কলকাতা, 18 জানুয়ারি: আরজি কর-কাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায় ৷ কিন্তু, শিয়ালদা আদালতের এই রায়ে মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারছে না ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট ৷ রায় ঘোষণার পর, মোট 20 দফা প্রশ্ন তুললেন ফ্রন্টের সদস্য চিকিৎসকরা ৷ সেই প্রশ্নের জবাব চাইলেন তাঁরা ৷ আর তা না-পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তাররা ৷
কোন-কোন প্রশ্ন তুলেছে পশ্চিমবঙ্গ জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট ?
প্রশ্ন 1: অভয়ার ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মাথায় রক্তক্ষরণের উল্লেখ রয়েছে ৷ যা কঠিন সার্ফেসে আঘাতের কারণে হতে পারে ৷ কিন্তু, যদি ম্যাট্রেসে গলা চেপে খুন হয়, তবে মাথার খুলির নীচে রক্তক্ষরণ কীভাবে হয় ? সেমিনার রুমে কোনও ধস্তাধস্তির বা রক্তের চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে সিএফএসএল রিপোর্টে বলা হয়েছে ৷ তাহলে আঘাতটি কোথায় এবং কীসের দ্বারা হয়েছে ? রিপোর্টে দেওয়াল বা অন্য কোথাও কোনও রক্ত বা নমুনার চিহ্ন নেই ৷ তাহলে ঘটনাস্থল আদতে কি সেমিনার রুম ?
অধরা 20টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে জুনিয়র ডাক্তাররা (ইটিভি ভারত) প্রশ্ন 2: অভয়ার মা-বাবাকে আত্মহত্যার কথা নন-মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার ফোনে জানিয়েছিলেন ৷ কেন তিনি আত্মহত্যার কথা বলেছিলেন এবং নন-মেডিক্যাল ব্যক্তি হয়ে সেটা বুঝলেন কীভাবে ? কেউ কি তাঁকে আত্মহত্যার কথা জানাতে বলেছিল ? সিবিআইয়ের চার্জশিটে তাঁর স্টেটমেন্ট কেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি ?
প্রশ্ন 3: অভয়ার বাবা-মাকে সেমিনার রুমে ঢুকতে না-দিয়ে তিন ঘণ্টা বাইরে বসিয়ে রাখা হয়েছিল কেন ? কার নির্দেশে তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি ? ওই সময় সেমিনার রুমে এত বহিরাগত ছিলেন কেন এবং তাঁরা কী করছিলেন ? সেই ঘটনার পরবর্তী সিসিটিভি ফুটেজের কথা চার্জশিটে কেন উল্লেখ নেই ?
জুনিয়র ডাক্তাদের ডাকে শিয়ালদা আদালতের বাইরে 'জনতার জমায়েত' ৷ (নিজস্ব ছবি) প্রশ্ন 4: আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ কেন এফআইআর করেনি ? কেন অভয়ার মা-বাবাকেই এফআইআর করতে হয়েছিল ? মৃতদেহের কাছে তাঁদের ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি ৷ সৎকারে পুলিশের দ্রুততা কেন ? কে বা কারা এই নির্দেশ দিয়েছিলেন ?
প্রশ্ন 5: নির্যাতিতার শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলেও, সঞ্জয় রায়ের নখের স্যাম্পেলে অভয়ার ডিএনএ পাওয়া যায়নি এবং নির্যাতিতার নখের স্যাম্পেলে সঞ্জয় রায়ের ডিএনএ মেলেনি ৷ তাহলে সঞ্জয় রায় একাই অপরাধী হয়, এটা কীভাবে সম্ভব ?
প্রশ্ন 6: নির্যাতিতার চোয়ালের নীচে যে কামড়ের দাগের উল্লেখ আছে ৷ কিন্তু, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে সেখান থেকে লালারসের নুমনা নেওয়া হয়নি কেন? কেন শুধু স্তনবৃন্ত থেকে লালারসের নমুনা নেওয়া হল ? সিএফএসএলের রিপোর্টে স্তনবৃন্ত থেকে নেওয়া লালারসের নমুনায় সঞ্জয় রায় ছাড়াও, আরও ডিএনএ পাওয়া গিয়েছিল ৷ সেই ডিএনএ-র কাদের, সেই খোঁজ কেন করা হচ্ছে না ?
শিয়ালদা আদালতে সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করার পর মিছিল জুনিয়র ডাক্তারদের ৷ (নিজস্ব ছবি) প্রশ্ন 7: চেস্ট মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের সিসিটিভি-তে সঞ্জয় রায় ছাড়া আরও অনেককে দেখা গিয়েছে রাত 2টো 30 মিনিট থেকে ভোর সাড়ে চারটে পর্যন্ত (যা অভয়ার সম্ভাব্য মৃত্যু সময়) ৷ কিন্তু, তাঁদের কাউকেই চিহ্নিত করা হয়নি ৷ সঞ্জয় রায় একমাত্র চিহ্নিত হলেন, অন্যদের চিহ্নিত না-করার কারণ কী ? তদন্তকারীরা কি বাকিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করেননি ?
প্রশ্ন 8: একটা জায়গায় একজন মাত্র খুনি ধর্ষণ করে একজনকে মেরে ফেলল ৷ তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হল, অথচ গোটা ঘরের কোথাও খুনির কোনও হাতের ছাপ, আঙুলের ছাপ মিলল না ! খুনি কি গ্লাভস পরে এসেছিল খুন করার জন্য ? নাকি তদন্তকারীরা আঙুলের ছাপ খোঁজার চেষ্টা করেননি ?
আরজি কর-কাণ্ডের রায় ঘোষণার আগে শিয়ালদা আদালতের বাইরে জনতার ভিড় ৷ (নিজস্ব ছবি) প্রশ্ন 9: অভয়ার মৃতদেহ যে ম্যাট্রেসের ওপর পাওয়া যায়, তার ওপর বিছানো চাদর পরিপাটি করে সাজানো ৷ ল্যাপটপ, ব্যাগ, পাশে রাখা জুতো-সবই খুব গুছিয়ে রাখা ৷ ধর্ষণ, খুনের পর কীভাবে সবকিছু এরকম পরিপাটি ভাবে থাকতে পারে ? তাহলে কি ধর্ষক বা তার সহায়করা চেয়েছিল, এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালাতে ৷ আর তাই সবকিছু এরকম গুছিয়ে রেখে দিয়েছিল ?
প্রশ্ন 10: 9 অগস্ট অটোপসির সময় স্যাম্পেল নেওয়া হলেও, কেন্দ্রীয় ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হল 14 অগস্ট ৷ এত দেরি কেন ? সঞ্জয় রায়কে আটক করা হয় 9 অগস্ট রাতে ৷ কিন্তু, তার রক্তমাখা জামাকাপড় ব্যারাক থেকে নিয়ে আসা হয় 12 অগস্ট ৷ আবার এত দেরি কেন ? এর মাঝে কিছু তথ্যপ্রমাণ পরিবর্তন বা লোপাট হয়নি তো ?
প্রশ্ন 11: চার্জশিট অনুযায়ী সঞ্জয় রায় ভোর 3টে 20-তে আরজি কর হাসপাতালে ঢোকে ৷ তারপর ট্রমা কেয়ার বিল্ডিং যায় 3টে 34 মিনিটে ৷ বেরিয়ে আসে 3টে 36 মিনিটে ৷ এরপর ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের চারতলায় যায় (সেই সময় দেওয়া নেই) ৷ 4টে 3 মিনিটে তাকে চারতলার চেস্ট মেডিসিন ওয়ার্ডের সিসিটিভি-তে দেখা যায় ৷ এর মাঝে প্রায় আধ ঘণ্টা সময় সে কোথায় ছিল ? এই সময় সে কী করছিল ?
প্রশ্ন 12: সঞ্জয় রায়ের ব্লুটুথ ইয়ারফোনের উপর ভিত্তি করে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ৷ চার্জশিটে চেস্ট মেডিসিন ওয়ার্ডের সিসিটিভি-তে সঞ্জয় রায়ের গতিবিধির বর্ণনা দেওয়া আছে ৷ 4টে 3 মিনিটে বলুটুথ ইয়ারফোন গলায় সঞ্জয় ক্যামেরার ডানদিক থেকে ওয়ার্ডের দিকে যায় ৷ 4টে 32 মিনিটে সে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যায় ৷ তখন তার গলায় ইয়ারফোন ছিল না ৷ এর মধ্যে একবার 4টে 31 মিনিটে ওয়ার্ড থেকে তাকে ক্যামেরার দিকে যেতে দেখা যায় এবং আবার ওয়ার্ডে ফিরে যায় সে ৷ উল্লেখযোগ্য ভাবে এই সময় তার গলায় ইয়ারফোনটি ছিল কি না, তা চার্জশিটে উল্লেখ নেই ৷ কেন ?
প্রশ্ন 13: সেন্ট্রাল ফরেন্সিক ল্যাবের রিপোর্টে নির্যাতিতার যৌনাঙ্গ ও পায়ুদ্বারের স্যাম্পেলে অন্য একজনের ডিএনএ পাওয়া গিয়েছে ৷ কে সে ? প্রশ্ন হল, 21 অগস্ট এই তথ্য সিবিআইয়ের হাতে জমা পড়া সত্ত্বেও, তা নিয়ে তদন্তের কোনও অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেল না এবং অন্য মহিলা বা অন্য কেউ জড়িত থাকলে, তাঁদের কোনও খোঁজ সিবিআই এখনও বের করে উঠতে পারল না-কেন ৷ সিবিআই কি তাঁদের খোঁজার চেষ্টা করেছে ?
প্রশ্ন 14: হাসপাতালের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী, কর্মরত ডাক্তার ও নার্সদের কাজের জায়গা পেরিয়ে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের মতো বাইরের লোক কীভাবে এরকম নৃশংস অপরাধ করতে পারে ? স্বাস্থ্যকর্মী যদি তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি অর্থাৎ নিজ কর্মস্থলে সুরক্ষিত না-থাকেন, তাহলে রোগী ও রোগীর পরিজনদের নিরাপত্তা কোথায় ? সরকারি কর্মস্থলে নিরাপত্তা প্রত্যেক কর্মীর নৈতিক অধিকার ৷ এই ঘটনা চরম সরকারি অপরদার্থতার পরিচয় নয় কি ?
প্রশ্ন 15: জাল ওষুধ, স্যালাইন, সরকারি তহবিল নয়-ছয়, ব্যবহৃত ইনজেকশন এবং ওষুধপত্র বাংলাদেশে আমদানি-রফতানি ইত্যাদি নানা দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার সন্দীপ ঘোষ ৷ অথচ তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশের জন্য রাজ্য সরকার এখনও কেন ছাড়পত্র প্রদান করছে না ? এর পিছনে কি কোনও বড় ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে ?
প্রশ্ন 16: ম্যাজিস্ট্রেট ইনকুয়েস্টে অভয়ার ডান হাতের অনামিকায় চোটের উল্লেখ করা হয়েছে ৷ অথচ ময়নাতদন্তে রিপোর্টে এই আঘাতের কোনও উল্লেখ নেই ৷ কেন নেই ?
প্রশ্ন 17: রেনোভেশনের নোটিশ দেখিয়ে সেমিনার রুম সংলগ্ন ঘর ভাঙচুর করা হল ৷ যেই সেমিনার রুমকে মূল ঘটনাস্থল বলে চিহ্নিত করেছিল কলকাতা পুলিশ নিজেই ৷ সিএফএসএলের রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘরের সেই দেওয়ালও ভাঙা হল যেখানে সচল বৈদ্যুতিক তার ছিল ৷ রেনোভেশনের নোটিশে যারই সই থাকুক না-কেন, কলেজের এত-শত বিল্ডিং থাকতে প্রথম ভাঙচুরের কাজ চেস্ট মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের ওই বিবাদিত অংশ থেকেই কেন শুরু করতে হল ৷ আর এত তৎপরতারই বা কারণ কী ছিল ?
প্রশ্ন 18: 14 অগস্ট বহিরাগত দ্বারা আরজি কর হাসপাতালে যে ভাঙচুর চালানো হয়, সেই ঘটনায় যে এক হাজারের কাছাকাছি মানুষ জড়িত, তারা কারা ? কে তাদের সংগঠিত করল ? কেন তারা হাসপাতালে এসে আন্দোলনকারীদের বা সেমিনার রুমের খোঁজ করছিল ? ঘটনার সঙ্গে যোগসূত্র নিয়ে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআইয়ের ভূমিকাই বা কী ?
প্রশ্ন 19: সিবিআইয়ের পেশ করা তথ্য অনুযায়ী অবশ্যই সঞ্জয় রায় দোষী ৷ এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই ৷ তবে অভয়ার পোস্টমর্টেমে দেহের বাইরে ও ভেতরে, চোখে, যৌনাঙ্গে যে একাধিক আঘাতের উল্লেখ আছে, তা কীভাবে একার পক্ষে ওই অল্প সময়ের মধ্যে করা সম্ভব ? সিবিআইয়ের প্রথম চার্জশিটে সন্দীপ ঘোষ আর অভিজিৎ মণ্ডলকে তথ্যপ্রমাণ লোপাটে যুক্ত থাকার কথা বলা হয়েছিল ৷ তাঁদের গ্রেফতারও করেছিল সিবিআই ৷ তবে, কেন দ্রুত সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট প্রকাশ করে তদন্ত প্রক্রিয়া এগোনো যাচ্ছে না ? কেন্দ্র ও রাজ্যের সেটিং তত্ত্ব, যা মিডিয়া বা লোকমহলে চর্চিত তাহলে কি কোথাও সত্যিই বলে ধরে নিতে হবে ?
প্রশ্ন 20: অভয়ার ন্যায় বিচারের দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্যেও কুলতলি, জয়নগরে সংগঠিত হল খুন-ধর্ষণের মতো নৃশংস ঘটনা ৷ পশ্চিমবঙ্গে নারী নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার ৷ কিছু জায়গায় দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করে, ফাঁসির সাজা দিয়ে রাজ্য সরকার অভয়ার বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে সুকৌশলে দায়ী করছে ৷ বিচার প্রক্রিয়ায় এই দ্রুততা, পুলিশ-প্রশাসনের এই উদ্যম কি কেবল আন্দোলনের চাপ পড়লেই আমরা দেখতে পাব ? অপরাধী রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান নয় বলেই কি এত তাড়াতাড়ি তাকে শাস্তি দেওয়া গেল ? অভয়ার ধর্ষণ-খুনের অপরাধীরা ক্ষমতাবান বলেই কি তাঁরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন ? বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে এত বড় গণ আন্দোলনের পরেও আমরা বিচার পাব না-কেন ? দেশের স্বাধীনতার 77 বছর পরেও বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে কেন ?