হাওড়া, 3 ফেব্রুয়ারি: মানব সভ্যতার ইতিহাসে চাকার আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতা দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে শুরু করে। এই গতি নতুন দিশা পায় 1825 সালের সেপ্টেম্বর মাসে, যখন বিশ্বের প্রথম ট্রেন যাত্রা শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় 28 বছর পর অর্থাৎ 1853 সালের 16 এপ্রিল, ভারতেও প্রথমবার ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এর 72 বছর পর অর্থাৎ 3 ফেব্রুয়ারি 1925, ভারতীয় রেল ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোগ করে, যখন প্রথমবার মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ টার্মিনাস (CSMT) থেকে কুরলা পর্যন্ত বিদ্যুৎচালিত ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়।
3 ফেব্রুয়ারি, 2025 ৷ আজকের দিনেই ভারতীয় রেলের বিদ্যুতায়নের 100 বছর পূর্ণ হল ৷ একইসঙ্গে, ভারত তার ব্রড গেজ নেটওয়ার্কের 100 শতাংশ বিদ্যুতায়নের দোরগোড়ায় রয়েছে, যা ভারতীয় রেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি ভারতের প্রথম রেল যাত্রার মতোই ঐতিহাসিক এবং ভারতীয় রেলের অগ্রগতির প্রতীক।
বিদ্যুতায়নের পথে: এক শতাব্দীর যাত্রা
বিশ্বে প্রথমবার ট্রেন চালু হওয়ার মাত্র 28 বছরের মধ্যে ভারতেও ট্রেন চলতে শুরু করে। তবে ভারতে বিদ্যুৎচালিত রেল ইঞ্জিন চালু হতে আরও সময় লাগে। 1879 সালে জার্মানিতে প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎচালিত যাত্রীবাহী ট্রেন চালু হয় ৷ যদিও ভারতে এই প্রযুক্তি আসতে 46 বছর সময় লেগেছিল ৷ বিদ্যুৎচালিত ইঞ্জিন খুব দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ৷
মুম্বইয়ে বিদ্যুতায়ন: প্রথম পদক্ষেপ
বিংশ শতকের শুরুতে মুম্বইয়ের দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার জন্য একটি কার্যকর পরিবহণ ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। সেই সময়, স্টিম ইঞ্জিন পুনে ও নাসিকের মতো উঁচু ঢালযুক্ত পথে ট্রেন চালাতে পারছিল না। ফলে বিদ্যুতায়নের প্রয়োজনীয়তা আরও বৃদ্ধি পায় ৷ 1904 সালে, বম্বে প্রেসিডেন্সির প্রধান ডব্লিউ এইচ হোয়াইট মুম্বইয়ের দু'টি প্রধান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে (GIP) এবং বম্বে বরোদা অ্যান্ড সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া রেলওয়ে (BB&CI) বিদ্যুতায়নের প্রস্তাব দেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে এই প্রকল্পটি বিলম্বিত হয়।
অবশেষে 3 ফেব্রুয়ারি 1925 সালে, ভারত প্রথমবারের মতো 1500 ভোল্ট ডিসি (DC) সিস্টেমে ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস থেকে কুরলা পর্যন্ত 16 কিলোমিটার বিদ্যুৎচালিত ট্রেন চলে। এই পদক্ষেপ ভারতীয় রেলের আধুনিক ও পরিচ্ছন্ন পরিবহণ ব্যবস্থার সূচনা করে।
দক্ষিণ ভারতে বিদ্যুতায়ন
মুম্বইয়ের পাশাপাশি, দক্ষিণ ভারতেও বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু হয়। দক্ষিণ ভারতীয় রেলওয়ে (SIR) তার উপনগরীয় নেটওয়ার্ককে 1500 ভোল্ট ডিসি সিস্টেমে বিদ্যুতায়িত করে। 1931 সালের মধ্যে মাদ্রাজ বিচ (বর্তমানে চেন্নাই) থেকে তাম্বারাম পর্যন্ত বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন হয়। 1947 সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় দেশে মাত্র 388 কিলোমিটার রেলপথ বিদ্যুতায়িত ছিল, যা মূলত মুম্বই ও মাদ্রাজের আশপাশে কেন্দ্রীভূত ছিল।
পূর্ব ভারতে বিদ্যুতায়নের সূচনা
যেখানে মুম্বইয়ে প্রথম থেকেই বিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল, সেখানে পূর্ব ভারতে এই প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। বিশ্বযুদ্ধ ও 1930-এর অর্থনৈতিক মন্দার ফলে কলকাতা অঞ্চলে বিদ্যুতায়ন শুরু হতে দেরি হয়। 1954 সালে, ভারতীয় রেল ইউরোপীয় বিদ্যুতায়ন মডেল পরীক্ষা করে দেখে এবং এই অঞ্চলের জন্য 3000 ভোল্ট ডিসি সিস্টেম বেছে নেয়। এরপর 1957 সালের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব ভারতের প্রথম বৈদ্যুতিক ট্র্যাকে হাওড়া ও শেওড়াফুলি স্টেশনের মধ্যে ট্রেন চলাচল করে।
নতুন যুগের সূচনা: 25 KV AC সিস্টেমের গ্রহণযোগ্যতা
ফ্রান্সের SNCF রেলওয়ে 25 হাজার ভোল্ট এসি (AC) সিস্টেম উন্নত করে, যা শুরুতে সন্দেহের চোখে দেখা হলেও পরবর্তীতে এটি সফল হয়। 1959 সালে, রাজখরসাওয়ান-ডাঙ্গোপোসি বিভাগে সফল পরীক্ষার পর, 1957 সালের নভেম্বর মাসে ভারতীয় রেল25 KV ACসিস্টেমকে স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে গ্রহণ করে। এর ফলে, ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের পর এই পদ্ধতি গ্রহণকারী বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ হয়ে ওঠে।
পরিবেশবান্ধব পরিবহণ: বিদ্যুতায়নের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
রেল বিদ্যুতায়ন পরিবহণ ব্যবস্থাকে আরও পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব করে তোলে। এটি কার্বন নির্গমন হ্রাস করে, যা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া, এটি ভারতকে বিদেশ থেকে আমদানি করা তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে বহুমূল্য বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় হয় এবং দেশের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
সারা ভারতে বিদ্যুতায়ন: নতুন দিগন্ত
- 1966 সাল নাগাদ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলের অঞ্চলে পণ্যবাহী ট্রেনের 50 শতাংশের বেশি বিদ্যুতিক রেলপথে চলাচল শুরু করে ৷ 2014-15 সালে ভারতীয় রেল প্রতিদিন গড়ে 1.42 কিলোমিটার বিদ্যুতায়নের কাজ সম্পন্ন করছিল, যা 2023-24 সালে বেড়ে দৈনিক 19.7 কিলোমিটারে পৌঁছে যায়।
- 2014 সালে, দেশে যেখানে মাত্র 21 হাজার 801 রুট কিলোমিটার (RKM) বিদ্যুতায়ন ছিল, সেখানে 2014-24 সালের মধ্যে এক দশকের মধ্যেই তা 44 হাজার 199 RKM-এ উন্নিত হয়।
- 2025 সালে, ভারত যখন রেল বিদ্যুতায়নের শতবর্ষ উদযাপন করবে, এটি সেই প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সাক্ষ্য বহন করবে, যা ভারতীয় রেলকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও আধুনিক নেটওয়ার্কে পরিণত করেছে।