ব্যান্ডেল, 15 জানুয়ারি: বৈষ্ণবধর্মে বিশ্বাসীরা সাধারণত নিরামিষাশী হন ৷ মাছ-মাংস থেকে বরাবরই দূরত্ব বজায় রাখেন ৷ কিন্তু এক অমোঘ জাদুতে সেই বৈষ্ণবদের উৎসব হয়ে উঠেছে মাছের মেলা ৷ যে উৎসবের একদিকে চলে নাম-সংকীর্তন অন্যদিকে মাছ বিকিকিনি ৷ মাছ বিক্রি হচ্ছে একবারে রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের ঠিক পিছনেই ৷ বড় বড় বঁটি নিয়ে সারি সারি বসে রয়েছেন মাছ ব্যবসায়ীরা ৷ মেলা না মাছের বাজার দেখে বোঝা দায় ৷ কাঁচা থেকে ভাজা, রকমারি মৎস্যে গৌণ হয়েছে বৈষ্ণবদের মেলার আসল নাম ৷ সেই মাছ কিনে রান্না করে পাশেই চলছে দেদার পিকনিক ৷
জানা গিয়েছে, 519 বছর আগে জমিদার বংশের ছেলে রঘুনাথ দাস গোস্বামীর প্রত্যাবর্তনে গ্রামে উৎসব শুরু হয়েছিল । সেই উৎসবই আজ মাছের মেলায় পরিণত হয়েছে ৷ তবে এর নেপথ্যেও রয়েছে এক ইতিহাস ৷ দেবানন্দপুর অঞ্চলের জমিদার গোবর্ধন গোস্বামীর ছেলে ছিলেন রঘুনাথ দাস গোস্বামী । কৃষ্ণের সাধনা করে মহাপ্রভু চৈতন্যের পারিষদ নিত্যানন্দের কাছে দীক্ষা নেওয়ার জন্য পানিহাটিতে যান । মাত্র 15 বছর বয়সে গৃহত্যাগী হন । বয়স কম থাকায় তাঁকে দীক্ষা দেননি নিত্যানন্দ । কেবল তাঁর ভক্তির পরীক্ষা নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন ।
মাছের মেলায় দেদার বিকিকিনি, দেখুন ভিডিয়ো (ইটিভি ভারত) অগত্যা দীর্ঘ 9 মাস পর রঘুনাথ বাড়ি ফিরে যান । বৃন্দাবন থেকে ছেলের ফেরার আনন্দে বাবা গোবর্ধন গোস্বামী গ্রামের মানুষকে খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেন । গ্রামের মানুষও তাঁর ভক্তির পরীক্ষা নেওয়ার জন্য অসময়ে কাঁচা আমের ঝোল ও ইলিশ মাছ খাওয়ার আবদার করে । সেই মতো নদী থেকে জাল ফেলে ইলিশ মাছ ও আমবাগান থেকে আম পেড়ে খাওয়ানো হয় । সেই মাছ খাওয়ানোর রীতি থেকেই মাছের মেলার সূত্রপাত । স্থানীয় ব্যবসায়ীরাই বিভিন্ন ধরনের মাছ এনে রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে পিছনে বিক্রি করতে শুরু করেন । দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসায় এখন তা বড়মেলার আকার নিয়েছে । বোয়াল থেকে চুনো পুঁটি, রুই, কাতলা, ইলিশ, ভেটকি, ভোলা ও শংকর মাছ থেকে চিংড়ি-কাঁকড়া কী নেই এই মেলায় । সব ধরনের মাছ পাওয়া যায় ব্যান্ডেলের দেবানন্দপুরের কেষ্টপুরের এই মাছের মেলায় ।
রঘুনাথ দাস গোস্বামীর স্মরণোৎসবে ঠাকুরবাড়িতে ভক্তদের ভিড় (ইটিভি ভারত) 30 থেকে 40 কিলো ওজনের মাছের পসরা নিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা । সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই মেলা চলে । হুগলি ছাড়াও নদিয়া ও হাওড়া-সহ একাধিক জায়গা থেকে মানুষ এই মাছের মেলায় অংশ নেন ।
মাছের বাজার না মেলা বোঝা দায় (ইটিভি ভারত) এই মেলা প্রসঙ্গে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের সেবাইত অমর চক্রবর্তী বলেন,"বৃন্দাবন থেকে রঘুনাথ দাস গোস্বামী যেদিন ফিরেছিলেন সেই দিন তাঁর স্মরণেই এই মেলা শুরু । মন্দিরের পিছনে মাছ রান্না করে খেয়েছিলেন স্থানীয় মানুষজন । আর বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ মন্দিরের ভিতরেই ভোগপ্রসাদ খেয়েছিলেন । তারপর থেকেই এই উৎসব মাছের মেলা নামে পরিচিত হয় ৷ সারাদিন নাম সংকীর্তন চলে ও পুজোপাঠ হয় এখানে । বাইরে চলে খাওয়াদাওয়া ৷
গামলা ভরা মাছ ভাজা (ইটিভি ভারত) বিবাহসূত্রে বাইরে থাকলেও মাছের মেলা এখনও তাঁকে টানে ৷ বলছেন স্থানীয় বাসিন্দা দেবশ্রী দে ৷ তাঁর কথায়,"বাবা-মার সঙ্গে ছোটবেলা থেকে আসি এই মেলায় । মেলার প্রতি টান আজও রয়ে গিয়েছে । বাজারের চেয়ে দাম একটু বেশি হলেও এখানকার মাছের স্বাদ খুবই ভালো ।"
পেল্লায় সাইজের সব মাছ বিক্রি হচ্ছে মাছের মেলায় (ইটিভি ভারত) চুঁচুড়া চকবাজারের ব্যবসায়ী ইন্দ্রজিৎ মণ্ডল বলেন,"2004 সাল থেকে এই মেলায় আসি । এ বছরে আড় মাছ, ভেটকি, টোনা ও গুড়জালি এনেছি ৷ 200 টাকা থেকে 600 টাকা পর্যন্ত মাছ বিক্রি করছি । আমরা দিঘা, ওড়িশা, কাকদ্বীপ-সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ভালো মাছ নিয়ে আসি প্রতিবার । সেই কারণে দাম একটু বেশি হলেও গ্রাহকরা খুশি করে এই মাছ নিয়ে যান ৷"
আহা ! রকমারি মাছ ভাজা পেলে বেশ হত মজা (ইটিভি ভারত)