় ৷ এখানে স্পোর্টসম্যানের কোনও ভবিষ্যৎ নেই ! খেলাধুলোর সহযোগিতায় দেশে পশ্চিমবঙ্গ, রাজ্যে মালদা জেলা সবচেয়ে পিছিয়ে ৷ এখান থেকে বাইরে খেলতে গেলে নিজের খরচেই যেতে হয় ৷ তবু খেলা ছাড়তে পারব না ৷ এবার আমার নজরে ন্যাশনাল ৷ তারই প্রস্তুতি নিতে এক মাস আগে তামিলনাডু থেকে বাড়ি ফিরে এসেছি ৷ আমার ইচ্ছে অনেক ৷ কিন্তু, সহায়তা পাই না ৷ আমার মতো আরও অনেক খেলোয়াড়ের একই দশা ৷ তাদের মধ্যে মধুসূদন, দুলালের নাম খুব মনে পড়ছে ৷ ওরা অনেক দূর যেতে পারত ৷ আজ ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করে পেট ভরাতে হচ্ছে ৷"
কালিয়াচকের রাজনগর গ্রামের 23 বছরের বিবেক মণ্ডল দৌড়বীর ৷ তিনি জানাচ্ছেন, "পরিবারের আর্থিক সমস্যার জন্য স্নাতক পাশ করেই পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয় ৷ ছোট থেকেই মাঠের দিকে ঝোঁক ৷ কিন্তু, পরিবারের অন্ন সংস্থানের জন্য ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে গিয়েছিলাম ৷ ধান লাগানোর মরশুমে বাবাকে সাহায্য করতে বাড়ি ফিরে এসেছি ৷ অবশ্য বাড়ি ফেরার পিছনে খেলার ইচ্ছেও রয়েছে ৷ 100 ও 200 মিটার স্প্রিন্ট করতাম ৷ স্টেট লেভেলে খেলার সময় হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পাই ৷ চিকিৎসা করানোর মতো অর্থ নেই ৷ তাই খেলাটাই প্রায় ছেড়ে দিতে হয় ৷ 2015 থেকে 2021 পর্যন্ত প্রতিদিন মাঠে গিয়েছি ৷ এখন টিম গেমই আমার ভরসা ৷ প্যাসোপ্যালো খেলায় আমি ন্যাশনালেও খেলেছিলাম ৷ এবার দেশের হয়ে খেলার ইচ্ছে আছে ৷ খুব তাড়াতাড়ি শ্যুটিং বলে ভারতীয় দল বাংলাদেশ যাবে ৷ আমি তার ট্রায়ালে অংশ নেব ৷ হাওড়াতে ট্রায়াল হবে ৷"
বিবেক বলছেন, "শুধু আমি নই, আমার মতো অনেক অ্যাথেলিট পেটের দায়ে এখন ভিনরাজ্যের শ্রমিক ৷ যেমন জ্যাভেলিন থ্রোয়ার জামাল আনসারি, স্প্রিন্টার অমিত পাল, কাউল আখতার, এমন অনেকেই আজ পেটের দায়ে ভিনরাজ্যে কাজ করছে ৷ এই জেলায় আমাদের মতো অনেক ছেলে খেলাধুলোয় অনেকদূর এগোতে পারত ৷ কিন্তু, আমরা সঠিক ডায়েট পর্যন্ত করতে পারি না ৷ অভাবে আমাদের স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যায় ৷ একটু সাহায্য পেলে কিন্তু আমাদের আজ এই হাল হত না ৷" সব দেখেশুনে তাই মনে হয় কবিগুরু যথার্থই লিখেছেন, "ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি ৷"