মালদা, 30 সেপ্টেম্বর: বিহার-নেপাল সীমান্তে কোশি নদীর ব্যারেজের 56টি লকগেটই খুলে দিয়েছে নেপাল প্রশাসন ৷ জলের চাপ কমাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে খবর ৷ সেই জল ইতিমধ্যে বিহারে ঢুকে পড়েছে ৷ সোম অথবা মঙ্গলবার কোশির জল গঙ্গা দিয়ে নেমে আসার কথা ৷ এই পরিস্থিতিতে উৎসবের মরশুমে বন্যার আশঙ্কা করছেন মালদা ও মুর্শিদাবাদের মানুষজন ৷ এমনিতেই কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে গৌড়বঙ্গের তিনটি জেলার প্রায় সব নদী ৷
উত্তর দিনাজপুরে এখনও তেমন সমস্যা না-হলেও দক্ষিণ দিনাজপুরে ফুঁসছে প্রধান তিন নদী আত্রেয়ী, পুনর্ভবা ও টাঙন ৷ এ দিকে মাস দেড়েক আগে থেকেই বানভাসি হয়ে রয়েছে মালদার ভূতনি চর ৷ রতুয়া 1 নম্বর ব্লকের মহানন্দটোলা ও বিলাইমারিও বিপন্ন ৷ কোশী নিয়ে আতঙ্কে ঘুম উড়েছে উত্তর মালদার বিস্তীর্ণ অংশে ৷ কারণ, 2017 সালে এই কোশীর জলেই হরিশ্চন্দ্রপুর-বিহার সীমান্তে থাকা ধবল বাঁধ ভেঙে ভেসে গিয়েছিল হরিশ্চন্দ্রপুর ও চাঁচলের চারটি ব্লক ৷ পরিস্থিতির উপর নজর রেখেছে প্রতিটি জেলার প্রশাসন ৷
উৎসব মরশুমে ভাসতে পারে মালদা ও মুর্শিদাবাদ (ইটিভি ভারত) পুজোর মুখে কোশী নদীর জলে মালদা ও মুর্শিদাবাদে বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ৷ রবিবার মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে তিনি বলেন, "নেপাল কোশী নদীর জল ছেড়ে দিয়েছে ৷ সেই জল বিহার হয়ে আমাদের দিকে আসছে ৷ এতে মালদা ও মুর্শিদাবাদে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে ৷ তবে ফরাক্কায় গঙ্গার ঠিকমতো ড্রেজিং না-হওয়ার জন্যই এবার উত্তরবঙ্গ প্লাবিত হয়েছে ৷"
ব্যারেজের সব গেট খুলে দেওয়া হয়েছে (নিজস্ব ছবি) রবিবার দুপুরেই মুর্শিদাবাদে গঙ্গা ও ভাগীরথীর জল বিপদসীমা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছিল ৷ জেলা প্রশাসনের তরফে নদীপাড়ের বাসিন্দাদের সতর্ক করা হচ্ছে ৷ একইভাবে গঙ্গা ও ফুলহর তীরবর্তী এলাকার মানুষকে সতর্ক করে চলেছে মালদা জেলা প্রশাসনও ৷ দুই জেলাতেই নদীতীরের মানুষজনকে দ্রুত উঁচু জায়গা কিংবা প্রশাসনের ফ্লাড সেন্টারে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে ৷
ফুলে ফেঁপে উঠেছে প্রায় সব নদী (নিজস্ব ছবি) বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার প্রায় সারারাত ধরে মানিকচক ব্লকে বৈঠক করেছেন মালদার জেলাশাসক নীতিন সিংহানিয়া ৷ বৈঠকে ছিলেন রাজ্যের সেচ দফতরের প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন, বিধায়ক সাবিত্রী মিত্র, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সেচ দফতরের আধিকারিকরাও ৷ গতকাল ভার্চুয়াল বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনকে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী মজুত রাখার পরামর্শ দেন ৷ তাঁকে জানানো হয়, সেদিন বিকেল থেকেই গঙ্গা ও ভাগীরথীর পাড়ে থাকা আটটি ব্লকের নদী তীরবর্তী মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরানোর কাজ শুরু হয়েছে ৷
এ দিকে টানা বৃষ্টির প্রভাবে জল বাড়তে শুরু করেছে দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রধান তিন নদীতে ৷ বিপদসীমা পেরিয়েছে পুনর্ভবা'র জলস্তর ৷ গঙ্গারামপুর ও তপন ব্লকের কিছু এলাকায় নদীর জল কৃষিজমিতে ঢুকে পড়েছে ৷ এই মুহূর্তে তপন ব্লকের আজমতপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসুরিয়া, জিগাতলি, সুতৈল, মনোহলি, শিবতলা গ্রামের বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি জলের তলায় ৷ জল ঢুকছে বাড়িঘরেও ৷
নদীর জল ঢুকে পড়েছে এলাকায় (নিজস্ব ছবি) গতকাল দুপুর থেকে সেই এলাকাগুলির বাঁধ পরিদর্শন করছেন সেচ দফতরের কর্মীরা ৷ বিকেল থেকে ময়দানে নেমেছেন তপনের বিডিও তীর্থঙ্কর ঘোষ ৷ বাসুরিয়া গ্রামের জ্যোৎস্না হাজরা বলেন, "নদীর জল ঘরে প্রায় ঢুকেই পড়েছে ৷ এবার 10 কাঠা জমিতে ধান লাগিয়েছি ৷ জলের তলায় চলে গিয়েছে ৷ এখন কীভাবে চলব ? সরকারের তরফে আমাদের জন্য কোনও ব্যবস্থা করা হোক ৷ গবাদি পশু, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমরা যাতে কোথাও থাকতে পারি, তার ব্যবস্থা করুক প্রশাসন ৷"
শুধু পুনর্ভবা নয়, রবিবার পর্যন্ত জলস্তর বেড়েছে আত্রেয়ী ও টাঙনেও ৷ তবে সোমবার থেকে এই জেলার তিন নদীর জলই কমতে শুরু করেছে ৷ এ দিন সকালে আত্রেয়ীর জলস্তর ছিল 21.29 মিটার ৷ বিপদসীমা 23.15 মিটার থেকে 1.86 মিটার কম ৷ পুনর্ভবা বইছে 26.12 মিটার উচ্চতায় ৷ বিপদসীমা 25.82 থেকে 30 সেন্টিমিটার বেশি ৷ টাঙনের জলস্তর এ দিন ছিল 26.15 মিটার ৷ বিপদসীমা 25.60 মিটারের থেকে 55 সেন্টিমিটার উঁচু দিয়ে বইছে এই নদী ৷
নদীর জল প্রায় ঘরে ঢুকে পড়ার অবস্থায় (নিজস্ব ছবি) উত্তর দিনাজপুরে এখনও বন্যা পরিস্থিতি তৈরি না-হলেও ওই জেলার নদীগুলিও ফুলেফেঁপে রয়েছে ৷ পুনর্ভবা ও টাঙন এই জেলাতেও রয়েছে ৷ ফুঁসছে কুলিক, এমনকী শ্রীমতী নদীও ৷ রবিবার কালিয়াগঞ্জের বিডিও প্রশান্ত রায় রাধিকাপুর এলাকায় কুলিক নদীর বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করেন ৷ মালদার মানিকচক ব্লকে দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে ভূতনি চরের তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত জলের তলায় ৷ সেখানে ইতিমধ্যে জলে তলিয়ে মৃত্যু হয়েছে 10 জনের ৷ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে রতুয়া 1 নম্বর ব্লকের মহানন্দটোলা ও বিলাইমারি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেও ৷ সোমবার বিলাইমারির রুহিমারি গ্রামে পরিস্থিতি পরিদর্শনে গিয়েছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) উত্তর মালদার মহকুমাশাসক অনিন্দ্য সরকার, উত্তর মালদার মহকুমাশাসক সৌভিক মুখোপাধ্যায়, বিডিও রাকেশ টোপ্পো-সহ প্রশাসনিক কর্তারা ৷
অতিরিক্ত জেলাশাসক বলেন, "গঙ্গার জল অনেকটাই বেড়েছে ৷ এখানে ভাঙনের সমস্যা আছেই ৷ তার উপর বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ৷ ভূতনি তো বটেই, বন্যা দেখা দিয়েছে রতুয়াতেও ৷ আমরা দুর্গতদের ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার সবরকম চেষ্টা করছি ৷ সেই ত্রাণ তাঁদের হাতে পৌঁছোচ্ছে কি না, আজ সেটাই দেখতে এসেছি ৷"
জলের তলায় বিঘা বিঘা জমি (নিজস্ব ছবি) তবে এই মুহূর্তে মালদা জেলা প্রশাসনের সবচেয়ে বেশি ভয় ফুলহরের ধবল বাঁধ নিয়ে ৷ শনিবার ভোরে কোশি নদীর সমস্ত গেট খুলে দিয়েছে নেপাল ৷ এতে ধবল বাঁধের কাছে ফুলহর ও মহানন্দার জলস্তরও বাড়তে শুরু করেছে ৷ বাঁধ বাঁচাতে গ্রামবাসীরা রাত জাগতে শুরু করেছেন ৷ বিহার সরকারও ইতিমধ্যে মধুবনী, দ্বারভাঙ্গা সহ একাধিক জেলা প্রশাসনকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে ৷ বাংলা ও বিহার প্রশাসনের তরফে নদীপাড়ের মানুষকে মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছে ৷
2017 সালে এই ধবল বাঁধ ভেঙেই ভেসে গিয়েছিল উত্তর মালদার বিস্তীর্ণ এলাকা ৷ হরিশ্চন্দ্রপুর 2 নম্বর ব্লকের বিডিও তাপস পালের কথায়, "আমি গতকাল রাতে ধবল বাঁধের পরিস্থিতি দেখে এসেছি ৷ জল এখনও বাঁধের নীচে রয়েছে ৷ ওই এলাকায় তিনটি ফ্লাড সেন্টার খোলা হয়েছে ৷ নদীপাড়ের মানুষজনকে সেখানে যেতে বলা হয়েছে ৷ বিহার প্রশাসনের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছে ৷ পরিস্থিতির উপর আমরা নজর রেখেছি ৷"
এ দিন গঙ্গার জলস্তর ছিল 24.78 মিটার, বিপদসীমা 24.69 মিটার থেকে 9 সেন্টিমিটার উঁচুতে ৷ ফুলহর বইছে 28.24 মিটার উচ্চতায় ৷ এই নদীর বিপদসীমা 27.43 মিটার এবং চূড়ান্ত বিপদসীমা 28.35 মিটার ৷ যা পরিস্থিতি, তাতে এ দিন রাতের মধ্যেই ফুলহর চূড়ান্ত বিপদসীমা পার করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে ৷
যদিও ফরাক্কা ব্যারেজ প্রোজেক্টের এক শীর্ষস্থানীয় আধিকারিক জানিয়েছেন, "বর্ষা মরশুমে প্রতিদিনই ব্যারেজ থেকে 16, সাড়ে 15 লাখ কিউসেক জল ছাড়া হয় ৷ এই ব্যারেজের জল ধারণ ক্ষমতা 21 লাখ কিউসেক পর্যন্ত ৷ গতকাল বিকেল পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মেই জল ছাড়া হয়েছে ৷ কোশির জল নিয়ে আমরা এখনও বিশেষ কিছু ভাবছি না ৷ সেই জল ফরাক্কায় পৌঁছোনোর আগে মহানন্দা-সহ বিভিন্ন শাখা নদীতে চলে যাবে ৷ আমরা পরিস্থিতির উপর নজর রেখেছি ৷"
মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, সোমবার দুপুরে ফরাক্কা ব্যারেজ থেকে 19.9 লাখ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে বলে খবর মিলেছে ৷ এতে ফরাক্কা, সামশেরগঞ্জ, সূতি 2, রানিনগর 2, লালগোলা, ভগবানগোলা 1, জলঙ্গি ও রঘুনাথগঞ্জ 2 নম্বর ব্লকে বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে ৷ জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র জানিয়েছেন, "আমরা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি ৷ বন্যা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হয়েছে ৷" একই বক্তব্য মালদার জেলাশাসক নীতিন সিংহানিয়ারও ৷