কলকাতা, 3 জুলাই: বাংলা প্রবাদ, 'আমে দুধে মিশে যায় আঁটি গড়াগড়ি খায়' ৷ কিন্তু, এখানে বিষয়টা একটু আলাদা ৷ আম খান, দুধের সঙ্গে মেশান ৷ কিন্তু, আঁটিকে গড়াগড়ি দিতে দেবেন না ৷ বদলে আম খাওয়ার শেষে আঁটি জমা দিতে বলা হচ্ছে ৷
হ্যাঁ, কারণ ফলের রাজা আমকে ঘিরে পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক যে, তার সিংহাসন এখন টলমল ৷ এই পরিস্থিতির জন্য আম নিজেই দায়ী ৷ অবশ্য বিষয়টি বায়োলজিক্যাল এবং পরিবেশগত ৷ ভাবছেন আম খাব, তা নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে ? কারণ, দিনকালটাই এমন পড়েছে যে ৷ আম খেলেই হবে না ৷ 'আম আদমি'কে এখন আম নিয়ে চিন্তাও করতে হবে ৷
আম গাছের অস্তিত্ব বাঁচাতে আঁটি সংগ্রহ (ইটিভি ভারত) বিষয়টি একটু বিশদে বলা যাক ৷ আম গাছ বড় হতে দশ থেকে বারো বছর লেগে যায় ৷ পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা যাচ্ছে, গত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরে চাষিরা এই দীর্ঘসূত্রিতার জন্য আম গাছ এবং আমের বাগান তৈরিতে আর উৎসাহী নয় ৷ আমের গাছ এমন যা জীববৈচিত্র্যকে সমর্থন করে ৷ পাখিদের বাসা বাঁধা হোক বা বিভিন্ন প্রজাতির পোকা-মাকড়ের প্রিয় বাসস্থান আমগাছ ৷ এইরকম পরম উপকারী একটি গাছকে বাঁচাতে আসরে বাঙুর অ্যাভিনিউয়ের জসমীত সিং আরোরা ৷ যিনি পরিচিত 'ম্যাঙ্গো সিড ম্যান অফ কলকাতা' নামে ৷
শহর কলকাতার বাসিন্দা জসমীত অন্য সব সামাজিক কাজকর্মের মধ্যেই আম গাছ রক্ষায় উঠে পড়ে লেগেছেন ৷ তাঁর ডাকে সাড়া মিলেছে প্রচুর ৷ তাঁর ফোন এখন সকাল থেকে ব্যস্ত থাকে ৷ অধিকাংশ ফোনে একটাই বিষয়, "আম খেয়েছি, এবার আঁটি জমা দিতে চাই।" জসমীত সিং আরোরা বলছেন, "আমরা সারা ভারত থেকে আমের আঁটি সংগ্রহ করছি ৷ আম খেয়ে লোকেরা আমাদের আঁটি পাঠাচ্ছে ৷ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, সব জায়গা থেকে পার্সেল আসছে ৷ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থেকে কলকাতা শহরের সাধারন মানুষও এই উদ্যোগে পাশে রয়েছেন ৷ উৎসাহ দিচ্ছে, আঁটি পাঠাচ্ছে ৷"
যে আঁটিগুলি আসছে, তাতেই থাকছে রকমারি ৷ তিনি বলেন, "শুধু যে একটা প্রজাতির আমের আঁটি পাচ্ছি, তা কিন্তু নয় ৷ মুম্বইয়ের হাপুস আসে, বাংলার হিমসাগর আছে ৷ গোলাপখাস, ল্যাংড়া সবরকমের আঁটি আমাদের কাছে আসছে ৷ সারা ভারতে পাঁচশো রকমের আম আমরা খাই ৷ দেশের আশি শতাংশ জমিতে আম গাছ লাগানো যায় ৷ যে মিক্সড আঁটি আসছে, তার জার্মিনেট করি ৷"
তাঁর কথায়, "আমরা 10 লাখ আমের আঁটি থেকে এক লক্ষ জার্মিনেশন করাতে পারব ৷ যেহেতু বেশিরভাগ আম গাছ এখন প্রচুর পুরানো, তাই জার্মিনেশনের হার কমে গিয়েছে ৷ আমরা তাই গোলাপখাস এবং হিমসাগরের গ্রাফটিং করে যে চারাটি হচ্ছে, তা তিন থেকে চার ফুট হলে বাংলার চাষিদের হাতে তুলে দিচ্ছি ৷ এই গ্রাফটিং প্ল্যান্টগুলি বড় হতে সময় নেবে তিন থেকে চার বছর ৷ এটা সাবেকি গাছের মতো পঞ্চাশ থেকে ষাট ফুট লম্বা হবে না ৷ সাবেকি গাছ ফল দেওয়ার জায়গায় পৌঁছতে দশ থেকে পনেরো বছর নেবে ৷ আর গ্রাফটিং গাছটি তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ফল দেওয়ার জায়গায় পৌঁছবে ৷"
তবে, গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ গাছ তৈরি করতে জমির প্রয়োজন ৷ সেই সঙ্গে কৃষি বিজ্ঞানীদের পরামর্শ জরুরি ৷ এনিয়ে জসমীত সিং আরোরা বলেন, "পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, সুন্দরবন বাদে, এই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় জমিতে আমের আঁটি থেকে চারা বের করি ৷ তারপর তা চাষিদের হাতে বিনা পয়সায় তুলে দিচ্ছি ৷ এই ব্যাপারে আমাদের পরামর্শদাতা রয়েছেন ৷ তাঁরা খড়গপুর আইআইটির বিজ্ঞানী ৷ না হলে চাষি ভাইদের এই চারাগাছগুলির গুণাগুন ও লাভ বোঝাব কী করে ! চাষিরা তো একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিরই পরামর্শ শুনবে ৷"
আম গাছ বাঁচানোর প্রক্রিয়ার পাশাপাশি, পরিবেশ সচেতনার বিষয়টিও জড়িত ৷ এনিয়ে তাঁর বক্তব্য, "আমগাছের প্রয়োজনীয়তা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রয়েছে ৷ এবার বলা হচ্ছে গাছ লাগাও পরিবেশ বাঁচাও ৷ তা কতগুলি গাছ লাগাতে হবে ? তা কেউ বলছে না ৷ পরিসংখ্যান বলছে আমাদের দেশে জন প্রতি গাছ সংখ্যা 28টি ৷ কানাডায় তা 10 হাজার 700টি ৷ পাঁচ কোটি গাছ না লাগাতে পারলে, আমাদের যে পরিবেশের অবক্ষয় ও দূষণ, তা রোধ করা যাবে না ৷ তাই প্রত্যেককে চারশোটি করে গাছ লাগাতে হবে ৷ এই গাছ লাগানোর সচেতনা আমাদের ছোটবেলা থেকে শুরু করতে হবে ৷ একটি ছেলে বা মেয়ে যদি দশ বছর বয়স থেকে এই গাছ লাগানোর প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়, তাহলে আগামী চল্লিশ বছরের মধ্যে সেই লক্ষ্যপূরণ হবে ৷ আর আম গাছ লাগানোর কারণ, গাছটির অস্তিত্ব বাঁচানো এবং পরিবেশ রক্ষা করা ৷"
প্রায় একই সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে এই কাজে যোগদানের কথা জানিয়েছেন জসমীত সিং ৷ এই কাজে তিনি 'ক্যাচ দেম ইয়ং' স্লোগানকে কাজে লাগিয়েছেন ৷ তাতে ফলও মিলছে ৷ তাঁর কথায়, "এই কাজে আমরা কলকাতার নামজাদা স্কুলগুলোকে ইতিমধ্যেই পেয়েছি ৷ কয়েকটি ক্লাবও এর সঙ্গে রয়েছে ৷ এমনকি কলকাতা শহরের যত ফলের রসের দোকান আছে, তারাও এগিয়ে এসেছে ৷ আমরা প্রতিদিন একশো থেকে দেড়শো পার্সেল পাচ্ছি ৷ তিপ্পান্ন হাজার আঁটি আমরা সর্বোচ্চ একদিনে পেয়েছি ৷"