কলকাতা, 10 জানুয়ারি: রাজ্যে জাল পাসপোর্টের রমরমা । এই কাণ্ডে ধৃত মনোজ গুপ্তাকে জেরা করে তদন্তকারীদের হাতে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য ৷ তাঁরা জানতে পেরেছেন যে, ভুয়ো পাসপোর্ট ও ভিসা তৈরি করিয়ে নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইতালি-সহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছেন অনেকেই ৷ তাঁরা কারা ? কী তাঁদের বর্তমান পরিস্থিতি ? এবিষয়ে বিস্তারিত জানতে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসকে এবার চিঠি দিল কলকাতা পুলিশ ৷
2017 থেকে 2024 সাল পর্যন্ত জাল পাসপোর্ট কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত মনোজ গুপ্তা । তাঁকে জেরা করে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন যে, মনোজ গুপ্তার ট্র্যাভেল এজেন্টের অফিসে তল্লাশি চালিয়ে 36টি ভারতীয় পাসপোর্টের ফটোকপি উদ্ধার হয়েছে । সেখান থেকে তদন্তকারীরা জানতে পারেন যে, এই ফটোকপি থেকেই তৈরি হয়েছিল ভিসা । বর্তমানে নকল কাগজপত্র দেখিয়ে নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইতালি, কানাডাতে চলে গিয়েছেন একাধিক ব্যক্তি । এবার অবৈধ কাগজপত্র নিয়ে এই সব দেশে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় এবং বর্তমান পরিস্থিতি জানার জন্য সেই সব দেশের কনস্যুলেটকে চিঠি ধরিয়েছে লালবাজার ।
এই বিষয়ে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান রূপেশ কুমার ইটিভি ভারতকে বলেন, "এই ঘটনায় যা যা করণীয়, আইনের পরিধিতে থেকে সেই সমস্ত কাজকর্ম আমরা করছি । এখনও পর্যন্ত জাল পাসপোর্ট কাণ্ডে আমরা একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছি । এছাড়াও এই ঘটনার যবনিকা পতনের জন্য অন্যান্য এজেন্সির সঙ্গেও কথা বলা হচ্ছে ।"
গোয়েন্দারা এই ঘটনার তদন্তে নেমে জানতে পেরেছেন যে, গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন বাংলাদেশি ব্যক্তিকে ভারতীয় সাজিয়ে প্রায় 121-এরও বেশি পাসপোর্ট তৈরি করা হয়েছে । এর মধ্যে 70টি পাসপোর্ট ইতিমধ্যেই আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে । পুলিশের অনুমান, ওই 70টি পাসপোর্ট বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নামেই ইস্যু করা হয়েছে । এই সব পাসপোর্টের অধিকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এবার লুক আউট নোটিশ জারি করতে চলেছে লালবাজার । এই লুক আউট নোটিশ জারি হলে পাসপোর্টগুলি ভবিষ্যতে আর অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবেন না । এছাড়াও খুবই সহজে তাঁদের চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু করা যাবে ।
এছাড়াও এই ঘটনার তদন্তে নেমে পারিপার্শ্বিক তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে এবং একাধিক ব্যক্তিদের গ্রেফতারের পর তাঁদের জেরা করে প্রাথমিকভাবে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, শেষ 5 বছরে জাল নথি দিয়ে প্রায় 3 হাজার ভারতীয় পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে । বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ভারতে এসে মোটা টাকার বিনিময়ে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করা হয় ।
জাল পাসপোর্ট-কাণ্ডে তদন্তকারীদের হাতে চাঞ্চল্যকর তথ্য (নিজস্ব চিত্র) এছাড়াও সেই পাসপোর্ট ব্যবহার করে অনেকেই ইতিমধ্যে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন । এই পাসপোর্ট চক্রের তদন্তে নজরে রয়েছে রাজ্যের তিনটি জেলা । ভবানী ভবন সূত্রের খবর, দুই 24 পরগনা ও নদিয়ায় এই চক্রের রমরমা । তদন্তকারীদের নজরে এই জেলাগুলির ডাক বিভাগ, পাসপোর্ট সেবা কেন্দ্র এবং ডিআইবি অফিসের উঁচু থেকে নিচুতলার কর্মীরা রয়েছেন ।
পাসপোর্ট কেলেঙ্কারির ঘটনায় কলকাতা পুলিশের পাশাপাশি রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগও তদন্তে নেমেছে । এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, পাসপোর্ট বানানোর নেপথ্যে রয়েছে একাধিক দালাল বা এজেন্ট । এই এজেন্টদের কাজ হল, মূলত মৃত ব্যক্তির রেশন কার্ড নম্বর (বা ব্যবহার না হওয়া রেশন কার্ডের নম্বর) জোগাড় করে রাখা । তার মধ্যে থেকে নিষ্ক্রিয় যে কোনও একটি রেশন কার্ডের নম্বর দিয়ে নাম বদলে যে কোনও একটি স্থানীয় থানায় জিডি করা ।
এক্ষেত্রে থানা কোনও কিছু যাচাই না করে জেনারেল ডায়েরি জমা নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঁচু তলার একাংশের পুলিশ কর্মীদের । থানায় করা জিডি দেখিয়ে চক্রীরা অনায়াসেই নতুন রেশন কার্ডের জন্য আবেদন করছে । কিছু যাচাই না করেই নতুন নামে নিষ্ক্রিয় রেশন কার্ডের নম্বরে নতুন কার্ড ইস্যু হয়ে যাচ্ছে । আর একবার নতুন রেশন কার্ড হাতে এলেই সেই রেশন কার্ড দেখিয়ে করে নেওয়া হচ্ছে ভোটার কার্ড । সেই ভোটার কার্ড পেলেই তা দেখিয়ে তৈরি করে নেওয়া হচ্ছে আধার কার্ড, প্যান কার্ড ইত্যাদি । এর পর সেই ভুয়ো নথি দেখিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করছে অভিযুক্তরা ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক উচ্চ পদস্থ আধিকারিক বলেন, "এর নেপথ্যে যারা কাজ করছে, তাদের ধরা প্রয়োজন । এছাড়াও বিভিন্ন জেলা ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট বড় এজেন্টরাও ।"