কলকাতা, 8 অগস্ট:বাংলার রাজনীতির অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ৷ চলে গেলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৷ বৃহস্পতিবার পাম অ্যাভিনিউর বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি ৷ মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল 80 বছর ৷ রাজনীতির জগত থেকে সাধারণ মানুষ - সবার অন্তরে আলাদা জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন বরাবর বাম আদর্শে দীক্ষিত এই নেতা ৷ প্রবাদপ্রতীম বাম নেতা জ্যোতি বসুর ঐতিহ্য এগিয়ে নিয়ে চলার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন বুদ্ধদেবই ৷
1944 সালের 1 মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন বুদ্ধদেববাবু ৷ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর কাকা ৷ কলকাতার শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ে পড়াশোনা ৷ 1961 সালে সেখান থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ৷ এরপর 1964 সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলা নিয়ে সাম্মানিক স্নাতক ৷ স্কুল ও কলেজে এনসিসি-ও করেছিলেন ৷
তাঁর রাজনীতিতে হাতে খড়ি কলেজ জীবন থেকেই ৷ বাম রাজনীতির ধারা বুকে জড়িয়ে নানা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন ৷ একে একে বড় দায়িত্ব তাঁর কাঁধে চাপিয়েছে দল ৷ সিপিআইএম-এর রাজ্য কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যপদ, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ, এরপর পলিটব্যুরোর সদস্য হওয়া ৷ সব দায়িত্ব সামলেছেন সাফল্যের সঙ্গে ৷
1977 সালে বাংলায় বাম শাসন শুরু হলে মন্ত্রী হন তিনি ৷ রাজ্যের তথ্য ও জনসংযোগ দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ৷ পাঁচ বছর সেই দায়িত্ব সামলিয়ে পরের মন্ত্রিসভা গঠনের পর তাঁর দায়িত্ব বাড়ে ৷ তথ্য ও সংস্কৃতি, স্থানীয় প্রশাসন ও পৌর ও নগরোন্নয়ন দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হন তিনি ৷ রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতের গুরুদায়িত্ব তাঁর জিম্মায় আসে 1996 সালে ৷ তার ঠিক 3 বছর পর তিনি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ডেপুটি হিসেবে দায়িত্বভার কাঁধে নেন ৷ বসেন উপ-মুখ্যমন্ত্রী পদে ৷ এরপর অসুস্থতার কারণে জ্যোতিবাবু রাজনৈতিক অবসর নেওয়ায় 2000 সালের 6 নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৷ পরের বছরই ত্রয়োদশ বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে 18 মে ফের তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ৷ 2006 সালের নির্বাচনেও বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে আবার বামফ্রন্ট সরকারকে নেতৃত্ব দেন বুদ্ধবাবু ৷
তাঁর জয়যাত্রা থামে 2011 সালে ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূলের কাছে পরাস্ত হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি ৷ এর আগে, যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে টানা 24 বছর বিধায়ক ছিলেন ৷ 2011 সালের পরিবর্তনের ঢেউয়ে তাঁকে হারতে হয় তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারেরই একসময়ের মুখ্যসচিব মণীশ গুপ্তের কাছে ৷ তিনি দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী যিনি নিজের বিধানসভা কেন্দ্র থেকে পরাজিত হয়েছিলেন ৷ এর আগে 1967 সালে এই ঘটনা ঘটে প্রফুল্লচন্দ্র সেনের সঙ্গে ৷
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বিতর্কিত অধ্যায় সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম ৷ টাটা মোটরসের সঙ্গে চুক্তি করে জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে ন্যানো কারখানা তৈরি করার বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় ৷ তার পরের অধ্যায়টা ইতিহাস ৷ তবে বাম শাসনের পতন হলেও নানা ভাবে দলকে অক্সিজেন জুগিয়ে গিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৷ 2016 সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাম-কংগ্রেস জোটের সমর্থনে তাঁর বেনজির উদ্যোগের সাক্ষী থেকেছে রাজ্যবাসী ৷ পার্ক সার্কাসের জনসভায় এক মঞ্চে হাতে হাত মেলাতে দেখা যায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও কংগ্রেসের তৎকালীন সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধিকে ৷
দীর্ঘদিন ধরেই তিনি অসুস্থ ৷ যোগ দিতে পারেননি ব্রিগেডের সমাবেশে ৷ তবে তাঁর লিখিত বার্তা পেয়েই চাঙ্গা হয়েছেন বাম ছাত্র-যুবরা ৷ ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনেও বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ-এর সংযুক্ত মোর্চার সমর্থনে ব্রিগেড সমাবেশে যোগ দিতে না-পারার মানসিক যন্ত্রণার কথা জানান বুদ্ধবাবু ৷ তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নন্দীগ্রাম নিয়ে মন্তব্যের পর তার জবাব দিয়েছেন ৷
এতকিছু সত্ত্বেও কিছুতেই শরীর সঙ্গ দিচ্ছিল না ৷ যতবারই অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, ততবারই বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করতেন ৷ অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে খবরের কাগজে চোখ বোলানো, বই পড়া, দেশের-দশের খবর রাখা সবই করতে চাইতেন। কোভিডের ছোবলও সামলেছিলেন ৷ আজ প্রাতঃরাশের হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন টানা 11 বছর বাংলার মুখমন্ত্রীত্বের দ্বায়িত্ব সামলানো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সকাল 8টা 20 মিনিটে চিরবিশ্রামে চলে গেলেন কমরেড বুদ্ধদেব ৷