কলকাতা, 5 ডিসেম্বর: সুপ্রিম কোর্টের পর এবার কলকাতায় বিচার ভবনে বিচারকের ভর্ৎসনার মুখে পড়লেন নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আইনজীবী ৷ 2022 সালের 23 জুলাই নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ইডি'র হাতে গ্রেফতার হন রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ ৷ সেই সময় তিনি তৃণমূলের মহাসচিবও ছিলেন ৷
ইডি'র মামলাটি চলছিল কলকাতার বিচার ভবনে ৷ পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে শোন অ্যারেস্ট করে সিবিআই ৷ সেই মামলাটি চলছিল আলিপুরে সিবিআই-এর বিশেষ আদালতে ৷ ইডিও আবেদন জানায় যে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে সিবিআই-এর তরফে মামলাটিও বিচার ভবনে হোক ৷
সেই আবেদন মেনে নিয়ে প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে ইডি এবং সিবিআই-এর করা মামলার শুনানি শুরু হয় কলকাতার বিচার ভবনে ৷ আবার পরে ইডি'র মামলাটি চলে যায় অন্য এজলাসে ৷ ফলে সিবিআই-এর তরফেও আবার আদালতে আবেদন করা হয় যে তাদের মামলাটিও ওই একই এজলাসে নিয়ে যাওয়া হোক ৷
বৃহস্পতিবার বিচার ভবনে বিশেষ সিবিআই আদালতে বিচারকের কাছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আইনজীবী জানান, যেহেতু সিবিআইয়ের মামলাটি ইডি'র আর্জি মোতাবেক এখনও অন্য আদালত বা এজলাসে স্থানান্তরিত হয়নি, তাই ওই এক এজলাসেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ওই মামলাটিও যেন শোনা হয় ৷
এরপরেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আইনজীবীকে কলকাতার বিচার ভবনের বিচারক বলেন,"আপনি বেঞ্চ নিয়ে এত ভাবছেন কেন? আপনি শুধু শুধু আদালতের সময় নষ্ট করছেন ৷ কোন আদালতে মামলা থাকবে, সেটা আপনি ঠিক করবেন না ৷" বুধবার সুপ্রিম কোর্টে প্রাক্তন শিক্ষারমন্ত্রীর জামিনের মামলার শুনানিতেও দুই বিচারপতির বেঞ্চ পার্থকে ভর্ৎসনা করে ৷ তাঁকে 'আপাত দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি' বলে উল্লেখ করেন ৷
'এরকম দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে এভাবে জামিন দেওয়া যায় ?', সুপ্রিম ভর্ৎসনার মুখে পার্থ
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার ফের কলকাতা হাইকোর্টে নিয়োগ মামলায় অভিযুক্তদের জামিনের পক্ষে সওয়াল করলেন আইনজীবীরা ৷ তাঁদের যুক্তি, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ অন্যান্যদের দীর্ঘদিন কারাবাসের পরে এখনও নিম্ন আদালতে বিচারপর্ব শুরু হয়নি ৷
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ চারজনের জামিনের আবেদনে সরকারি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়ার অনুমোদন নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠল তৃতীয় বেঞ্চে। বিচারপতি তপব্রত চক্রবর্তী প্রশ্ন তুললেন কেন অনুমতি পাচ্ছে না সিবিআই। অনুমতি না পেলে বিচার প্রক্রিয়াও তো শুরু করা সম্ভব নয় মন্তব্য বিচারপতির।
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি অপূর্ব সিনহা রায়ের ডিভিশন বেঞ্চ তৃতীয় বেঞ্চে নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুবীরেশ ভট্টাচার্য, শান্তি প্রসাদ সিনহা, অশোক কুমার সাহা ও কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ের জামিনের নির্দেশে দ্বিমত পোষণ করায় খারিজ হয়েছিল জামিনের আবেদন ৷ এদিন বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর এজলাসে মামলাটির শুনানি শুরু হয়েছে ৷
এদিন আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও শান্তি প্রসাদ সিনহার পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে বলেন, "পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল অনুমোদন দিয়েছেন কিন্তু বাকি সরকারি আধিকারিকদের ক্ষেত্রে কারও অনুমোদন নেওয়া হয়নি ৷ সুতরাং এই মামলার বিচারপর্ব কবে শুরু হবে কোনও ঠিক নেই ৷ তাই প্রত্যেকে জামিনের আবেদন করছে ৷ প্রত্যেকেই অসুস্থ ও সিনিয়র সিটিজেন ৷"
তিনি সওয়াল করেন, "পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষা দফতরের মন্ত্রী ছিলেন ৷ মন্ত্রীরা সরাসরি দফতরের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন না ৷ তদন্তের নামে এইভাবে দিনের পর দিন আটকে রাখা হলে আর্টিক্যাল 21 (ফান্ডামেন্টাল রাইট) লঙ্ঘিত হয় ৷ এই মামলার প্রথম থেকেই গতি শ্লথ ৷ স্পিডি ট্রায়াল এর প্রয়োজনীয়তা রয়ছে ৷ পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখন কোনও পদে নেই ৷ তাই তাঁর বিরুদ্ধে প্রভাবশালী তকমা দেওয়া ভুল ৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে সরকারি কর্মচারীদের ট্রায়াল-এর অনুমতি সরাসরি হাইকোর্ট দিতে পারে না ৷ আবার সরকারকে অনুমতি দেওয়ার জন্য বলতেও পারে না ৷"
বিচারপতির বক্তব্য, "হাইকোর্ট অনুমতি নাই দিতে পারে, কিন্তু সরকারকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা তো বলতে তো পারে !" সুবীরেশ ভট্টাচার্য ও কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ের তরফে আইনজীবী সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "বিচারপ্রক্রিয়া যদি শুরু হতে দেরি হয়, তাহলে অভিযুক্তকে বছরের পর বছর আটকে রেখে তাঁর সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হয় ৷ দীর্ঘদিন জিজ্ঞাসাবাদ করছে না তদন্তকারী সংস্থা ৷ আবেদনকারীরা 15 মাসের বেশি সময় জেলে রয়েছে ।"
এর আগে ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতি অপূর্ব সিনহা রায় জানিয়েছেন, সুবীরেশ ভট্টাচার্য, কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে সরকার অনুমতি দেয়নি ৷ তাই তাঁদের অনেক বেশি প্রভাবশালী বলে মনে করছে আদালত ৷ তাই তাঁদের জামিনের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল ৷ একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি বিচারপ্রক্রিয়া শুরু না হয় তাহলে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয় ৷ আবেদনকারীরা প্রত্যেকেই সিনিয়র সিটিজেন ।এক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করা উচিত ৷ অভিযুক্তদের মধ্যে কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় এই সংক্রান্ত একটি মামলায় জামিন পেয়েছেন ৷ প্রত্যেকেই শারীরিক ভাবে অসুস্থ ৷ এই মামলায় অন্য চারজন জামিন পেয়েছেন ডিভিশন বেঞ্চে ৷
বিচারপতি তপব্রত চক্রবর্তীর প্রশ্ন, "রাজ্য যদি অনুমতি না দেয় তবে তো বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হতে পারে না । অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী তত্ত্বের কি যুক্তি রয়েছে ? এদের যদি আদালত জামিন দেয় তাহলে সাক্ষী ও তথ্য প্রমাণ লোপাটের আশঙ্কা কি থাকছে না ? যখন, ডিভিশন বেঞ্চে এক বিচারপতি এটাই আশঙ্কা করেছেন ৷ সরকারি অনুমোদনের ব্যাপারে মুখ্যসচিব কেন অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করছে না ?"
অশোক কুমার সাহার আইনজীবী শেখর বসুর জামিনের পক্ষে সওয়াল করে বলেন, "নিম্ন আদালতে চার্জশিট পেশ হয়েছে কিন্তু আদালত এখনও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেনি ৷ তাহলে কীভাবে আটকে রেখেছে তদন্তকারী সংস্থা ? গ্রেফতারির প্রথম থেকেই এই প্রভাবশালী তত্ত্ব দিচ্ছে তদন্তকারী সংস্থা ৷"