তারাপীঠ, 2 সেপ্টেম্বর: আজ কৌশিকী অমাবস্যা । এই দিনে তারা মায়ের বিশেষ পুজোর আয়োজন হয়েছে তারাপীঠে ৷ সেই উপলক্ষে তারাপীঠে উপচে পড়েছে পুণ্যার্থীদের ভিড় । এই দিনে তারাপীঠে ভিড় জমিয়েছেন দেশের নানাপ্রান্ত থেকে আসা তন্ত্র সাধকরাও ৷ কথিত আছে, ভাদ্র মাসের কৌশিকী অমাবস্যা তিথিতে সাধনা করে তারা মায়ের দর্শন পান এবং সিদ্ধিলাভ করেন সাধক বামদেব ।
কৌশিকী অমাবস্যায় জমজমাট তারাপীঠ (নিজস্ব ভিডিয়ো) কৌশিকী অমাবস্যাতে তারাপীঠে বিশেষ পুজো
জানা গিয়েছে, আজ ভোর 5টা 7 মিনিটে কৌশিকী অমাবস্যা তিথি শুরু হয়েছে । তার আগে তারা মায়ের ব্রম্ভ শিলামূর্তিকে স্নান করা হয়েছে । তারপর ফুল ও স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে রাজ রাজেশ্বরী বেশে সাজানো হয়েছে তারা মাকে । এরপর শুরু হয় মঙ্গল আরতি । মঙ্গল আরতির পর পুণ্যার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজা । এরপর থেকেই তারা মাকে পুজো দিচ্ছেন ভক্তরা ।
এ দিন দুপুরে দেবীকে অন্নভোগ নিবেদন করা হয় ৷ তার আগে ফের তাঁকে রাজবেশে সাজানো হয়েছে । গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ করে সবার অন্তরালে দেবীকে ভোগ নিবেদন করা হয় । এই সময় মন্দিরের দুটি দরজা বন্ধ রাখা হয় । আজকের ভোগে ছিল পোলাও, ফ্রায়েড রাইস, ভাত , ডাল, পাঁচ রকমের ভাজা, পাঁচ রকমের তরকারি, মাছ, বলির পাঁঠার মাংস, শোলমাছ পোড়া, পাঁচ রকমের মিষ্টি, পায়েস ও কারণ সুধা । ভোগ নিবেদনের পর ফের মন্দির খুলে দেওয়া হয় পুণ্যার্থীদের জন্য ।
তারা মায়ের ভোগে থাকছে বিশেষ পদ
সন্ধ্যায় তারা মাকে শোলার ডাকের সাজে সাজানো হবে । সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টায় শুরু হবে মঙ্গল আরতি । মঙ্গল আরতির পর তারা মাকে খই, মুড়কি, বাতাসা, লুচি ও মিষ্টি দিয়ে শীতল ভোগ নিবেদন করা হবে । তারপর রাত ন'টার পর তারা মায়ের বিশেষ পুজো হবে । রাত 12টার পর তারা মাকে খিঁচুড়ি ও পাঁচরকম ভাজা দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হবে । সোমবার সারারাত তারাপীঠ মন্দির খোলা থাকবে । পুণ্যার্থীরা সারারাত তারা মাকে পুজো দিতে পারবেন । ভোর 3টে নাগাদ এক ঘণ্টার জন্য দেবীকে শয়নে রাখা হবে । সেই সময় মন্দিরের দুটি দরজাই বন্ধ থাকবে । তারপর পুণ্যার্থীদের পুজো দেওয়ার জন্য ফের খুলে দেওয়া হবে মন্দিরের দরজা ।
তারাপীঠ মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্য ভিড় (নিজস্ব ছবি) তারাপীঠ মহাশ্মশানে ভিড়
এ দিন কৌশিকী অমাবস্যা তিথি শুরু হতেই মন্দিরের পাশে থাকা তারাপীঠ মহাশ্মশানে শুরু হয়ে গিয়েছে হোমযজ্ঞ ও তন্ত্র সাধনা । সন্ধ্যার পর সেই হোমযজ্ঞের সংখ্যা আরও বাড়বে । এই কৌশিকী অমাবস্যার তিথিতে তারাপীঠ মহাশ্মশানে তন্ত্র সাধনা করতে এসেছেন বহু তন্ত্র সাধক । তারাপীঠের মূল মন্দির সাজানো হয়েছে ফুলের মালা দিয়ে । মন্দির চত্বরে লাগানো হয়েছে রংবেরঙের আলোও । বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা । প্রবেশ পথগুলিতে বসানো হয়েছে মেটাল ডিটেক্টর গেট । নিরাপত্তার জন্য রয়েছে 1000 পুলিশ কর্মী, 1700 জন সিভিক ভলান্টিয়ার ও মন্দির কমিটির 300 জন বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মী ।
কৌশিকী অমাবস্যার ইতিকথা
কথিত আছে, পুরাযুগে শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই অসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল দেবতাকূল । সেসময় তাঁরা মহাদেবের শরণাপন্ন হন ৷ মহাদেব দেবীদুর্গাকে শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করার অনুরোধ করেন । সেই মতো দেবীদুর্গার কোষ থেকে দেবী কৌশিকীর উৎপত্তি হয় । দেবী কৌশিকী এরপর শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করেন । সেই দিনটি ছিল অমাবস্যার তিথি । দেবী কৌশিকী শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করে দেবতাকূলকে রক্ষা করেছিলেন ৷ তাই এই অমাবস্যা 'কৌশিকী অমাবস্যা' নামে অভিহিত । তারাপীঠ মহাশ্মশানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন ব্রহ্মার সপ্তম মানসপুত্র বশিষ্টদেব । জনশ্রুতি রয়েছে, তারাপীঠের মহাশ্মশানে শ্বেত শিমূল বৃক্ষের নীচে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে কৌশিকী অমাবস্যার তিথিতে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সাধক বামদেব । তাই 'সিদ্ধপীঠ' নামে অভিহিত হয়েছে বীরভূমের তারাপীঠ ।
কৌশিকী অমাবস্যায় তারাপীঠ মন্দির (নিজস্ব ছবি) তারাপীঠের ইতিহাস
বশিষ্ঠদেব থেকে শুরু করে সাধক বামাক্ষ্যাপার অলৌকিক কাহিনী জড়িয়ে আছে তারা মা'র এই প্রাঙ্গণে । ঐতিহ্যবাহী তারাপীঠে যে মানুষজন শুধু ভক্তির টানেই ছুটে আসেন তা নয়, ভারত-সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইতিহাসের টানেও এখানে ছুটে আসেন অনেকেই । দেবীর আবির্ভাব ও পৌরাণিক কাহিনি বর্ণিত আছে তারাপীঠের অঙ্গে অঙ্গে । সমুদ্র মন্থনের সময় নীলকণ্ঠ পান করে মহাদেব শিথিল হয়ে পড়েছিলেন । দেবী দুর্গা মা তারা রূপে মহাদেবকে স্তন্যপান করিয়েছিলেন । শুক্লা চতুর্দশীর দিন সেই মা তারা রূপেই বশিষ্ঠদেবকে দেখা দিয়েছিলেন তিনি । সেই থেকে এই স্থানের নাম হয় তারাপীঠ । তবে আরও বিভিন্ন মত রয়েছে ।
বলা হয়, বিষ্ণুর চক্রে সতীর দেহ যখন খণ্ড খণ্ড হয়ে গিয়েছিল, সেই সময় চোখের মণি বা তারা এখানে পড়েছিল । এর বাইরেও আরও পৌরাণিক মত রয়েছে । তারাপীঠের তারা মায়ের প্রথম মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তারাপীঠ মহাশ্মশানে । দ্বারকা নদীর বন্যার জলে সেই মন্দির বারবার ভেঙে যাওয়ায় শ্মশান থেকে কিছুটা দূরে উঁচু জায়গায় নতুনভাবে মন্দির নির্মাণ করে সেই মন্দিরে তারা মাকে অধিষ্ঠিত করা হয় । তারাপীঠের বর্তমান তারা মায়ের মন্দিরটি 1818 সালে বীরভূমের মল্লারপুরের জমিদার জগন্নাথ রায় নির্মাণ করেছিলেন । এই তারাপীঠ আরও খ্যাতিলাভ করে সাধক বামাক্ষ্যাপার ভক্তি ও অলৌকিক কাহিনী সমূহের মধ্যে দিয়ে ।
সাধক বামদেবের তারা মায়ের দর্শন ও সিদ্ধিলাভ
1837 সালে শিবচতুর্দশীর তিথিতে তারাপীঠ সংলগ্ন আটলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় । ছোটবেলায় তারাপীঠের দ্বারকা নদীর তীরে মহাশ্মশানে তিনি চলে আসেন । সেখানেই সাধনা করে বামদেব তারা মায়ের দর্শন পান এবং সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন । সেই দিনটি ছিল ভাদ্র মাসের কৌশিকী অমাবস্যা । তারপর থেকেই সেই প্রাচীন কাল থেকে আজও এই কৌশিকী অমাবস্যার তিথিতে তারাপীঠ মহাশ্মশানে তন্ত্র সাধনা করতে আসেন বহু তন্ত্রসাধক । অমাবস্যার তিথির নিশিরাতে তারাপীঠের মহাশ্মশানে জ্বলে ওঠে হাজারে হাজারে হোমকুণ্ড । এই বিশেষ দিনে মনস্কামনা পুরনের আশায় তারা মায়ের পুজো দেন লক্ষ লক্ষ ভক্ত । তারাপীঠে তারা মায়ের দর্শন করতে এলে 'সাধক বামাক্ষ্যাপার' জন্মভিটে দর্শন করেন পুণ্যার্থীরা ।